ছবি: সংগৃহীত
মন্দা কাটাইতে কেন্দ্রের অন্যতম চাঙ্গায়নী সুধা— ঋণমেলা। চারশোটি জেলায় শিবির হইবে। গুরুত্ব পাইবে ‘অগ্রাধিকারী’ ক্ষেত্রগুলি, অর্থাৎ কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, গৃহনির্মাণ প্রভৃতি। ইহাতে আশা এবং আশঙ্কা, উভয়ই দেখা দিয়াছে। আশঙ্কা এই কারণে যে, ইতিপূর্বে সরকারের নির্দেশে অধিক ঋণ বিতরণের অভিজ্ঞতা ব্যাঙ্কগুলির জন্য সুখকর হয় নাই। গ্রাহকের যোগ্যতা বিচার করিবার নিজস্ব ব্যবস্থা ব্যাঙ্কগুলি তৈরি করিয়াছে। তাহা অভ্রান্ত নহে। কিন্তু সরকারের তাগাদায় ব্যাঙ্ক ও অন্য ঋণপ্রদান সংস্থাগুলি অভ্যস্ত সতর্কতা ভুলিয়া একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পশ্চাতে ছুটিতে বাধ্য হয়। তাহাতে ঋণ অনাদায়ী থাকিবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। কোনও গ্রাহক ঋণ ফিরাইতে অক্ষম, কেহ বা সরকারি নীতির ফাঁকটি বুঝিতে অতিশয় পারঙ্গম। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ব্যাঙ্কের লোকসানের এমন বহু নিদর্শন রহিয়াছে। উপরন্তু এ বৎসর সরকার ইহাও ঘোষণা করিয়াছে যে, ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত কোনও ক্ষুদ্র শিল্পকে ‘ঋণভারাক্রান্ত’ ঘোষণা করিতে পারিবে না ব্যাঙ্ক। এমন নির্দেশ হইতে ধারণা হইতে পারে যে, প্রচলিত বিধিনিয়ম মানিবার অপেক্ষা অধিক টাকা জুগাইয়া অর্থনীতির গতি বজায় রাখিতে সরকার বেশি আগ্রহী। ইহাতে ব্যাঙ্কগুলির ঝুঁকি কি আরও বাড়িল না? ঋণখেলাপি অ্যাকাউন্টের বোঝায় তাহারা যথেষ্ট দুর্বল।
কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তি নূতন সুযোগকে কাজে লাগাইয়া পুরাতন দুর্বলতা দূর করিবার পরিকল্পনা করেন। ভারতে দরিদ্র মানুষের এক বিপুল অংশের নিকট প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ এখনও অধরা। স্বাধীনতার সাত দশক পার হইয়াছে, অধিকাংশ দরিদ্রের ব্যাঙ্ক-সংযুক্তি হইয়াছে অতি সম্প্রতি। কিন্তু তাঁহাদের ‘জনধন’ অ্যাকাউন্টের একটি বড় অংশ শূন্যই পড়িয়া আছে। ঋণ পাইবার প্রক্রিয়া সহজ হইলে তাঁহাদের দীর্ঘ দিনের চাহিদা মিটিতে পারে। তৎসহ, দেশের অভ্যন্তরে সরকারি ঋণদানের চিত্রে যে প্রবল অসাম্য, তাহাও হ্রাস করা যাইতে পারে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সম্প্রতি কৃষিঋণ সম্পর্কিত একটি রিপোর্টে দেখাইয়াছে, এই অসাম্য নানা প্রকার। অসমতা প্রথমত ভৌগোলিক। মধ্য, পূর্ব এবং উত্তরপূর্ব, ভারতের এই বিশাল ভূখণ্ডের কৃষকেরা অতি সামান্য ঋণ পাইতেছেন। বীজ, সার, সেচ, কীটনাশক প্রভৃতির জন্য ন্যূনতম যে ব্যয়, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যের চাষির গৃহীত গড় কৃষিঋণের পরিমাণ তাহা মিটাইতে পারে না। অথচ কিছু রাজ্যে গড় কৃষিঋণ চাষের খরচকে ছাড়াইয়া গিয়াছে— কেরলে ছয় গুণ, গোয়ায় পাঁচ গুণ, তেলঙ্গানায় চার গুণ। সম্ভবত কৃষিঋণ অকৃষি খাতে ব্যয় হইতেছে। পূর্ব ও উত্তরপূর্ব ভারতে ঋণভীত চাষিদের মধ্যে ঋণের জন্য চাহিদা তৈরি করিতে পারিলে ঋণমেলা সার্থক হইতে পারে।
অসাম্য বৃহৎ ও ক্ষুদ্র চাষির মধ্যেও। সরকারি হিসাবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির সংখ্যা বারো কোটি, কিন্তু তাঁহাদের মাত্র পাঁচ কোটি কৃষিঋণ লইয়া থাকেন। ছিয়াশি শতাংশ জমি যাঁহারা চাষ করেন, সেই ক্ষুদ্র চাষিদের ভাগ্যে কৃষিঋণের মাত্র চল্লিশ শতাংশ জুটিতেছে, ইহা ব্যাঙ্ক ও প্রশাসন উভয়েরই ব্যর্থতা। আরও একটি অসাম্য, প্রাণিপালন, মৎস্যচাষ প্রভৃতির প্রতি কৃষিঋণে বঞ্চনা। দুগ্ধ উৎপাদনে ভারত শীর্ষে, দুগ্ধের অর্থমূল্য খাদ্যশস্য ও ডালের সম্মিলিত মূল্যকে বহু পূর্বেই ছাড়াইয়াছে। ২০১৪-১৬ সালে কৃষি উৎপাদনের চল্লিশ শতাংশ দিয়াছে পশুপালন, দুগ্ধ, মৎস্য প্রভৃতি ‘কৃষি-সম্পৃক্ত কার্যকলাপ’ কিন্তু পাইয়াছে কৃষিঋণের মাত্র ছয়-সাত শতাংশ। কৃষিঋণের যথাযথ বণ্টন পুরাতন বঞ্চনা ঘুচাইয়া নূতন সমৃদ্ধি আনিতে পারে। যে কোনও প্রকারে অর্থনীতির শিরা-ধমনীতে রক্ত ঠুসিয়া দেওয়া নহে, সরকার যদি প্রকৃতই লক্ষ্য স্থির করিয়া এ-যাবৎ কাল যাঁহারা ঋণের সুযোগ হইতে বঞ্চিত, তাঁহাদের হাতে ঋণ পৌঁছাইয়া দিতে পারিত, বণ্টনের অসাম্যের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা খানিক হইলেও কমিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy