মৃত্যু নাকি অপার শান্তি লইয়া আসে। তবে, সব মরণ নয় সমান। টাইটানিকের সলিলসমাধি ঘটিয়াছে একশত বৎসরেরও অধিক পূর্বে। কিন্তু সমাধিস্থলটি চিহ্নিত হইবার পর হইতে গুপ্তধনসন্ধানী এবং আমোদপ্রিয় পর্যটকদের যে পরিমাণ দৌরাত্ম্য সহ্য করিতে হইয়াছে, তাহাতে প্রমোদতরণীটির বিধ্বস্ত অবস্থা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডুবিয়া যাওয়া জাহাজ ঘাঁটিয়া অন্তত সাড়ে ছয় হাজার শিল্পসামগ্রী তুলিয়া আনা হইয়াছে। অবশেষে হুঁশ ফিরিয়াছে। অবশিষ্ট চিহ্নটুকুকে বাঁচাইয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হইয়াছে ব্রিটেন এবং আমেরিকার মধ্যে। বলা হইয়াছে, টাইটানিক এবং তাহার দেড় হাজার যাত্রীর সমাধিস্থলটি অতঃপর শ্রদ্ধার সঙ্গে সংরক্ষণ করা হইবে। বন্ধ হইবে, গুপ্তধনসন্ধানী এবং পর্যটকদের আনাগোনা। নিঃসন্দেহে একশত বৎসর পূর্বে ডুবিয়া যাওয়া জাহাজ লইয়া এখনও এমন উন্মত্ত মাতামাতির অন্যতম কারণ অস্কারজয়ী হলিউডের ছবি। একটি প্রমোদতরণী এবং তাহার অকালমৃত্যুকে ঘিরিয়া যে আশ্চর্য প্রেম এবং বিচ্ছেদ যুগপৎ বুনিয়া দেওয়া হইয়াছিল, তাহা জাহাজটির গলিঘুঁজিকেও খ্যাতির অবিশ্বাস্য উচ্চতায় লইয়া যায়। সেই ঘোর দর্শক কাটাইয়া উঠতে পারে নাই। নতুবা টাইটানিকের ন্যায় ট্র্যাজেডি যাত্রী পরিবহণের ইতিহাসে কিছু কম ঘটে নাই। আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজডুবির ঘটনা প্রচুর। প্রায় আড়াই শত যাত্রী লইয়া আস্ত প্লেন হারাইয়া গিয়াছে মহাকাশের বুক হইতে। কিন্তু টাইটানিক যত দিন ধরিয়া আকর্ষণের কেন্দ্রে রহিয়াছে, তাহা তুলনাহীন।
মাতামাতির অন্য কারণটি হইল, অতীতকে বাঁচাইয়া রাখিবার প্রাণপণ চেষ্টা। এই প্রবণতা মনুষ্যকুলের সহজাত। অতীতের যাবতীয় নিদর্শন তাহারা আঁকড়াইয়া রাখিতে চায়। অতঃপর তাহার উপরেই এক মনোরম স্মৃতিসৌধ গড়িয়া শান্তি খুঁজিয়া লয়। এই প্রবণতা বাস্তববোধের পরিচয় দেয় না। যাহা নশ্বর, তাহা কালের নিয়মেই এক দিন বিলুপ্ত হইবে। সেই প্রক্রিয়ায় অহেতুক বাধা দিয়া অতীতকে জীবন্ত করিয়া রাখিবার চেষ্টা তাহার পারিপার্শ্বিক শান্তিকে বিনষ্ট করে। ব্যক্তিই হউক, বা বস্তু— তাহার শান্তি নষ্ট করিবার অধিকার কাহারও নাই। সুতরাং, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ ঘিরিয়া পর্যটনস্থল গড়িয়া তোলা হইতেছে, মানুষ সদলে গিয়া দুর্ভাগ্যমথিত জাহাজটির ভগ্ন দরজা, ক্ষয়প্রাপ্ত রেলিং দেখিয়া আবেগাপ্লুত হইতেছে।
প্রশ্ন উঠিতে পারে, তবে কি ঐতিহ্য সংরক্ষণের কোনও গুরুত্ব নাই? অবশ্যই আছে। কিন্তু ঐতিহ্য সংরক্ষণ করিতে হইলে সর্বদা বিনষ্ট বস্তুর উপস্থিতির প্রয়োজন নাও হইতে পারে। যাহার ইতিমধ্যেই বিনাশ ঘটিয়াছে, তাহার বস্তুগত উপস্থিতি ব্যতীত কি স্মৃতিকে ধরিয়া রাখা যায় না? প্রসঙ্গত, মার্কিন দেশের গ্রাউন্ড জ়িরোর কথা ভাবা যাইতে পারে। নাইন-ইলেভন-এর পর টুইন টাওয়ারের ধ্বংসস্তূপটিকে সেখানে সযত্নে রাখিয়া দেওয়া হয় নাই। বরং গ্রাউন্ড জ়িরো নামে অভিহিত সেই স্থলে ভয়াবহ মুহূর্তটিকে স্মরণ করা হইতেছে জলের ধারায়, শান্তির বার্তায়। স্মৃতিকে স্পর্শ করিতে যদি সর্বদা বস্তুগত উপস্থিতির প্রয়োজন হয়, তবে তো মৃতদেহকেও সংরক্ষণ করিবার ব্যবস্থা করিতে হয়। এই যুক্তিতেই টাইটানিকের ক্ষেত্রে অন্তিমতার সিদ্ধান্তটি কার্যকর করিবার পদক্ষেপকে উল্লেখযোগ্য বলিতে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy