অক্টোবর ২০১৪। নরেন্দ্র মোদী সবে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসেছেন। তখনও অনেক বিষয়েই তাঁর ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে দেশের মানুষ পরিচিত নন। মুম্বইয়ের একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমাদের দেশ এক সময় কী ছিল, তা নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুনিয়ায় আমরা গর্ব করতে পারি।
কী রকম?
দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী সে দিন যুক্তি দিয়েছিলেন, “মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী কর্ণের জন্ম মায়ের গর্ভে হয়নি। এর অর্থ হল সেই সময়েই জেনেটিক সায়েন্স ছিল। সে কারণেই তো কর্ণের জন্ম মায়ের গর্ভ ছাড়াই হয়ে থাকবে।” তাঁর যুক্তির পক্ষে আরও প্রমাণ খাড়া করতে প্রধানমন্ত্রী মোদী সে দিন বলেছিলেন, “আমরা গণেশের পুজো করি। কেউ তো প্লাস্টিক সার্জেন ছিলেন সেই জমানায়, যিনি মানুষের শরীরে হাতির মাথা জুড়ে প্লাস্টিক সার্জারি শুরু করেছিলেন।”
এই ভাবনাচিন্তার সবটাই নরেন্দ্র মোদীর নিজস্ব, তা বোধ হয় নয়। গুজরাতের স্কুলে ‘তেজোময় ভারত’ নামের একটি বই পড়া বাধ্যতামূলক। লেখকের নাম দীনানাথ বাত্রা। সঙ্ঘ-পরিবার বিদ্যা ভারতী নামক যে সংগঠনের ছাতার তলায় রাজ্যে রাজ্যে স্কুল চালায়, বাত্রা ছিলেন তার সাধারণ সম্পাদক। ‘তেজোময় ভারত’-এ বাত্রা লিখেছেন, এ দেশে হাজার হাজার বছর আগেই স্টেম সেলের আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে। তার প্রমাণ হল, মহাভারতে গান্ধারীর থেকে ১০০ জন কৌরবের জন্ম। ‘তেজোময় ভারত’ বইয়ের শুরুতে গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি ছোট বার্তাও ছাপা হয়।
বিজ্ঞানের সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শ জড়িয়ে ফেললে বোধ হয় এমন কাণ্ডই ঘটে। আর বিজ্ঞানের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক চমক দেওয়ার লক্ষ্য জড়িয়ে যায়? তা হলে বোধ হয় সওয়া এক বছরের কাজ পাঁচ সপ্তাহে সেরে ফেলে করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের নির্দেশ জারি হয়।
মার্কিন মুলুকে এখন ঘোর আতঙ্ক ছড়িয়েছে। করোনাভাইরাসের ভয় তো ছিলই। তার সঙ্গে নতুন আতঙ্ক হল, ডোনাল্ড ট্রাম্প বছরের শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই করোনার টিকা বাজারে আনার জন্য সে দেশের এফডিএ বা ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এ চাপ তৈরি করতে পারেন। অতিমারির জরুরি পরিস্থিতি দেখিয়ে তাতে ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হতে পারে। তাতে হিতে বিপরীত হবে কি না, আতঙ্ক সে নিয়েই।
নরেন্দ্র মোদী যদি মহাভারতের যুগের মুনিঋষিদের স্টেম সেল, প্লাস্টিক সার্জারি, জেনেটিক সায়েন্স শুরু করার কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন, তা হলে ট্রাম্প মার্কিন বিজ্ঞানীদের এড্স-এর টিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়ে রেখেছেন। প্রসঙ্গত, কোভিড-এর প্রতিষেধক টিকা যেমন এখনও আবিষ্কার হয়নি, তেমন এইচআইভি-র প্রতিষেধকও এখনও অনাবিষ্কৃত।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামনে না হয় ফের ভোটে জিতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার তাগিদ রয়েছে। কিন্তু এ দেশে হঠাৎ ১৫ অগস্টের মধ্যেই টিকা আবিষ্কারের নির্দেশ জারি করা হল কেন, খাতায়-কলমে এখনও তার ব্যাখ্যা মেলেনি। নিন্দুকেরা বলছেন, এর ব্যাখ্যা একটাই। প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লা থেকে করোনার টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা করে দিয়ে গোটা দুনিয়াকে চমকে দিতে চান। সেই কারণেই আইসিএমআর বা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ হায়দরাবাদের ‘ভারত বায়োটেক’ সংস্থাকে নির্দেশ পাঠিয়েছে, আগামী পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে মানবদেহে পরীক্ষা শেষ করে ১৫ অগস্টের মধ্যে বাজারে টিকা ছাড়তে হবে। কিন্তু কেন ১৫ অগস্ট, তার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
গত বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই আইসিএমআর এই চিঠি পাঠিয়েছিল। তার ঠিক দু’দিন আগে, ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই করোনার টিকাকরণের প্রস্তুতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, স্বাস্থ্যকর্মী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যাঁদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি, তাঁদের আগে টিকা দিতে হবে। তার পরে দেশের যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও মানুষের কাছে যাতে করোনার টিকা পৌঁছে যায়, তার পরিকল্পনা করতে হবে। দেখতে হবে, এই টিকা যেন আমজনতার সাধ্যের মধ্যে থাকে।
অনেকের মনে সে দিনই প্রশ্ন জেগেছিল, এখনও তো টিকাই আবিষ্কার হল না। তার আগেই এত পরিকল্পনা! কবে বাজারে টিকা আসবে, কোনও দেশই এখনও তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এ দেশে তা হলে সাজো-সাজো রব কেন? দু’দিন পরে আইসিএমআর-এর চিঠি দেখে সমালোচকরা প্রশ্ন তুললেন, টিকা আবিষ্কারের কাজও কি লাল কেল্লা থেকে চমকে দেওয়ার চিত্রনাট্য মেনে এগোচ্ছে?
যা কেউ প্রত্যাশা করছেন না, যেখানে তাঁকে কেউ প্রত্যাশা করছেন না, ঠিক সেই কাজটিই করে বা ঠিক সেইখানেই উদয় হয়ে সবাইকে চমকে দিতে নরেন্দ্র মোদী বরাবরই ভালবাসেন। বিজেপি নেতা রাম মাধবের দাবি, এ হল চিনের প্রাচীন সামরিক বিশেষজ্ঞ সুন জু-র মন্ত্র। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সমালোচকরা বলেন, নিছক চমক নয়। মোদীজি আসলে রাজনৈতিক গিমিক পছন্দ করেন।
গিমিকই বলুন বা চমক, তা করতে হলে প্রথা ভাঙতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি মানলে চলে না। কোনটা কার কাজ, সে ভাবলেও চলে না। নরেন্দ্র মোদী যখন আফগানিস্তান থেকে ফেরার পথে আচমকাই পাকিস্তানে গিয়ে নওয়াজ শরিফের প্রাসাদে হাজির হয়েছিলেন, তখনও তিনি কূটনৈতিক রীতি-নীতির তোয়াক্কা করেননি। তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তখন দিল্লিতে। তাঁর বদলে মোদী নিজেই পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
আবার নোট বাতিলের সময়ও একই কাণ্ড। অর্থমন্ত্রীর বদলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই কালো টাকা দূর করার ভার নিলেন। সে সময় তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বা সরকারের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন আগেভাগে নোট বাতিলের পরিকল্পনার বিন্দুবিসর্গ জানতেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি।
এ সবের মধ্যে চমক হয়তো ছিল। কিন্তু আচমকা পাকিস্তানে গিয়ে বা নোট বাতিল করে কোনও লাভ হয়েছে কি না, বা তার আদৌ দরকার ছিল কি না, সে প্রশ্নের উত্তরও মেলেনি।
এ বার যেমন লাদাখে আচমকাই আবির্ভূত হয়ে ফের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গোটা দেশকে চমকে দিলেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের যাওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ জানা গেল, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লাদাখে যাচ্ছেন না। তাঁর বদলে আচমকাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লাদাখে উদয় হলেন। গোটা দেশ মুগ্ধ নয়নে দেখল, পিছনে শ্লেট রঙের পাহাড়। সামনে সাদা শার্টের উপরে ধূসর রঙের জ্যাকেটে প্রধানমন্ত্রী পা ফেলছেন। জওয়ানদের মনোবল বাড়াতে সেনার টুপি পরে, জলপাই রঙের পোশাকে, চোখে সানগ্লাস পরে আবেগঘন বক্তৃতা দিলেন।
কিন্তু এ বারেও কাঁচা হাতে লেখা ফাঁক থেকে গেল। সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ভারতের এলাকায় কেউ ঢোকেনি বলার পরে তা চিত্রনাট্য থেকে বাদ দিতে হয়েছিল। লাদাখের চিত্রনাট্যেও ফাঁক থেকে গেল। প্রধানমন্ত্রী নীমু-র সেনা শিবিরে যাওয়ার পরে দাবি করা হল, তিনি সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় চলে গিয়েছেন। তার পরে দেখা গেল, যেখানে চিনের সঙ্গে ভারতের সেনার বিবাদ চলছে, সেখান থেকে তিনি শ’দুয়েক কিলোমিটার দূরে।
তবে দেশের মানুষ এখনও নরেন্দ্র মোদীর উপরে আস্থা রাখেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, প্রধানমন্ত্রী লাদাখ গিয়েছেন সেনার মনোবল বাড়াতে। চিনকে লাল চোখ দেখাতে। তাতে নিজের প্রচার হলে হয়েছে। তাতে কিছু যায় আসে না। একই ভাবে প্রধানমন্ত্রীর লাল কেল্লা থেকে টিকা আবিষ্কার ঘোষণার জন্যই যদি তাড়াহুড়ো করে মানবদেহে পরীক্ষার নির্দেশ জারি হয়ে থাকে, তা হলেও দেশের মানুষ মনে করছেন, মোদী দ্রুত করোনাভাইরাসকে দেশছাড়া করবেন বলেই এমন নির্দেশ দিয়েছেন। তাতে ফল মিলতে না-ও পারে। হিতে বিপরীতও হতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা নিয়ে দেশের মানুষের মনে কোনও প্রশ্ন নেই। বরং এই নিয়েই দেশ এখন মাতোয়ারা। এর নাম মোদী-ম্যাজিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy