Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Central Government

ছাঁটাই যেন উদ্দেশ্য না হয়

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০২:২১
Share: Save:

পঞ্চাশ পেরোনো কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মহা দুর্দিন। মুখে না বললেও, সরকার তাঁদের ‘বয়স্ক’ প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। প্রতি তিন মাস অন্তর তাঁদের কাজের মূল্যায়ন হবে। পরীক্ষায় পাশ না করলে তাঁদের জন্য অফিসের দরজা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এক বার পাশ করলেও পরের বারের জন্য দুশ্চিন্তা কিন্তু থেকেই যাবে। ফলে, তাঁরা ছাঁটাইয়ের ছুরির সামনে পড়ে নিজেদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন। আবার, চাপের মুখে পড়ে তাঁদের কাজের পরিসরে আরও গন্ডগোল পাকিয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বয়স যদি শর্ত না হত, তা হলে সবারই মূল্যায়ন হত। পঞ্চাশ পেরোনো কর্মীদেরই শুধু পরীক্ষার কোপে পড়তে হত না।

ভারতের ১৩৮ কোটি জনতার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা হিসেবেই আসে না। কিন্তু, নিজেদের ও পরিবারের কাছে তো তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ। চাকরি হারানোটা সেই সাপেক্ষে চিন্তাজনক সম্ভাবনা। সেই ভয়াবহ সত্যটিকে এই ঘোর কোভিড-কালের আবছায়ায় পরিকল্পিত ভাবে লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। গোলাগুলি আর আত্মহত্যাজনিত গালিগালাজের শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে বহু মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ও দিকে বিএসএনএল, রেল, স্টেট ব্যাঙ্কের মতো অফিসগুলির কর্মী-শূন্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে। কেন্দ্রের এই চাপ রাজ্যগুলিই বা কত কাল সহ্য করতে পারবে?

রাজ্যের তুলনায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীরা বেশি সুবিধা ভোগ করেন বলে অনেকেই মনে করেন। উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে যে সমস্ত লোভনীয় আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সরকারই বছরের পর বছর দিয়ে চলেছে, তার গুনাগারও কম নয়। এর উপর আমাদের জিডিপি এখন আবার অতল জলের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে। কিন্তু, এ সবের দায় কেন সেই সব কর্তব্যনিষ্ঠ, পরিশ্রমী কর্মীকে বহন করতে হবে, যাঁরা আছেন বলেই এই সিস্টেম টিকে আছে? পরীক্ষার আতসকাচের তলায় তো সকলের দাঁড়ানোর কথা। আমরা কি এ আশাও করতে পারি যে, কর্মচারীদের কাজের এই ‘মূল্যায়ন’ যথাযথ ও নিরপেক্ষ ভাবে হবে? কেউ স্বজনপোষণ বা অসদুপায় অবলম্বন করবেন না? কেউ উপরমহলের চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন না? একটি সরকার নিজেকে প্রমাণ করার জন্য কয়েক বছর সময় পায়। তারই নীতি অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী নিজেকে পরিমার্জন করতে পাবেন মাত্র তিন মাস?

আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারকদের বয়স কত? ভারতের জনগণের ৬৫ শতাংশের বয়স পঁয়ত্রিশের নীচে হলেও আমাদের কেন্দ্রীয় আইনসভার মাত্র ১২ শতাংশ যৌবনের প্রতিনিধিত্ব করছেন (বয়স ৪০-এর মধ্যে)। এই দেশের ৫৭ জন মন্ত্রীর গড় বয়স ৬০। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক জনের বয়স ৭৪। সারা বিশ্বের আইনসভাগুলির সদস্যের গড় বয়স কিন্তু ৫৩। ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’র ধ্বজা উড়িয়ে দেওয়া শাসকের চোখে এই তথ্যগুলি পড়ে না?

যে বেতনভুক কর্মচারী ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রত্যহ কাজে অমনোযোগী ও অনিয়মিত হন, নিশ্চয়ই তাঁর পদে থাকার অধিকার নেই। কিন্তু, তাঁকে অযোগ্যতার এবং আলস্যের অভ্যাসে যাঁরা দীর্ঘ প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদের কর্তৃত্বের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না? কর্মচারীদের চরিত্র এবং কৃতিত্ব বিচার যে নিরিখে যাঁরা করবেন, তাঁদের লক্ষ্য ও পদ্ধতি সম্পর্কেও তো আমাদের নিশ্চিত হতে হবে। এই মূল্যায়ন ‘অবসর’কে অবশ্যম্ভাবী করে তোলার জন্য, না কর্মচারীকে তাঁর কর্মদক্ষতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার জন্য, এই প্রশ্নের উত্তরেই নিহিত আছে নীতি-নির্ধারকদের সদিচ্ছার প্রমাণ। সবচেয়ে বড় কথা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া কর্মচারীর শূন্য আসনটি পূর্বের স্থানে বহাল থাকবে কি? তা আবার পূর্ণ হবে কি? দেশের অর্থনীতির করুণ দশার দায়ে সরকারি অফিসের টেবিলগুলিও একে একে বিকিয়ে যাবে না তো? বাতিল হওয়া ব্যক্তিটিই বা যাবেন কোথায়? মধ্যবয়সি কর্মহীন মানুষের পক্ষে বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভ মোটেই সোজা কাজ নয়।

দেশের নীতি-নির্ধারকদের কাজের মূল্যায়নও তিন মাস অন্তর করতে গেলে ব্যাপারটি কেমন দাঁড়াবে? তাঁদের সিদ্ধান্তের ভার আমাদের নিরন্তর বয়ে চলতে হয়। পঞ্চাশ বছর বয়স মন্ত্রিসভায় অনেকেরই হয়েছে। তাঁদের প্রোগ্রেস রিপোর্টে নম্বর লেখার জন্য জিডিপি, করোনা, শিল্পায়ন, কালো টাকা, দারিদ্র, নারী, বেকারের অবস্থা ইত্যাদি অনেক সূচক হাতে নিয়ে অপেক্ষায় আছে দেশ। ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্র সরকারের মূল্যায়নও নিশ্চয়ই করে। কিন্তু তার জন্য সরকারকে আমরা তিন মাস নয়, পাঁচ বছর সময় দিয়ে থাকি।

সব বয়সি কর্মচারীদেরই দক্ষতার মূল্যায়ন হোক, যাতে তাঁরা নিজেদের পরিশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ ও সময় পান। আলস্যকে যাঁরা ‘অধিকার’ বলে মনে করেন, দেশের হাল তাঁদের দুর্বল হাতে সত্যিই মানায় না। এঁদের সতর্ক করা হোক, কাজের জায়গা বদলানো হোক, প্রশিক্ষণ হোক, ব্যয় সঙ্কোচ হোক, অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় বন্ধ করে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানো হোক। কিন্তু দেখতে হবে, ঠান্ডা ঘরে বসে নেওয়া ‘পলিসি’র বাস্তবায়নের খাতিরে প্রৌঢ়ত্বে চাকরি হারানোর অভিশাপ যেন দেশের নির্দোষ নাগরিককে আঘাত না করে।

অন্য বিষয়গুলি:

Central Government Government Employee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy