—ফাইল চিত্র
কাশ্মীরে কাজ করতে গিয়ে এই রাজ্যের পাঁচ শ্রমিক যে ভাবে জঙ্গিদের হাতে প্রাণ হারালেন, তা জেনে সবাই শিউরে উঠছেন। এই ঘটনা শুধু বেদনার নয়, ভয়েরও। কারণ কাশ্মীর আমাদের সকলেরই অতি প্রিয় জায়গা। কাজের জন্য শ্রমিকেরা যেমন গিয়েছেন, তেমনই এখান থেকে দলে দলে লোক ওই ভূস্বর্গে বেড়াতে যান। বলা যেতেই পারে, কাশ্মীরের পর্যটন-আয়ের একটি বড় অংশ বাংলার অবদান। কারণ কাশ্মীর বাঙালির বেড়ানোর এক পছন্দসই ঠিকানা।
এ ছাড়াও কাশ্মীরের লোকজন, বিশেষত শালবিক্রেতারা নিয়মিত এই রাজ্যে আসা যাওয়া করেন। বছরের পর বছর নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের ফলে বহু পাড়ায় বহু বাড়িতে ওই বিক্রেতাদের সঙ্গে এক প্রকার পরম্পরাগত আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের হাতে বাংলার মানুষদের বেঘোরে মরতে হলে যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগও চেপে ধরে।
চেনা কাশ্মীরের ছবি অবশ্য বদলাচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরে। ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকে গত কয়েক মাস সেখানকার পরিস্থিতি তো যথেষ্ট গুরুতর। তবে তার আগে থেকেও যে ভূস্বর্গে খুব শান্তির পরিবেশ ছিল তা নয়। তবু লক্ষণীয় হল, গোলমালের পরোয়া না করেই বাংলা থেকে পর্যটকেরা সেখানে গিয়েছেন। কাশ্মীরের শালওয়ালারাও এখানে এসেছেন।
কিন্তু এ বার কুলগামের কাতরাসু গ্রামে মুর্শিদাবাদ থেকে কাজ করতে যাওয়া পাঁচ শ্রমিককে যে ভাবে চিহ্নিত করে, বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারা হল, তাতে আর কোনও ভরসার জায়গা থাকবে কি? ফলে বলতেই হচ্ছে, ওই ঘটনার সঙ্গে সামগ্রিক ভাবে ভয় মিশে গেল। রাষ্ট্রপতির শাসনে কাশ্মীর গত কয়েক মাস কার্যত কেন্দ্রের অধীন। তাই সেখানকার এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায় কেন্দ্রীয় সরকার এড়াতে পারে না। এ বিষয়ে বিরোধীদের অভিযোগ খণ্ডনেরও কোনও জায়গা নেই।
অথচ এমন একটি মর্মান্তিক কাণ্ড ঘটার পরেও তাকে নিয়ে কত হৃদয়হীন রাজনীতি করা যায়, বিজেপি তা দেখিয়ে দিচ্ছে। এই রাজ্যের নেতাদের কথা পরে। আগে দেশের কর্ণধারদের দিকে একটু তাকানো যাক। কারণ মার্গদর্শক তো তাঁরাই!
কুলগামের ঘটনা ঘটেছে ২৯ অক্টোবর রাতে। কী হয়েছে, কোথায় হয়েছে, কেমন করে হয়েছে এবং কারা এর শিকার— অচিরেই তা জানা গিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, দেশের প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যেও এই প্রসঙ্গে একটি শব্দ উচ্চারিত হয়নি!
কুলগামের ঘটনার তিন দিন পরেই জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ আনুষ্ঠানিক ভাবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সে বিষয়ে বাণী দেন। সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করেন। কিন্তু কুলগামে সদ্য ঘটে যাওয়া হত্যালীলার কোনও উল্লেখ সেখানেও ছিল না। এ এক অমার্জনীয় অমানবিকতা, যা দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বেমানান এবং দৃষ্টিকটু। কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো আবশ্যক। বাসি হয়ে গেলে অর্থহীন। নীরবতা তো আরও অশোভন। পাঁচ শ্রমিককে মেরে ফেলা তেমনই এক ঘটনা।
দলের সর্বোচ্চ নেতাদের এই মনোভাবের প্রতিফলন নিচুতলায় দেখা যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজ্য বিজেপি আরও নির্মম পথ নিয়ে যে ভাবে খোলাখুলি হিন্দু-মুসলমান তাস খেলতে নেমে পড়েছে, তা ভয়ঙ্কর এবং আগামী দিনে রাজ্য-রাজনীতিতে এক বিপজ্জনক সঙ্কেত। বিজেপি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে স্বচ্ছন্দ, এটা জানা কথা। কিন্তু কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে খুন হওয়াদেরও জাত-ধর্ম বিচার করতে হবে, এটা মনুষ্যত্বের ধর্ম হতে পারে না।
সবাই জানেন, ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, কাশ্মীরে নিহতদের বাঙালি পরিচয়ের থেকেও বড় পরিচয় হল তাঁরা মুসলমান। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এত তৎপর! বিজেপি সভাপতির বক্তব্য ছিল, কাশ্মীরে নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আগে রাজ্য সরকারের উচিত এই রাজ্যে খুন হওয়া বিজেপি কর্মীদের পরিবারকে সাহায্য করা।
ভেবেচিন্তেই এ সব কথা বলেছেন দিলীপ ঘোষ। কারণ তিনি জানেন, মুড়ি-মিছরি একাকার করে দিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক হানাহানির সঙ্গে কাশ্মীরের ওই ঘটনার তুলনা টানলে তাতে বিতর্ক বাধিয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার গুরুত্ব কিছুটা গুলিয়ে দেওয়া যাবে। নইলে তাঁকে মেনে নিতে হবে, কেন্দ্রের হাতে গিয়েও কাশ্মীরে শান্তি ফেরেনি।
কিন্তু শ্যাম রাখতে গিয়ে কুল রাখা কঠিন। সেই পাকে জড়িয়ে রাজ্য বিজেপি আরও এক বার বাংলার মানুষের আবেগের বিপরীতে গা ভাসাল। ভেবে দেখুন, বাংলা থেকে কাশ্মীরে কাজ করতে যাওয়া এক দল শ্রমিক জঙ্গিদের হাতে খুন হলেন। প্রাণভয়ে ভীত আরও শতাধিক শ্রমিককে সেখান থেকে ‘উদ্ধার’ করে আনল এই রাজ্যের সরকার। আর বাংলার বিজেপি সাম্প্রদায়িকতার কাদা লেপে গোটা বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত! সামান্য উদ্বেগ প্রকাশ বা সমবেদনা জানানো তো দূরের কথা!
ভোটের অঙ্কে এই বিজেপি এখন রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল। আগামী দিনে রাজ্যপাটে বসার স্বপ্নও দেখছে তারা। শঙ্কা হয়, আজ তারা এখানে ক্ষমতায় থাকলে কাশ্মীরে বাংলার পাঁচ শ্রমিকের মর্মান্তিক হত্যা হয়তো ‘ধর্মযুদ্ধে শত্রুনিধন’ বলে গণ্য হত! আতঙ্কিত অন্য শ্রমিকদেরও নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ হয়তো দেখা যেত না। কারণ, তাঁদের প্রায় সকলেই যে মুসলিম!
পুলওয়ামা কাণ্ডের পরে আমাদের রাজ্যে নিয়মিত আসা কাশ্মীরি মুসলমান শালবিক্রেতাদের নির্বিচারে ‘পাকিস্তানের চর’ বলে দাগিয়ে দিয়ে মেরে তাড়ানোর অভিযান শুরু হয়েছিল। গোটা কাশ্মীরের দিকে আঙুল তুলে বিজেপির লোকজন
কাশ্মীরি জিনিসপত্র বয়কট করারও আওয়াজ তুলেছিলেন। দেশ জুড়ে তখন জাতীয়তাবাদের প্রবল ঝড়। আর আজ কাশ্মীরে, আমাদেরই দেশের মূল ভূখণ্ডে, যখন বাঙালিরা সন্ত্রাসবাদীদের শিকার, তখন চলছে আক্রান্তদের সম্প্রদায়-বিচার! কী অদ্ভুত এই দ্বিচারিতা।
এই রাজ্যের যে সব শ্রমিক কর্মসূত্রে কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলেন, তাঁদের সামগ্রিক অভিজ্ঞতায় কাশ্মীরের সাধারণ মানুষজন সম্পর্কে কিন্তু কোনও বিরূপতা নেই। ওই শ্রমিকদের অনেকেই বলেছেন, কাশ্মীরি মালিকেরা তাঁদের সুরক্ষার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। তাঁদের প্রাপ্য মজুরিও ঠিকঠাক দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, শ্রমিকদের অনেকে পারিবারিক পরম্পরায় বিশ-ত্রিশ বছর ধরে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে কিছু বাড়তি রোজগারের জন্য আপেল বাগানের কাজে যান। অর্থাৎ, দেশের আর পাঁচটি রাজ্যের মতো কাশ্মীরও তাঁদের এক সহজ গন্তব্য।
সেই কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ রুখতে না-পারার মাসুল গুনে পাঁচ বাঙালির মরদেহ যখন ফিরে আসে, তখন বেদনা গোটা রাজ্যের। নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি, দল বা সরকারের নয়। কারণ এই মৃত্যুর পিছনে কোনও দলাদলি বা ভোটের রাজনীতি নেই। এই রকম ঘটনা সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা দেয়।
তবু লোকসভায় রাজ্যে ১৮টি আসন পেয়ে যাওয়া দিলীপ ঘোষের দল অন্য পথে হেঁটে যা করল, তাতে ‘হিন্দুত্ব’-এর ভিত কত মজবুত হল জানি না। কিন্তু বাংলা ও বাঙালির আবেগে অবশ্যই ক্ষত তৈরি হল, এটা বলা যেতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy