আমাদের হতেই হবে আত্মনির্ভর, নইলে চলবে না।— বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে তার ক’দিন আগে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সদস্যদের তার ও পেরেক জড়ানো ডান্ডার বাড়িতে ভারতীয় সেনার ২০টি তরতাজা প্রাণ লুটিয়ে পড়েছে খাদের অনেক নীচে তুষার-গলা গালওয়ান নদীতে।
চিনারা এসেছে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। সেই ১৯৬২ সালে তারা লাদাখে যত দূর এসেছিল, এ বার সেখানেই চায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা টানতে। ভারতকে তারা সম্ভবত শিক্ষাও দিতে চায়, যাতে সে আমেরিকা-অনুপ্রাণিত চিন-বিরোধী চতুষ্কোণ ‘কোয়াড’-এর (অস্ট্রেলিয়া, জাপান, আমেরিকা ও ভারত) অন্তঃপুরে জড়িয়ে না পড়ে। মোদীর পূর্বে ভারতের সব নেতাই আমেরিকার সঙ্গে সখ্য রেখেই চিন সম্পর্কে লক্ষ্মণরেখাটিকে সম্ভ্রম করেছেন। কিন্তু চিনের হয়তো মোদী ও ট্রাম্পের ওই সতর্করেখাটি অগ্রাহ্য করার বাসনাই প্রবল মনে হয়েছে।
আর, চিনের একমেবাদ্বিতীয়ম্ নেতা শি চিনফিংয়ের নিশ্চয়ই ধারণা হয়েছিল যে ভারতের অর্থনীতি এতই বেহাল যে তার প্রলম্বিত যুদ্ধের ভার বহনের শক্তি নেই। ২০১৬ থেকে মোদী সরকারের একের পর এক ভুল আর্থিক নীতির জন্য অভ্যন্তরীণ চাহিদা ঠেকেছিল তলানিতে, বেকারি ৯.২১ শতাংশে। এর পর কোভিড-১৯ ছোবল মারতেই প্রায় এক-চতুর্থাংশ কর্মক্ষম (২৩.৫%) মানুষ হল কর্মহীন। ও দিকে ট্রাম্পের মতো বিতর্কিত প্রেসিডেন্টের নির্বাচনের বছরে আমেরিকা যে মোদীর খাতিরে চিনের সঙ্গে সামরিক টেক্কায় নামবে না, তা অবশ্যই ছিল শি-এর বিশ্বাস। মার্কিন রাজনীতির অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাসও মোটামুটি তাই।
তবে প্রধানমন্ত্রীর দেশকে ‘আত্মনির্ভর’ হতে উপদেশ দেওয়াটাও নিতান্ত কথার কথা নয়। আগে দেখা যাক, ‘আত্মনির্ভর দেশ’ মানে কী। তারা কি সব সুখী দেশ? উনিশ শতকের শুরুতে হল্যান্ড থেকে লন্ডনে আগত বুদ্ধিমান ইহুদি স্টকব্রোকার ডেভিড রিকার্ডো অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি-সম্পন্ন প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। তার একটির বক্তব্য বৈপ্লবিক। তাঁর মতে (তখন, নেপোলিয়নিক যুদ্ধের অবসানে) দেশের সম্পদ বৃদ্ধি হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে, অন্য দেশের সঙ্গে বিনিময় বাড়িয়ে; অন্ধের মতো উৎপাদন বাড়িয়ে গেলেই নয়। ফলে নেহাত আত্মনির্ভর হওয়াটাই কোনও দেশের পক্ষে সম্পন্ন জীবনের চাবিকাঠি নয়।
ভারী সুন্দর উদাহরণ দিয়েছিলেন রিকার্ডো ইংল্যান্ড ও পর্তুগালের তুলনা ব্যবহার করে। সূর্যস্নাত পর্তুগালে ওয়াইন তো উপাদেয় হবেই। ও দিকে ইংল্যান্ডের মেঘে মোড়া আবহাওয়ায় কারখানায় বসে কাপড় বোনা নিশ্চয় তেমন পরিশ্রমসাধ্য নয়। কম্পারেটিভ অ্যাডভান্টেজ কথাটি প্রবর্তন করেন রিকার্ডোই। ইংল্যান্ডের তুলনামূলক সুবিধা বস্ত্র উৎপাদনে, ফলে সে যেন মদ্য প্রস্তুত করতে বেশি উদ্যোগ না করে। অবশ্যই সে পর্তুগাল থেকে কিনতে পারে চমৎকার পোর্ট। তেমনই, পর্তুগাল তার বস্ত্রের প্রয়োজন মেটাতে পারে ইংল্যান্ড থেকে। স্টক বাজার থেকে রিকার্ডো লাভ ভালই করেছিলেন। সেই বিত্ত দিয়ে তখনকার চালে তিনি পার্লামেন্টে একটি আসন কেনেন। বেশি দিন তিনি বাঁচেননি, কিন্তু ওই অল্প কয়েক বছরেই খুব লড়াই করেন ‘কর্ন ল’ বাতিল করবার জন্য। এই আইনের সুবাদে ব্রিটিশ ভূস্বামীরা আমেরিকা থেকে তার বিপুল শস্যভান্ডারের সোনার তরী ভিড়তে দিত না ব্রিটেনের তীরে। পাছে তাদের নিজেদের শস্যের মূল্য হ্রাস পায়। রিকার্ডো ছিলেন মুক্ত বাণিজ্যের প্রথম যুগের এক জোরালো সমর্থক।
রিকার্ডোর এই তত্ত্বই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যায় বিশ্ববাণিজ্যকে। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে মোট বাণিজ্যের সঙ্গে মোট গড় জাতীয় উৎপাদনের অনুপাত ছিল মোটে ১০ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনীতি ছিল ঘরকুনো। নাকি ‘আত্মনির্ভর’! তখন বড়জোর একশো পাউন্ড হাতে নিয়ে বিলেত যেতে হত। এত মহার্ঘ ছিল স্কচ হুইস্কি যে শুধু সেই প্রসাদ বিতরণ করেই কিছু বিদেশি রাজদূত আমাদের উচ্চপদস্থ জেনারেলদের কাছ থেকে বার করে নিতেন সেনাবাহিনীর ভিতরের খবর। ২০১৭ সালে কিন্তু জাতীয় উৎপাদন বনাম বাণিজ্য অনুপাতটি ছ’গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬২। এই সাত দশকে চরম দরিদ্রের অনুপাত নেমে আসে ৭২ শতাংশ থেকে দশে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা যে উন্মুক্ত বাণিজ্যনীতির প্রবর্তক তার জেরেই মনুষ্যকুল আলো দেখেছে টানেলের শেষে।
মোদী কি মুক্ত বাণিজ্যের ভাবধারাটিই উল্টে দিতে চাইছেন? তা হয়তো নয়, তাঁর শাসনকালে ভারতকে বাণিজ্যবিমুখ বলে মনে হয়নি। জাতীয় উৎপাদনে আমদানি ও রফতানির অংশটি মোদীর ক্ষমতায় আগমনের আগের পাঁচ বছর যা ছিল তার থেকে কমেওনি বাড়েওনি। এ কথা ঠিক যে ভারত বহির্বাণিজ্যে কোনও দিনই প্রতিযোগিতায় সক্ষম ছিল না। তবে ১৯৯১ সালের সংস্কারের পর থেকে কখনওই সে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের রাস্তায় হাঁটেনি।
এ বার কিন্তু আত্মনির্ভরতার পোঁ ধরবার কারণটি সম্পূর্ণ অন্য। চিনের সঙ্গে সম্পর্কের দ্রুত অবনতির সঙ্গে সঙ্গেই ভারত-চিন বাণিজ্যের কতকগুলি উলঙ্গ সত্য সামনে ভেসে আসে। প্রথমটি হল, চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি, ২০১৭-১৮ সালে যা উঠেছিল সাংঘাতিক পর্যায়ে, ৬৩ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৮-১৯ সালে আমদানি সঙ্কুচিত হয়েছে। তবুও ঘাটতি ৪৮.৬৬ বিলিয়ন ডলার।
কিন্তু এই ঘাটতির খেসারত শুধু অর্থমূল্য দিয়ে বিচার করা যায় না। আসল বিপদের কারণ, আধুনিক পৃথিবীতে নিজস্ব পথে এগোতে হলে কয়েকটি সামগ্রীর বিশেষ প্রয়োজন, যার উৎপাদন চিন প্রায় কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এ সব শিল্পে ভারত প্রায় ‘চিননির্ভর’। প্রথমেই উল্লেখ্য ওষুধপত্র। ভারতে যে সব ওষুধ বিক্রি হয় তাতে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ লেখা থাকলেও তার মূল রাসায়নিকটির (এপিআই) প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানি হচ্ছে চিন থেকে। নিত্যব্যবহার্য ও জীবনদায়ী ওষুধের ভিতরের রাসায়নিকটির জন্য চিনের উপর নির্ভরতা যে জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক, তা কয়েক বছর আগে মনে করিয়ে দেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। কাশির সিরাপ থেকে দামি অ্যান্টিবায়োটিক্স, সব দোকান থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাবে যে মুহূর্তে বন্ধ হবে চিনের এপিআই জোগান।
বর্তমান ও আগামী দিনে আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী যার বড় অংশ চিনের করায়ত্ত হয়ে গিয়েছে, তা হল লিথিয়াম, যে ধাতু দিয়ে তৈরি হয় লিথিয়াম-আয়ন বা লি-আয়ন ব্যাটারি। অসম্ভব হালকা ও বহু ক্ষণ বিদ্যুৎ ধরে রাখতে সক্ষম, আধুনিক জীবনে অপরিহার্য এই দ্রব্যটির ব্যবহার সর্বপ্লাবী। যে ল্যাপটপে এই লেখাটি লিখছি; যে কম্পিউটারে শুধু সাধারণ হিসেব নয়, বিশ্লেষণ করা হয় অজস্র তথ্য; যে মোবাইলটি ফোন সকলের নিত্যসঙ্গী; যে লক্ষ লক্ষ দু’চাকা ও চারচাকার গাড়ি যারা পেট্রল বা ডিজেল ছেড়ে চলতে শুরু করেছে (বা করবে) ব্যাটারিতে সঞ্চিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। কী নয়?
চিনে আছে লিথিয়াম ভান্ডার। ২০১৯ সালের হিসেবে, পৃথিবীর মোট লি-আয়ন ব্যাটারি উৎপাদনের ৭৩ শতাংশ চিনেই। আমেরিকায় মাত্র ১২ শতাংশ। ভারত অবশ্য বছরখানেক হল লিথিয়াম-সমৃদ্ধ অন্য দেশগুলিতে উঁকি দিচ্ছে, কিন্তু এ দেশের বাজার চিনা লিথিয়াম ব্যাটারিতে ঠাসা।
একই অবস্থা সৌরবিদ্যুৎ, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারের। ভারতে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন এখন ৩৭,৬৩০ মেগাওয়াট। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী দু’বছরে তা দাঁড়াবে ১০০,০০০ মেগাওয়াটে। কিন্তু দেশের সৌর প্যানেলগুলি প্রায় সম্পূর্ণ চিনে নির্মিত। মোবাইল ও কম্পিউটারের প্রাণভোমরা হচ্ছে তার চিপ, যা অতি উন্নত উপায়ে পরিশোধিত সিলিকনের চতুষ্কোণের উপর বসানো একটি ক্ষুদ্র ইনটিগ্রেটেড সার্কিট। ওই চিপই হল আধুনিক যুগের মস্তিষ্ক, যে ঠিক করে দেয় শুধু লেখার বানান ও শৈলীই নয়, রকেটের কক্ষপথও। চিন তৈরি করে পৃথিবীর ১৬ শতাংশ চিপ, কিন্তু সস্তায় উৎপাদনে তার সঙ্গে টেক্কা দেওয়া শক্ত। সেই জন্যই ভারতের আনাচেকানাচে চিনা মোবাইলের ছড়াছড়ি। চিপ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন বিপুল মূলধন ও উন্নত প্রযুক্তি। সে ক্ষেত্রে আমরা চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও জাপানের ‘গরিব প্রতিবেশী’। এ সব দেশের (বিশেষত চিনের) প্রযুক্তিগত জ্ঞান, বা কর্মীদের দক্ষতা, যে ভারতের চেয়ে বেশি তা নয়। কিন্তু তারা নানা ক্ষেত্রে সফল, কারণ শুধু নিজের দেশের প্রয়োজন মেটাতে উৎপাদন না করে তারা করে পৃথিবীর জন্য। সেখানে পদে পদে প্রতিযোগিতা ও নিত্যনতুন পদ্ধতির আবিষ্কার। এ ভাবে আসে ইকনমি অব স্কেল, অর্থাৎ বেশি লুচি ভাজলে লুচি প্রতি খরচ হবে কম। এই পদ্ধতিতেই চিন অধিকার করেছে পৃথিবীর বাজার।
আর ইতিমধ্যে, আমরা নিজের গলির বাইরে খদ্দের খুঁজে না পেয়ে হয়ে গিয়েছি চিননির্ভর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy