Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
তা হলে মতাদর্শ বাদ?
BJP

দল বদলে আসা নেতাদের জন্য বিজেপিতে দরজা খোলা, উঁচু পদ

অন্য দলের কেউ বিজেপিতে এসে রাতারাতি মন্ত্রী-সান্ত্রি হয়ে গেলে একটা কথা বোঝাই যায়, তা হল: বিজেপিতে সত্যিই দক্ষ প্রশাসক, অভিজ্ঞ সাংসদ-বিধায়কের অভাব আছে।

অর্গলহীন: রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও দলে নবাগত রাজ্য জনাধিকার সুরক্ষা পার্টির সভাপতি, কলকাতা, ২১ নভেম্বর। পিটিআই

অর্গলহীন: রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও দলে নবাগত রাজ্য জনাধিকার সুরক্ষা পার্টির সভাপতি, কলকাতা, ২১ নভেম্বর। পিটিআই

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২০ ০১:১৩
Share: Save:

হাল্লার রাজা হলে জানতে চাইতেন, নেতা কি কম পড়িয়াছে? গত কয়েক দিনে শুভেন্দু অধিকারীকে দলে টানতে বিজেপি নেতাদের উৎসাহ দেখলে এমন কথাই মনে হয়। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলছেন, অন্য দলে কারও দমবন্ধ লাগলেই শ্বাস নিতে বিজেপিতে চলে আসুন। বিজেপি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলছেন, শুভেন্দুর দল ছাড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা!

২০২১-এর বিধানসভা ভোটের আগে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসে ভাঙন ধরলে যে বিজেপির লাভ, বলা বাহুল্য। কিন্তু তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ নেতারা দল ছাড়ার আগেই বিজেপি যে ভাবে তাঁদের বরণ করে ঘরে তুলতে তৈরি, তাতে প্রশ্নটা উঠতে বাধ্য। বিজেপি দলে কি নেতা কম পড়ছে? না কি বিজেপি এখন আর মতাদর্শের বাছবিচার করে না? ক্ষমতা দখলটাই আসল মতাদর্শ?

ভারতীয় জনতা পার্টি বরাবরই নিজেকে ‘পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স’ বলে দাবি করতে ভালবাসে। দলের সুস্পষ্ট মতাদর্শ রয়েছে। ক্যাডার ভিত্তিক পার্টি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আঁতুড়ঘরে যত্ন সহকারে বিজেপি নেতাদের গড়ে তোলা হয়। তা হলে সেই বিজেপি কী ভাবে রাম-শ্যাম-যদু-মধুর জন্য দরজা খুলে দেয়? এক দিকে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’, ‘বাংলা থেকে তৃণমূল হটাও’-এর স্লোগান তোলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেই কংগ্রেস বা তৃণমূলের নেতাদেরই দলে টানেন?

উত্তর একটাই। গোটা দেশে ডালপালা ছড়ানোর জন্য। কংগ্রেস তার আদি পর্বে ঠিক এই কৌশলই নিয়েছিল। স্বাধীনতার আগেই কংগ্রেসের দরজা জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। গাঁধী-নেহরুর মতো স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃৎদের হাতে দলের রাশ ছিল। কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে ভাবধারা, ধর্মনিরপেক্ষতার বাছবিচার হয়নি। স্বাধীনতার পরে নেহরু প্রাক্তন মহারাজাদের দলে টানতে উদ্যোগী হন। সমাজের এই প্রভাবশালী অংশকে দলে টানার সঙ্গে তাঁদের অনুগামীদের ‘ভোটব্যাঙ্ক’-ও কংগ্রেসের ঝুলিতে ঢোকে। তাঁদের পরের প্রজন্মই এখনও কংগ্রেসে ছড়ি ঘোরাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী কংগ্রেসি নেতাদের ‘নামদার’ বলে কটাক্ষ করেন। জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতারা মনে করতেন, কোনও নীতি ছাড়া ‘নামদার’-দের জড়ো করে তৈরি কংগ্রেস এক দিন টুকরো হয়ে যাবে। এই সব নামদার-রা স্রেফ ক্ষমতার লোভে কংগ্রেসে নাম লিখিয়েছেন। ক্ষমতা গেলে তাঁরাও বিদায় নেবেন। তাঁরা ভুল ভাবতেন না। কিন্তু কী আশ্চর্য! মোদী-শাহের জমানায় বিজেপি সেই নামদারদেরই দলে টানছে! ২০১৪-র মোদী-ঝড়ের আভাস মিলতেই কংগ্রেসের নেতারা বিজেপির দিকে পা বাড়াতে শুরু করেছিলেন। গত ৬-৭ বছরে রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের প্রাক্তনীরাই বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে উঠেছেন। সেই সুবাদে এত দিন যে সব রাজ্যে বিজেপির পদ্ম ফোটেনি, সেখানেও বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। উত্তর-পূর্বের অরুণাচলপ্রদেশ, মণিপুরে কংগ্রেসের প্রাক্তনীরাই বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। আঞ্চলিক দলের ওজনদার নেতারাও বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। সেখানে কে নামদার, কে বংশপরম্পরায় ক্ষমতায়, কার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ— তার চুলচেরা বিচার হয়নি। গ্বালিয়রের রাজা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া থেকে ‘ভাগ মুকুল ভাগ’-খ্যাত মুকুল রায়ের জন্য বিজেপির দুয়ার খোলা থেকেছে।

আর মতাদর্শ? গত মার্চের কথা। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার হাত ধরে মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেসের বিধায়করা সবে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের হাতে হাতে বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি কুশাভাউ ঠাকরের জীবনী ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অবদানও আত্মস্থ করতে হবে। নতুন দলের মতাদর্শ মগজে ঢোকাতে হবে। যাকে বলে ‘মগজ ধোলাই’। মুকুল রায়, সব্যসাচী দত্ত, অর্জুন সিংহদেরও কি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে আসার পরে দীনদয়াল-শ্যামাপ্রসাদের জীবনচরিত পড়তে হয়েছিল? উত্তর তাঁরাই জানেন। ভবিষ্যতে শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দিয়ে দীনদয়ালের বাণী মুখস্থ করবেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর সময়ই বলবে।

তবে গত কয়েক বছরে কংগ্রেস বা অন্য দলের নেতারা দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বিজেপির সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ থেকেছে আরএসএসের আঁতুড়ঘরে বেড়ে ওঠা প্রচারকদের হাতেই। দলে বেনো জল ঢুকলেও আরএসএসের হাতেই বিজেপির রাশ থেকেছে।

ক্রমশ সেই ছবিও কি বদলাচ্ছে? অমিত শাহের পরে বিজেপি সভাপতির গদিতে বসার পরে জে পি নড্ডা কিছু দিন আগেই সাংগঠনিক রদবদল করে তাঁর নতুন টিম ঘোষণা করেছেন। বারো জন জাতীয় সহ-সভাপতির মধ্যে অন্তত পাঁচ জন অন্য দল ছেড়ে এসেছেন। তৃণমূল ছেড়ে আসা মুকুল রায়ের সহ-সভাপতির পদপ্রাপ্তির কথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জানেন। ওড়িশার বিজু জনতা দল ছেড়ে আসা বৈজয়ন্ত পণ্ডা, ঝাড়খণ্ডে আরজেডি ছেড়ে আসা অন্নপূর্ণা দেবী, কেরলে সিপিএম-কংগ্রেস ঘুরে বিজেপিতে আসা এ পি আবদুল্লাকুট্টি, অন্ধ্রের ওয়াইএসআর কংগ্রেস ছেড়ে আসা ডি কে অরুণাও মুকুলবাবুর মতোই বিজেপিতে আসার পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁরা এখন রমন সিংহ, বসুন্ধরা রাজের সঙ্গে এক সারিতে। অন্ধ্রের এন টি রামারাওয়ের কন্যা, মনমোহন সরকারের মন্ত্রী দুগ্গাবতী পুরন্দেশ্বরী কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের তালিকায় ঢুকে পড়েছেন।

স্পষ্টতই, কেরল বা ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ— যে সব রাজ্যে বিজেপি পা ফেলতে পারেনি, সেখানে দল বদলে আসা নেতাদের কদর বেশি। মোদী-শাহের জমানার আগেও কংগ্রেস বা আঞ্চলিক দলের নেতারা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু মোদী-শাহের জমানায় সেটাই রোজকার নিয়ম। কখনও অন্য দলের সরকার ফেলতে। কখনও ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও সরকার গঠনের জন্য। কখনও আবার সহজ পন্থায় শক্তি বাড়াতে। আর কখনও সিবিআই-ইডির তদন্ত থেকে বাঁচতে অন্য দলের নেতারাই বিজেপিতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, অরুণাচল, গুজরাত, সর্বত্র একই ছবি। অসমে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল ও হিমন্তবিশ্ব শর্মা, দু’জনেই অন্য দল ছেড়ে এসেছেন। সিকিমে আঞ্চলিক দল ভাঙিয়েই বিজেপি রাতারাতি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ১২টি রাজ্যে বিজেপি সরকারের শতকরা ২৯ ভাগ মন্ত্রী অন্য দলের। দল ভাঙানো নিয়ে বিজেপির শীর্ষনেতারা এখন লুকোছাপাও করেন না। বাংলায় তো খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদীই বলেছিলেন, “দিদি, আপনার ৪০ জন বিধায়ক আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।”

স্বাভাবিক নিয়মে অন্য দল থেকে বিজেপিতে এসে রাতারাতি ক্ষমতা পেয়ে যাওয়া নেতাদের সঙ্গে এত দিন নীরবে কাজ করে যাওয়া আরএসএসের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব যার অন্যতম কারণ। নামদারদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারকে হয়তো নিজেদের মতাদর্শের সঙ্গেও আপস করতে হবে। তবে বিজেপি যত দিন কেন্দ্রে ও সিংহভাগ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকবে, তত দিন এই সমস্যা প্রকট হবে না। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি আওড়ালেও কংগ্রেস বা অন্য আঞ্চলিক দলের মধ্যে নরম হিন্দুত্বের রাজনীতি-করা নেতাদের অভাব নেই। সংখ্যালঘু বিদ্বেষ সস্তা জাতীয়তাবাদে সকলকে রাঙিয়ে ফেলতেও সমস্যা নেই।

তদুপরি অন্য দলের কেউ বিজেপিতে এসে রাতারাতি মন্ত্রী-সান্ত্রি হয়ে গেলে একটা কথা বোঝাই যায়, তা হল: বিজেপিতে সত্যিই দক্ষ প্রশাসক, অভিজ্ঞ সাংসদ-বিধায়কের অভাব আছে।

নেতা সত্যিই কম পড়িয়াছে!

অন্য বিষয়গুলি:

bjp Leaders TMC CPM Congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy