২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মনরেগা-কে ‘ব্যর্থতার জীবন্ত স্মারক’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ফাইল চিত্র।
গত দু মাস ধরে সংবাদমাধ্যমে নানা রকম ইস্যু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। করোনায় কতজন আক্রান্ত, কত টেস্ট হল, জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো, রেলের অব্যবস্থা, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা—এই সমস্ত বিষয় নিয়ে সরগরম সব মহল। কিন্তু যে বিষয় নিয়ে কোনও শিরোনাম হয়তো আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে, তা হল মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি অ্যাক্ট বা মনরেগা।
যে প্রধানমন্ত্রী এক সময় মনরেগা-কে ‘গর্ত খোঁড়ার’ প্রকল্প হিসাবে লঘু করেছিলেন, তিনিই আজ দুর্দশাগ্রস্ত গ্রামের মানুষগুলোকে বাঁচানোর জন্য এই প্রকল্পের উপর ভরসা রাখছেন। দেরিতে হলেও ওঁর সুবুদ্ধি হয়েছে। এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি। মনরেগা সম্ভবত বিশ্বের বৃহত্তম সমাজ কল্যাণমূলক কর্মসূচি। প্রায় ১২ কোটি মানুষ এই প্রকল্পে উপকৃত হয়েছেন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন বেকারত্বের হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ, করোনার ফলে যখন অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে, তখন মনরেগা-র গুরুত্ব যে বাড়তে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
নিজের গ্রামে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকরা মনরেগা-র অধীনে কাজ চাইছেন। চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে ৩৫ লক্ষ নতুন কর্মী মনরেগা-র অধীনে নাম নথিভুক্ত করেছেন। গত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা অনেকাংশেই বেশি। পরিস্থিতি যে কতটা গম্ভীর, তা বোঝাই যাচ্ছে।
কোভিড -১৯ সংকটের আগে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মনরেগা-কে শেষ করে ফেলার চেষ্টা করেছিল। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী এটিকে ‘ব্যর্থতার জীবন্ত স্মারক’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ২০১৯-‘২০ এবং ২০২০-‘২১ উভয় বাজেটেই আগের বছরের প্রকৃত ব্যয়ের তুলনায় মনরেগা-র বরাদ্দ কম করা হয়েছে।
যে কাজগুলো মনরেগা-র শ্রমিকরা করতে পারেন, সেগুলি যন্ত্র দ্বারা করা বা মনরেগা-র মজুরি হিসেবে রাজ্য সরকারের পাওনা না মেটানো— এই রকম বহু পদক্ষেপের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার এই প্ৰকল্পকে অর্থহীন করে তুলতে চাইছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবর্ষে, মনরেগায় বরাদ্দ অর্থের ৯৫ শতাংশ অর্থ জানুয়ারি মাসের মধ্যেই খরচ করা হয়ে গিয়েছে, দু'মাস বাকি থাকতেই। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক অতিরিক্ত ২০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
প্রত্যেক শ্রমিক যাতে পুরো ১০০ দিনের কাজ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এই অতিমারির সময় এটি আবশ্যিক। প্রতীকী ছবি।
এখন হঠাৎ করে নরেন্দ্র মোদী সরকার ইউ-টার্ন করেছে। দাবি করা হচ্ছে যে, তারাই মনরেগা-কে মানুষের উপযোগী করে তুলেছে। তবে পরিসংখ্যানের মধ্যে অনেক তথ্য লুকিয়ে থাকে। তিনটি উদাহরণ দিচ্ছি:
** মার্চ মাসে, ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ২০ টাকা বাড়িয়ে ২০২ টাকা করা হয়েছে। যা ৩১ টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ন্যূনতম দৈনিক মজুরির চেয়ে কম।
** কেন্দ্রের দাবি, বার্ষিক পারিবারিক আয় বৃদ্ধি হয়েছে ২০০০ টাকা। এই গণনাটি করার সময় ১০০ দিনের কাজকে ধরা হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবে গত কয়েক বছরে মনরেগা-য় মাত্র ৪০-৫০ দিনের কর্মসংস্থান তৈরী হয়েছে।
** মনরেগা-র জন্য অর্থমন্ত্রী অতিরিক্ত ৪০,০০০ কোটি টাকা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে ১১,৫০০ কোটি টাকা পূর্বের বকেয়ার জন্য। বাকি অর্থের সাহায্যে কেন্দ্র ৩০০ কোটি কর্মদিবস সৃষ্টি করার কথা বলছে। কিন্তু, ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে মনরেগা-য় কর্মসংস্থান ২০১৯ সালে একই সময়কালের তুলনায় অর্ধেকেরও কম ছিল।
আরও পড়ুন: টুইটারে কেউ এ সব প্রশ্ন করে? লাদাখ নিয়ে মোদীকে বেঁধায় রাহুলের সমালোচনা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর
এই ধরনের লোক দেখানো চটকদারি হতাশাজনক। রূঢ় বাস্তব হল, আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিকরা জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে দাঁড়িয়ে। জাতীয় স্বার্থের কথা ভেবে রাজ্য এবং কেন্দ্রর এক সঙ্গে কাজ করা উচিত এবং বিরোধী দল হিসেবে আমাদের অবশ্যই গঠনমূলক পরামর্শ দিতে হবে। ১০০ দিনের কাজের ক্ষেত্রে, বিজেপি সরকারের উচিত চতুর্মুখী পন্থা অবলম্বন করা।
এক: প্রত্যেক শ্রমিক যাতে পুরো ১০০ দিনের কাজ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এই অতিমারীর সময় এটি আবশ্যিক।
দুই: কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী মজুরী নিয়মিত সংশোধন করতে হবে। এখন মনরেগা-য় ন্যূনতম মজুরি হল ২০২ টাকা, যা দেশে একজন অনভিজ্ঞ শ্রমিকের মজুরির চেয়ে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ কম। ২০১৯ সালে এক বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই মজুরি দৈনিক ৩৭৫ টাকা করতে হবে।
তিন: মনরেগা আইন অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে মজুরি প্রদান করতে হবে। তা কিন্তু কখনই হয় না। এই নিয়ম কঠোরভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে।
চার: বেকার ভাতার সময়কাল ১৫ দিনের থেকে বাড়াতে হবে যাতে রাজ্যগুলি এবং মজদুরদের পক্ষে কিছুটা স্বস্তি হয়। রাজ্যগুলির আর্থিক চাপ কমাতে কেন্দ্রের উচিত কাঁচা মালের দাম বহন করা। এখন দর-কষাকষির সময় নয়।
বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস সরকার মনরেগা প্রকল্পের ব্যবহার ও কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রথম থেকেই মনোযোগী। বিগত তিন বছর ধরে বাংলা এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য প্রথম পুরস্কার জিতে আসছে। ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, অর্থাৎ যে সময় তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আছে, এই প্রকল্পে খরচ ২০০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। বার্ষিক কর্মদিবস ১৫ কোটি থেকে বেড়ে ৩০ কোটি হয়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের হিসাব অনুযায়ী কর্মদিবস তৈরির ক্ষেত্রে দেশের তিনটি সেরা রাজ্যের মধ্যে পড়ছে বাংলা।
নিয়তির কী পরিহাস! ২০১৯ সালে একদিকে যখন মহাত্মা গাঁধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হল, তখন তাঁরই নামে নামাঙ্কিত কর্মসংস্থান প্রকল্পের ভবিষ্যৎ হাওয়ায় ঝুলে আছে। গাঁধীজি একবার বলেছিলেন, “দারিদ্র হিংসার সবচেয়ে খারাপ রূপ।“ আর এখন যা অবস্থা, তাতে কোভিড-পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ ভারতবর্ষে হিংস্রতা ও দুর্দশা রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে মনরেগা প্রকল্প। কেন্দ্রীয় সরকার যেন সেটা মনে রাখে।
( রাজ্যসভার তৃণমূল দলনেতা)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy