Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

মহালয়ার ভোরের অপেক্ষায় যেন বসে থাকা সারাটা বছরই

‘বাজল তোমার আলোর বেণু’র সুরে রাত পোহায় শারদ প্রাতে। লিখেছেন মণিদীপা নন্দী বিশ্বাসভোর থেকে বিকেল, স্বাধীনতা মানে ফুল কুড়োনো, মালা গাঁথা, কাশের গুচ্ছ তোর্সার অদূর চরে।

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:১৮
Share: Save:

ভোরের শিশির, আবছায়া ধোঁয়াশা আর বীরেন্দ্রকিশোর ভদ্রের স্তোত্র উচ্চারণ সব একাকার হয়ে যেত ভোর চারটের মায়ামাখা ঘুম ঘুম চোখে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে। বাবার আলতো স্পর্শ অনুভব করতাম। বড় রেডিওটা তত ক্ষণে সচল। এদিক ওদিক কিচমিচ পাখির ডেকে ওঠা, ঘরের আবছা আলোয় মায়ের হাতে একরাশ গোলাপি স্থলপদ্ম। দরমার বেড়ার ফুটো দিয়ে পুজোর আলোর আবাহন। সে ছবি কি সহজ ভুলে যাওয়ার? সে তো ছবি। ভোরের ঠান্ডা বেশ। ফানেলের প্যান্ট, ফ্রক। কান রুমালে বেঁধে দিয়ে মা প্রস্তুত করে দিয়েছেন। বন্ধুদের সঙ্গে বেরোনোর স্বাধীনতা মিলেছে। ওই একটি দিনই ছাড়।

ভোর থেকে বিকেল, স্বাধীনতা মানে ফুল কুড়োনো, মালা গাঁথা, কাশের গুচ্ছ তোর্সার অদূর চরে। আর রোদ ঝকঝকে হয়ে ওঠার আগেই ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’র সুরে সুরে হারমোনিয়ামে ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে’ গলায় তুলে আনা মানে প্রাণের ভিতর গেয়ে ওঠা। এ যেন জড়িয়ে থাকা গান ছড়িয়ে থাকা শিউলি। সেই রকম পবিত্র ভোর প্রতি বছর আসে। রেডিওটা বদলে গিয়েছে, বদলে গিয়েছে ঘরের আবহ। চোখ মেলে খুব পরিচিত সেই হাতের স্পষ্ট ছোঁয়া অনুভব করি। তাকাতে ইচ্ছে করে না শুধু। জানি, তাকালেই যে মিলিয়ে যাবে।

তবে এখনও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র শ্লোক উচ্চারণ করেন, দশভুজার আবাহনী গেয়ে ওঠেন শিল্পীরা। চোখ বুজে অনুভব করি সেই শৈশব উঠোন, মশারির ভিতর অল্প আলোয় কার ছায়া। ভয় করলে এখনও ভেবে নিয়েছি, বাবা আছেন শুয়ে পাশে। মহালয়ার এই পুণ্য সকালের জন্য আর একবার বাঙালি হয়ে জন্মাতে চাই আমি।

মহালয়া, সেই দেবী আবাহনী শুনব বলে বছর ভর অপেক্ষা করি আমি, আমার মতো আরও সকলে। তবু সে আবেগ এখন কোথায়? রেগে উঠি যখন তখন কেউ মহালয়া শুনছে দেখলে। মহালয়ার জন্য আমার মনে যে একটি নির্দিষ্ট সময়ই বাঁধা রয়েছে। ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অনুভূতি, শ্লোকের ভাব গাম্ভীর্য অথবা গানগুলোর ভিতর যে মন কেমনের অনুভূতি, অদ্ভুত ছন্দিত ক্ষণ, তা মরে যায় অন্য কোনও সময় শুনলে।

মহালয়া শুরু হয়। চোখ বুজি, ভাবি দেবী কিভাবে সকলের শুভ ইচ্ছায় প্রবল তরঙ্গে দৈবী শক্তির সম্মিলিত সজ্জায় সজ্জিত হচ্ছেন অশুভকে দমন করবেন বলে। সেই শক্তি নেমে আসছে আমাদের রক্ষা করবে বলে। পিতৃতর্পণের শেষে শুরু হল দেবীপক্ষ। ...‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা / নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।’

সব কিছুর সময় আছে। শুভ মুহূর্তগুলো তাই গাঁথা হয়ে যায়। তা অমান্য করলে মন খারাপ হয়ে যায়।

মহালয়ার দিন ছুটি। ছুটির আলোর বাঁশির মাঝেই সকলের মুখে হাসি দেখতে চাই। প্রতিজ্ঞা করতেই পারি, বন্ধ চা বাগানের জমায়েতে শ্রমিকের ঘরে উঠুক নতুন চাল, নতুন বস্ত্র। জীবনের সমস্ত দুঃখ ভুলে তাঁরাও যোগ দিন সকলের সঙ্গে আনন্দে। ওই একদিন সূচনার দিন হোক ভাল থাকার। সবাইকে নিয়ে বাঁচার দিন।

সেই স্মৃতি কাতরতাতেই ভাদ্রের উঠোন ভরেছিল আলমারি ট্রাঙ্ক, সুটকেসে জমিয়ে রাখা পুরোনো গন্ধের জামাকাপড়, বই খাতার ধুলোতে। নতুন রোদে কেটে গিয়েছে পুরোনো ধুলোর গন্ধ। দেবী আসছেন যে, এখন অনেক বাড়ির ছাদেই দেখতে পাই পুরনো সব জামা শুকতো দেওয়া হয়েছে। রঙিন হয়ে উঠেছে যেন ছাদই। তারপর আসে ‘বুড়ির চুল’ উড়ে আসা মহালয়ার আগে আর পরের সকাল। সকালের হাওয়ায় দোলা লাগে কাশের বনে আর উড়তে থাকে সাদা ফুলের আঁশ আর সেটাই ‘বুড়ির চুল’। ছোটবেলায় কি বিশ্বাসে সে বুড়ির চুল নামধারী ভেসে যাওয়া কাশের রোয়া কোনও ক্রমে হাতে ধরে মাথায় লাগাতাম। পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, চুল ভাল হবে। এখনও মনে হয়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় ফুরিয়ে যায়নি ছেলেবেলা, সেই সময়। এখনও রয়েছে, শুধু বদলেছে রূপ, গন্ধ, দেখার চোখ, আনন্দের অনুভূতি।

উৎসব কি আর একা একা জমে! কাছের মানুষের কাছাকাছি পৌঁছনোর কী অন্তহীন তাগিদ! দূর প্রবাস থেকে যে প্রিয়জনের কাছে আসার আকুতি সে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যময়। বিভিন্ন পাড়া জমজমাট হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে। শহর ছেড়ে দূরে যারা আছে, পাড়ার টানে বন্ধুর টানে বাড়ির মানুষের সঙ্গ পাওয়ার লোভে ফিরে ফিরে আসবেই। বেজে উঠবে ঢাক, কাঁসি, বিভিন্ন থিমের রকমারি নাম হবে। মহালয়ার সুর ছড়িয়ে যাবে দুর্গোৎসবে।

দুর্গাপুজো বলতে সত্যিই তাই বারবার মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। এখনকার যে জীবন, তাতে পুজোর ক’দিন নিশ্চয় আনন্দে কাটে। কিন্তু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, এ যেন দৌড়নোর পথে একটু জিরেন নেওয়া। কিছু বিশ্রাম, কিছু আড্ডা, একটু নিজের জন্য সময় বার করা। এই সময় নিজের প্রতি যত্ন নিলে কেউ আড় চোখে তাকাবে না।

সেই তুলনায় ছোটবেলায় ছিল শুধুই অবিমিশ্র আনন্দ। শুধুই ছোটাছুটি, আনন্দে লুটোপুটি। তাই বোধহয়, পুজোর সময় ছোটবেলার কথা এত মনে পড়ে। তাতে মন খারাপও হয়। সব সময় মনে হয়, ছোটবেলার মতো যেন আর কিছুই নেই। নিজেও জানি কথাটা ঠিক নয়। এখন এমন অনেক কিছু পাওয়া যায়, যা জীবন সহজ করেছে। এই যে মোবাইল ফোন—কত উদ্বিগ্ন প্রহর সে এক লহমায় মুছে দিয়েছে। কিন্তু পুজোর দিন যখন দেখি, মণ্ডপে না গিয়ে কেউ মোবাইল ফোনে পুজোর ছবি দেখছে, রেগে যাই। ছোটবেলা যে ঘাপটি দিয়ে বসে রয়েছে মনের মধ্যে।

তাই মন কেমন করে সেই বাঁশের দরমার বেড়ার ঘরে বিছানায় পৌঁছে যায় সে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্বর উঠে আসে শ্রুতিতে। চোখ বুজে চির পরিচিত, আমৃত্যু যে স্বর শাশ্বত, বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে সুর, সেই আলোর বেণুর মাধুর্য শরীর অবশ করে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

অন্য বিষয়গুলি:

2019 Durga Puja Special Mahalaya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy