Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

কিসের ফল

কথাটি বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়া যায়। মুজফ্ফরপুরে যত শিশু মারা গিয়াছে, বা মাত্র দুই বৎসর পূর্বে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে যত শিশু এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত হইয়া মারা গিয়াছিল, সকলেই অতি দরিদ্র পরিবারের।

মৃত শিশুকে জড়িয়ে কান্না মায়ের। ছবি: এএফপি

মৃত শিশুকে জড়িয়ে কান্না মায়ের। ছবি: এএফপি

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

শতাধিক শিশু মৃত। সংখ্যাটি আরও বাড়িবে, আশঙ্কা প্রবল। বিহারের মুজফ্‌ফরপুরে এই মর্মান্তিক ঘটনায় অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছে একটি আপাতনিরীহ ফল: লিচু। কাঁচা বা আধপাকা লিচু খাইয়াই নাকি শিশুগুলি এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত। মতটি অবশ্য মূলত রাজনীতিকদের। চিকিৎসকরা সহমত নহেন। তাঁহারা বলিতেছেন, লিচু নিতান্তই আপাতকারণ, মূল অপরাধী অন্য। লিচুতে এমসিপিজি নামক একটি রাসায়নিক আছে, যাহা চরিত্রে বিষাক্ত। তাহা শরীরে শর্করার মাত্রা বিপজ্জনক ভাবে কমাইয়া দিতে পারে। কিন্তু, তাহা তখনই কার্যকর হয়, যখন যকৃতে গ্লাইকোসিনের পরিমাণ কম থাকে। এবং, গ্লাইকোসিন কম থাকিবার মূল কারণ অপুষ্টি।

কথাটি বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়া যায়। মুজফ্ফরপুরে যত শিশু মারা গিয়াছে, বা মাত্র দুই বৎসর পূর্বে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে যত শিশু এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত হইয়া মারা গিয়াছিল, সকলেই অতি দরিদ্র পরিবারের। বাড়িতে ভরপেট খাবার জোটে না বলিয়াই তাহারা মাঠেঘাটে ঘুরিয়া ফল খাইয়া পেট ভরায়। অবস্থাপন্ন পরিবারের কোনও শিশুর লিচুভক্ষণে মৃত্যুর সংবাদ এখনও মিলে নাই। মুজফ্ফরপুর অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে লিচু চাষ হয়। দরিদ্র শিশুগুলি গাছ হইতে কাঁচা, আধপাকা ফল খাইয়া বাড়ি ফিরে, এবং রাত্রিতে আর কিছু না খাইয়াই ঘুমাইয়া পড়ে। চিকিৎসকদের মতে, অপুষ্ট শরীরে খালি পেটে এমসিপিজি মারাত্মক। তাহা কেটন বা অ্যামিনো অ্যাসিডের ন্যায় নিউরোটক্সিন তৈরি করিতে পারে, যাহা মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। তাহারই ফল এনসেফেলাইটিস। স্পষ্টতই, এই মৃত্যুগুলি আকস্মিক নহে, লিচুর কারণেও নহে— ইহা অপুষ্টিজনিত মৃত্যু। তাহার দায় বর্তায় রাষ্ট্রের উপর। রাজনীতিকরা কেন লিচুকেই দোষী সাব্যস্ত করিতে ব্যস্ত, তাহা বুঝিতে সমস্যা নাই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলিতেছে, পুষ্টির নিরিখে মুজফ্‌ফরপুরের অবস্থা আফ্রিকার বহু দেশের তুলনায় খারাপ। এই অঞ্চলে ছয় মাস হইতে দুই বৎসর বয়সি শিশুদের মাত্র আট শতাংশের যথেষ্ট পুষ্টি জোটে। তাহার ফলে প্রতি দুই জন শিশুর মধ্যে এক জনের উচ্চতা স্বাভাবিকের তুলনায় কম, প্রায় ২০ শতাংশ অস্বাভাবিক রোগা। ৪০ শতাংশের বেশি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম। ৫৬ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতার শিকার। কোনওটির জন্যই লিচু বা অন্য কোনও ফলকে দায়ী করা চলে না। এই দায় একান্তই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তাহার ভবিষ্যতের নাগরিকদের বাঁচিয়া থাকিবার মতো খাদ্যের সংস্থান করিতে পারে না। শিশুমৃত্যুর এই মর্মান্তিক ঘটনাক্রম সেই ব্যর্থতাকেই দেখাইয়া দেয়। আরও একটি ব্যর্থতার দিকে নির্দেশ করা জরুরি। চিকিৎসকদের মতে, অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিনড্রোমে আক্রান্ত হইলেও মৃত্যু অনিবার্য নহে। শরীরে দ্রুত গ্লুকোজ়ের জোগান দিতে পারিলে বহু ক্ষেত্রেই মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু, সেইটুকুও হইয়া উঠে না। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল হইতে হাসপাতালে পৌঁছাইবার পূর্বেই অনেক বিলম্ব হইয়া যায়। যে রাষ্ট্রের প্রধানরা নিয়মিত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটিতে রুমাল পাতিয়া রাখিবার দাবি করেন, সেই রাষ্ট্রের গ্রামে এই সামান্য চিকিৎসা পরিষেবাটুকুও নাই। যদিও বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকে, গ্লুকোজ়ের জোগান থাকে না। আর থাকে না সচেতনতা। জনস্বাস্থ্যের এই প্রাথমিক শর্তটি নির্দ্বিধায় ভুলিয়া থাকে ভারত। গ্রামীণ চিকিৎসকরাই যেখানে জানেন না, দরিদ্র অশিক্ষিত অভিভাবকদের নিকট এই তথ্যটি থাকিবে, তেমন আশা মর্মান্তিক বাহুল্যমাত্র। অতএব আশঙ্কা হয়, শিশুমৃত্যুর মিছিল এইখানেই শেষ হইবে না। আরও বহু প্রাণের মূল্যে ভারত নিজের ব্যর্থতার সহিত পরিচিত হইবে। নেতারা আজ লিচুকে দোষ দিবেন, কাল অন্য কোনও আসামি খুঁজিয়া লইবেন। নিজেদের ব্যর্থতার কথা তাঁহারা স্বীকার করিবেন, এমন আশা ক্ষীণ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy