ছবি: সংগৃহীত
আমার এক আত্মীয় আটকে পড়েছেন উত্তরবঙ্গে। উত্তর-দক্ষিণের সংযোগকারী একাধিক ট্রেন বাতিল— সেই কারণেই। উত্তরের এক কবি দেখলাম লিখেছেন ফেসবুকে, সহানুভূতি জানাচ্ছেন সবাই, কিন্তু কী করে যে তিনি বাড়ি ফিরবেন জানেন না। শুধু তো এই দু’জন নন। একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন আরও অনেকে। সংবাদপত্রে তাঁদের সে অভিজ্ঞতার ধারাবিবরণীও প্রকাশ পেয়েছে ইতিমধ্যেই, কেউ কেউ জানাচ্ছেন সমাজমাধ্যমে। কেউ হয়তো তেমন ভাবে জানাতেও পারছেন না।
গত কয়েক দিনে শুধু ট্রেনই আক্রান্ত হয়নি। পুড়েছে বাস। রেহাই মেলেনি অ্যাম্বুল্যান্সেরও। আমার নিজেরই দু’দু’টি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া হল না এই বিপর্যয়ের চোটে। কলকাতা সাধারণত যাই সরকারি বাসে। একটি বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানে অংশ নেব বলে টিকিটও কাটা ছিল। কিন্তু সরকারি ডিপোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল বাস চলাচলের কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোন বাস কলকাতা কখন যাবে তার সঠিক খবর পাওয়া যাবে না। ডিপো থেকে বাস ছাড়লেও সে বাস কলকাতা পৌঁছবে কি না, তারও কোনও নিশ্চিত ধারণা দিতে পারলেন না ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা সরকারি বাসের কর্মী। লিলুয়া বইমেলায় অংশ নিতে যাওয়ার কথা ছিল নিজের গাড়িতেই। চালক যেতে রাজি হলেন না কিছুতেই। তাঁর সাফ কথা, “ওদের বিশ্বাস নেই। গাড়ি জ্বালিয়ে দিতে পারে।’’
এতখানি অবিশ্বাসের বাতাবরণেই আজ বেঁচে রয়েছি আমরা। অনেকেই বলছেন যে, এমনটাই তো চাওয়া হয়েছিল। চাওয়া হয়েছিল এই খাণ্ডবদাহন। দেশ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অগ্নিতে পুড়ুক, নেতাদের এই তো ছিল অভিপ্রায়। ভুল কিছু বলছেন না তাঁরা। নাগরিকত্ব আইন দেখিয়ে দিল আজকের ভারতবর্ষের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসলে নৈতিকতা বিবর্জিত ‘মাস্ল পাওয়ার’ বা পেশিশক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু, একই সঙ্গে এ-ও তো সত্য, প্রতিবাদের যে রূপ গত কয়েক দিনে বাংলা দেখেছে, সে রূপে প্রতিবাদ আসলে এক আত্মঘাত। এই হিংসা মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রতি বিরূপ করে তুলতে পারে ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদেরও। প্রতিষ্ঠা দিতে পারে আমার গাড়ির চালকের মনে গেঁথে থাকা ভ্রান্ত ধারণাটিকে। অনেকেই ভাবতে পারেন যে, ‘ওরা’ তো ওই রকমই। যে মুসলিমেরা হিংসার পথে এ লড়াইয়ে জয়ী হবেন মনে করছেন, তাঁদের শুভবুদ্ধি আর চেতনাকেও তাই সন্দেহ করতে ইচ্ছে করে। তাঁরা নাখোদা মসজিদের শান্তির আহ্বানে সাড়া দেন না; মুর্শিদাবাদের ইমামদের শান্তির বার্তাও তাঁদের কর্ণগোচর হয় না। রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তাঁরা স্বখাতসলিলে ডুবতে থাকেন। তাঁদের চিন্তনেই থাকে না যে, তাঁদের কয়েক জনের কৃতকর্মের দায় নিতে হয় একটি পুরো জনসমাজকে, এবং তাতে তাঁদের সেই সমাজেরই ক্ষতি হয়। যত তাঁরা বাসে আগুন দেবেন, ততই তাঁদের ঘরে আগুন লাগানোর সুযোগ পাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দু শক্তি।
আশ্চর্য লাগে এটা ভাবলেও যে, এত বড় বিপদের মুখেও বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ এক সুরে কথা বলতে পারছে না। অনেকেই চুপ। অনেকেই আবার বলছেন, তখন উনি কথা বলেননি, আজ এত কথা কেন? কার সঙ্গে কোন মিছিলে হাঁটব তা নিয়েও আমাদের ছুতমার্গিতা যায় না। ইসু নয়, সঙ্গকেই অধিকাংশ সময় আমরা বড় করে দেখি। সঙ্কটের সময়েও আমাদের অস্পৃশ্যতা কাটে না। সেই নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই এ জিনিস দেখে আসছে এ পোড়া বাংলা। এই লেখক নিজেও তো অনেক সময়েই এই সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে যেতে পারেনি। যা আমরা পারি না, অন্যরা তা পারে। যে আমেরিকাকে দিনরাত গালাগাল না দিলে আমরা অনেকেই অজীর্ণ রোগে ভুগি, সেই আমেরিকা পারে। সমস্ত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে যেতে পারেন সে দেশের লেখক-কবি-শিল্পীরা!
অথচ এই দেশেও যে বুদ্ধিজীবীদের সত্যিই একত্রিত হওয়ার সময় এসে গিয়েছে, সে কথা মনে হল হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো আমার এক ছাত্রের বার্তা পড়ে। সেই ছাত্রটি সমর্থন করছে সিএ আর এনআরসিকে। তার যুক্তিটি খুব সোজা। নেট পাশ করে বসে আছে সে। চাকরি পাচ্ছে না। তার ধারণা, ‘বহিরাগত’ মুসলিমরাই এ দেশে চাকরিসঙ্কটের কারণ। তদুপরি তাদের এক অংশের জন্য আবার রয়েছে সংরক্ষণ। দেশভাগ নিয়ে সে বিচলিত নয়। কথা শুনে মনে হয় না যে, ইসলামকে সে ঘৃণা করে। কিন্তু ভারতবর্ষের বহুস্তরীয় ইতিহাসকে কণামাত্র পাত্তা না দিয়েই সে ভারতীয় মুসলমানকে মনে করে ‘বহিরাগত’। সেই বহিরাগত মুসলমান তার চাকরি পাওয়ার পথে এক প্রতিবন্ধক। ‘সিএ’কে সে দেখছে কেবল তার নিজের রুটি-রুজির সমস্যার প্রেক্ষিতে। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ছাত্রটির বার্তা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যে, নিশ্চয়ই সে একা নয়। এই রকমটা ভাবছেন এ দেশের অনেক বেকার হিন্দু তরুণ-তরুণীই। ঠিক এ ধরনের ভাবনাই তো ট্রাম্পের জয়ের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল আমেরিকায়। ব্রেক্সিটের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল ব্রিটেনে।
ছাত্রটির কথাগুলি ভাবিয়ে তুলেছে আর একটি কারণেও। বামপন্থীরা অনেক সময়েই বলে থাকেন যে, মূল সমস্যাগুলি থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর জন্যই সাম্প্রদায়িকতার তাসটি খেলা হয় এ দেশে। বলে থাকেন, মন্দির-মসজিদ, হিন্দু-মুসলিম জিগির তুলে ভুলিয়ে দেওয়া হয় যে, দেশে চাকরির বড় আকাল।
কিন্তু, এনআরসি আর সিএ নিয়ে যা হচ্ছে তা ঠিক উল্টো নয় তো? ইতিমধ্যেই শোনা গিয়েছে যে, দেশে স্থায়ী চাকরি বলে নাকি আর কিছু থাকবে না। একের পর এক সরকারি সংস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে চাকরির বাজারে, যাতে চাকরি না-পাওয়া এক বিরাট অংশের হিন্দু তরুণ-তরুণী ভাবতে শুরু করেন, যত দোষ নন্দ ঘোষ—তাঁরা যে চাকরি পাচ্ছেন না, তাঁর পিছনে রয়েছে বহিরাগত মুসলিমরাই; ‘ওদের’ সংখ্যা একটু কমলে, বলা যায় না, চাকরি মিলে যেতেও পারে! এমনটা নয় তো যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে, চাকরির বাজারকে ক্রমাগত সঙ্কুচিত করা হচ্ছে এমন ভাবে যাতে যুব সম্প্রদায়ের এক অংশ তাঁদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্যও শেষ পর্যন্ত একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষদেরই দায়ী করতে পারেন? অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি করে তরুণদের এক অংশের মনে চিরকালের জন্য গেঁথে দেওয়া যেতে পারে সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ? নিশ্চিত করা যেতে পারে তাঁদের ভোট? এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গঠনের কুস্বপ্নের দিকে?
যদি এমনটাই হয়, তবে তো আরওই নিশ্চিত যে— ঠান্ডা মাথায় নেওয়া এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লড়াইটা লড়তে হবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কেই। এক জন শিক্ষিত হিন্দু বেকার তরুণ বা তরুণীকে ভাবাতেই হবে কিছু কথা, নিরন্তর বলে যেতে হবে সেই সব কথা। সম্ভব হলে, সংলাপ তৈরি করতে হবে সমানে। বুদ্ধিজীবীরাই পারেন ওই ছাত্রটিকে স্মরণ করিয়ে দিতে, শিকাগো ধর্মমহাসভায় বলা এক ‘হিন্দু’ সন্ন্যাসীর কথা: “আই অ্যাম প্রাউড টু বিলং টু আ নেশন হুইচ হ্যাজ় শেলটার্ড দ্য পার্সিকিউটেড অ্যান্ড দ্য রেফিউজিজ় অব অল রিলিজিয়নস অ্যান্ড অল নেশনস অব দি আর্থ’’— ‘‘আমার ভেবে গর্ব হয় যে আমি সেই দেশের মানুষ, যে দেশ পৃথিবীর সব দেশ, সব ধর্মের অত্যাচারিত ও দেশছাড়া মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে।’’
যাঁরা এ সব জেনেছেন পড়েছেন, তাঁরা ছাড়া কে-ই বা আজ বাকিদের সে কথা বলবেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরাই বিভাজিত থাকলে, এখনও ছুতমার্গে বিশ্বাসী হলে— সমাজ বিভাজিত হবেই। সমাজের বৃহত্তর পরিসরে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে, বুদ্ধিজীবীদের আগে নিজেদের ছোট উঠোনে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy