Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

ফাঁসি দিলেই দায়িত্ব শেষ?

তিহাড়ে বসে আমায় একটা ছেলে বলেছিল, একটা পাঁচ বছরের দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করার সময়ে তার মনে এক বারের জন্যও কোনও দ্বিধা বা অনুতাপ হয়নি।

সীমন্তিনী গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

মেয়েটির মা-বাবা তো চাইবেনই— অপরাধীদের ফাঁসি হোক। তাঁরা যে সব কিছু হারিয়েছেন। কারও মৃত্যু কামনা করা, ঘৃণার এই চরম প্রকাশ, তা তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। কিন্তু তাঁদের সামনে মানসিক শান্তি পাওয়ার জন্য যদি অন্য আর একটি রাস্তা খোলা থাকত, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাঁরা সেই পথটিই বেছে নিতেন।’’

বলছিলেন লেসলি আডউইন। ‘ইন্ডিয়াজ় ডটার’-এর পরিচালক। ২০১২-র এক ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর রাজপথে চলন্ত বাসে ধর্ষিতা নির্ভয়াকে নিয়ে তৈরি করা সেই তথ্যচিত্র এখনও দেখানো নিষিদ্ধ এ দেশে।

রোম থেকে আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লেসলি বললেন সেই ‘অন্য পথ’-এর কথা। যে পথটি, তাঁর ধারণা, মৃত্যুদণ্ডের বিকল্প হিসেবে স্বেচ্ছায় বেছে নিতেন নির্ভয়ার মা-বাবা। কী সেই পথ? লেসলির কথায়, ‘‘এই চার জনকে গত পাঁচ বছর ধরে মৃত্যুর জন্য তিলে তিলে প্রস্তুত করে, তার পরে এক দিন ভোর ছটায় ঘুম থেকে তুলে ফাঁসি কাঠে লটকে দেওয়ার থেকে যদি তাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো যেত যে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে কোনও ফারাক নেই, মেয়েদেরও সম্মান করতে হয়, তা হলে অনেক বেশি কাজ হত। আমি নির্ভয়ার পরিবারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছি। দেখেছি, কী সুন্দর মানুষ তাঁরা। আমার দৃঢ় ধারণা, তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হলে মৃত্যুর বদলে শিক্ষার পথটাই বেছে নিতেন তাঁরা।’’

কথা বলতে বলতে পাঁচ বছর আগের সেই দিনগুলোয় ফিরে গেলেন তিনি। যখন তিহাড় জেলে ধর্ষণে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত একাধিক বন্দির সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। এবং আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে ধর্ষণ ও ধর্ষক সংক্রান্ত সব ধারণা। বললেন, ‘‘আমি ভেবেছিলাম এই দানবগুলোর (নির্ভয়ার ধর্ষকেরা) সঙ্গে কথা বলার সময়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারব না। মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পুলিশ কর্তার কাছ থেকে তাই তিহাড় জেলে বন্দি অন্য ধর্ষকদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চেয়েছিলাম। পেয়েও গিয়েছিলাম। একের পর এক সেই সব ধর্ষকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি যে, সমাজ আমাদের ছোটবেলা থেকে যে-ভাবে লিঙ্গবৈষম্যের পাঠ দেয়, তাতে যে কোনও ধর্ষণের দায়ভার শুধু ধর্ষক নয়, আমাদের উপরেও এসে বর্তায়। রাত্রিবেলা শুধু ‘খারাপ মেয়েরা’ রাস্তায় বেরোয়, ছেলেরা ‘যা খুশি তাই’ করতে পারে, ‘নিচু জাতের’ মানুষের জীবনের কোনও মূল্য নেই— এই সব কথাগুলো শুনতে শুনতেই তো বড় হয়েছে এই ধর্ষকেরা। তিহাড়ে বসে আমায় একটা ছেলে বলেছিল, একটা পাঁচ বছরের দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করার সময়ে তার মনে এক বারের জন্যও কোনও দ্বিধা বা অনুতাপ হয়নি। কারণ সে বিশ্বাস করে যে এক জন দলিতের জীবন সত্যিই মূল্যহীন!’’

এই সব ধর্ষকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে লেসলি শেষ পর্যন্ত যখন নির্ভয়ার ধর্ষকদের মুখোমুখি হলেন, ‘‘তত ক্ষণে আমার একটা ধারণা হয়ে গিয়েছে যে, আমার প্রশ্নের কী ধরনের উত্তর দেবে ওরা। যান্ত্রিক, যেন অনেক আগে থেকে ঠিক করা। তত দিনে সেই সব উত্তর শুনে রেগে যাওয়ার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছি আমি। বুঝে গিয়েছি, এক গভীর ব্যাধি সমাজের পুরো কাঠামোয় ছড়িয়ে পড়েছে।’’

এই ব্যাধি যে শুধু ভারতের নিজস্ব নয়, বরং এর শিকড় ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর সব প্রান্তে, সব পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর মধ্যে, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন লেসলি। ‘‘একের পর এক ঘটে চলা নারকীয় ঘটনার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিভাজনের অভিসন্ধিই লুকিয়ে রয়েছে’’, বলছেন লেসলি। তাঁর মতে, ‘‘ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, তারা সব দিক থেকেই ভাল। তারা যা খুশি তা-ই করতে পারে। অন্য দিকে, ‘ভাল মেয়ে’ বা ‘খারাপ মেয়ে’র তকমা এঁটে দেওয়া হয় মহিলাদের গায়ে। আর যে ‘খারাপ মেয়ে’ তার সঙ্গে ‘যা কিছু তা-ই’ করা চলে।’’

‘‘নির্ভয়ার এক ধর্ষক আমাকে বলেছিল, সে কোনও ভুল কাজ করেনি। নির্ভয়ার অবস্থার জন্য নির্ভয়া নিজেই দায়ী। শুধু তা-ই নয়, নির্ভয়ার সঙ্গে যা যা করা হয়েছিল, তা তাকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য’’, জানালেন লেসলি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরাই তো ছোটবেলা থেকে ছেলেদের এই চিন্তাধারা মাথার ভিতরে ঢুকিয়ে দিই। তার পরে যখন তারা ধর্ষণ করে, হতবাক হই। এটা আমাদেরই দ্বিচারিতা! ঠিক শিক্ষার মাধ্যমে যত ক্ষণ না একদম ছোট্টবেলা থেকে বাচ্চাদের শেখাতে পারব যে লিঙ্গ, বর্ণ, গায়ের রং, ধর্ম, জাত, কোনও কিছুর নিরিখেই মানুষের মধ্যে বিভাজন করা যায় না, যদি তাদের না শেখাতে পারি যে আমরা সবাই মানুষ, আমরা সবাই এক, তা হলে ধর্ষণের মতো ঘটনা কিছুতেই আটকানো যাবে না। না ভারতে। না পৃথিবীর অন্য কোথাও!’’

তাই এনকাউন্টার বা ফাঁসি নয়, সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে চিন্তাধারার বিকাশই ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ কমাতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন লেসলি। মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ‘দায়মুক্ত’ হওয়ার এই প্রবণতাকেই বিপজ্জনক মনে করেন তিনি। ‘‘আমরা যদি মনে করি চারটে লোককে ফাঁসি দিয়ে আমাদের সমাজকে ক্যানসারমুক্ত করব, তা হলে খুবই ভুল ভাবব। ধর্ষণের মতো অত্যন্ত হিংসাত্মক কাজ কোনও অসুখ নয়। অসুখের উপসর্গ মাত্র। লিঙ্গবৈষম্যের ব্যামো যত দিন না আমাদের মন থেকে দূর হচ্ছে, এ সমাজের অসুখও সারবে না!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Rape Nirbhaya Case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy