স্কুলে মিড ডে মিল।
স্কুলের থালায় যে কেহ খাইতে পারে, ফলে উচ্চবর্ণের শিক্ষার্থীরা বাড়ি হইতে থালা লইয়া আসে। মিড-ডে মিল খাইবার থালা। উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ঘটনা জনসমক্ষে আসায় শোরগোল পড়িয়াছে। যে স্কুলগুলিতে ভাগ্যক্রমে এখনও কেহ এমন দৃশ্য ভিডিয়ো করিয়া ইন্টারনেটে ছাড়িয়া দেয় নাই, সেখানেও ছবিটি খুব আলাদা বলিয়া ভাবিতে সাহস হয় না। কারণ, ব্যাধিটি ওই নির্দিষ্ট প্রাথমিক স্কুলটির নহে। এই ব্যাধি ভারতীয় সমাজের। স্কুলের প্রধানশিক্ষক বলিয়াছেন, উচ্চবর্ণের ছাত্রদের বারণ করা সত্ত্বেও তাহারা কথা শোনে না— দলিত ছাত্রের থালায় খাইতে তাহারা সম্মত নহে। প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের আর কতই বা বয়স— এই ঘৃণার শিক্ষাটি তাহাদের কোথায় মিলিতেছে, বুঝিতে সমস্যা নাই। যাবতীয় আদিম কুপ্রবৃত্তির তালিম যেখানে মেলে, সেই পরিবারের পরিসরেই এই ঘৃণা সযত্নে লালিত হয়। মুখে ভাষা ফুটিতে না ফুটিতেই ছেলেমেয়েগুলিকে দেওয়া হয় ঘৃণার প্রাথমিক পাঠ। শিখাইয়া দেওয়া হয়, বর্ণের বা ধর্মের পার্থক্যে মানুষের মধ্যে উচ্চাবচতা সৃষ্টি হয়, এবং সেই বিভেদ রক্ষা করিবার নামই— ধর্ম। গত বৎসর এই উত্তরপ্রদেশেই একটি স্কুলে চড়াও হইয়াছিলেন উচ্চবর্ণের অভিভাবকরা। নির্দিষ্ট রাঁধুনির পরিবর্তে এক দলিত মহিলা রান্না করায় সেই খাবার সন্তানকে খাইতে দিতে অস্বীকার করেন তাঁহারা। শেষ অবধি পুরা খাবার ফেলিয়া দিয়া ঝামেলা মেটান স্কুল কর্তৃপক্ষ। শুধু উত্তরপ্রদেশই কি এই ঘৃণার দোষে দুষ্ট? ভাষা হইতে আঞ্চলিক অবস্থান, এমনকি রাজনীতির চলনেও সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তে থাকা তামিলনাড়ু দিনকয়েক পূর্বেই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়াছে— ভেলোর জেলায় এক দলিতের মৃতদেহ ব্রিজের উপর হইতে দড়ি বাঁধিয়া নীচে নামাইতে বাধ্য হইয়াছিল তাহার পরিবার, কারণ উচ্চবর্ণের লোক শ্মশানে যাওয়ার রাস্তা ছাড়ে নাই। এই ঘৃণার মহামঞ্চের নামই ভারতবর্ষ। তাহার সংবিধান যাহাই বলুক, দেশের স্থপতিদের যে স্বপ্নই থাকুক, সামাজিক পরিসরে এখনও— স্বাধীনতা অর্জনের পর বাহাত্তর বৎসর কাটিয়া যাওয়ার পরও ঘৃণাই এই দেশের অভিজ্ঞান।
পরিবারের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ করা রাষ্ট্রের পক্ষে মুশকিল। অবাঞ্ছিতও বটে। কিন্তু, সামাজিক পরিসরে এই জাতিভেদপ্রসূত ঘৃণার যে কোনও স্থান থাকিতে পারে না, সেই কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলাও রাষ্ট্রেরই কর্তব্য। দলিতদের প্রতি ঐতিহাসিক বঞ্চনার দায় পরিশোধ করিবার জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নহে, প্রতিনিয়ত তাঁহাদের যে সামাজিক ঘৃণার সম্মুখীন হইতে হয়, তাহাকে দমন করাও সেই কর্তব্যের জরুরি অংশ। স্কুলের ক্ষেত্রে যেমন দায়টি প্রাথমিক ভাবে সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকের। তিনি যদি ছাত্রদের স্কুলের থালায় খাইতে বাধ্য না করিতে পারেন, তবে তাঁহার আর প্রধান শিক্ষকের পদে থাকিবার অধিকার থাকে না তো বটেই, দলিতদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তাঁহার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় কি না, তাহা ভাবিয়া দেখিবার। স্কুলের পরিদর্শক, স্কুল শিক্ষা দফতর— দায় সবার উপরেই বর্তায়। অবশ্য, দলিতদের প্রতি এ হেন বৈষম্য, এমন অপমানজনক আচরণ যে গুরুতর অপরাধ, এই কথাটি এখনও অধিকাংশ ভারতীয়ের বোধের অন্তর্গত হয় নাই। ভেলোরের মহকুমা শাসক যেমন বলিয়াছেন, দলিতদের যদি পৃথক শ্মশানের প্রয়োজন থাকে, তাঁহারা বলিলেই পারিতেন— প্রশাসন অবিলম্বে ব্যবস্থা করিত। দলিতদের জন্য আলাদা শ্মশান বানাইয়া দেওয়া যে প্রশাসনের কাজ নহে, বরং যে কোনও শ্মশানে কোনও দলিতের পূর্ণ মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হইবার অধিকারটি রক্ষা করাই তাঁহার কাজ, এই সহজ কথাটি তিনি বোঝেন নাই। শাস্তির ভাষা ভিন্ন আর কোনও পথে কথাগুলি তাঁহাদের বোঝানো যায় বলিয়া বিশ্বাস হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy