Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
বাজে করুণ সুর

বিজেপি দুশ্চিন্তায়, কিন্তু বিরোধীরা নিশ্চিন্ত হলে ভুল করবেন

গ্রীষ্মের লোকসভা ভোটে জাতীয়তাবাদ যে দাবদাহ ছড়িয়েছিল, মাত্র তিন মাসের মধ্যে শরতের বিধানসভা ভোটে তার উত্তাপ কমে এসেছে। অর্থনীতিতে শীতঘুমের আশঙ্কা ভোটবাক্সে পড়তে শুরু করেছে।

সুযোগ? মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে শরদ পওয়ারের দল এনসিপি-র ফলাফলে সমর্থকদের উল্লাস, মুম্বই, ২৪ অক্টোবর। পিটিআই

সুযোগ? মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে শরদ পওয়ারের দল এনসিপি-র ফলাফলে সমর্থকদের উল্লাস, মুম্বই, ২৪ অক্টোবর। পিটিআই

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ০১:২২
Share: Save:

আরে ভাই, দোনো রাজ্যমে বিজয় হুয়া হ্যায়! আজ আওয়াজ অ্যাইসি হোগি কেয়া? মহারাষ্ট্র-হরিয়ানা বিধানসভা ভোটের ফলপ্রকাশের সন্ধ্যা। সদর দফতরের মঞ্চে অমিত শাহ বললেন। কারণ প্রথম বার ‘মেরে সাথ বোলিয়ে, ভারত মাতা কি জয়’ আহ্বানে যে আওয়াজ উঠল, তাতে অমিত শাহ খুশি হলেন না। তাই দ্বিতীয় বার আহ্বান জানালেন, ‘প্রচণ্ড আওয়াজসে বোলিয়ে, ভারত মাতা কি...’।

গ্রীষ্মের লোকসভা ভোটে জাতীয়তাবাদ যে দাবদাহ ছড়িয়েছিল, মাত্র তিন মাসের মধ্যে শরতের বিধানসভা ভোটে তার উত্তাপ কমে এসেছে। অর্থনীতিতে শীতঘুমের আশঙ্কা ভোটবাক্সে পড়তে শুরু করেছে। ‘ভারত মাতা কি জয়’-এর আওয়াজের মধ্যে আর্থিক বৃদ্ধির করুণ সুর কানে আসছে। দেশপ্রেমের বিপরীতে রুটিরুজি নিয়ে চিন্তিত মানুষ বিকল্প রাজনীতি চাইছেন, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।

দুই রাজ্যের ভোটের ফলে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয়, শহর ও গ্রামে ভোটের ফারাক। গ্রামের মানুষের হাতে যে টাকা নেই তা বাজারে কেনাকাটা কমে যাওয়া থেকেই স্পষ্ট ছিল। ফসলের সঠিক দাম, ঋণমকুবের দাবিতে একাধিক রাজ্যে আন্দোলন হয়েছে। চাষিদের ক্ষোভ বুঝতে পেরেই লোকসভা ভোটের আগে পিএম-কিষান প্রকল্প ঘোষণা করে গ্রামের মানুষের হাতে অল্প টাকা তুলে দেয়। কিন্তু দু’রাজ্যে ফল বলছে, গ্রামে বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে ধস নেমেছে। বিজেপি গদিতে ফিরেছে শহর এলাকার ভোটে ভর করে।

মহারাষ্ট্রই ধরা যাক। শহরের ৯৯টি বিধানসভা আসনের মধ্যে বিজেপি-শিবসেনা পেয়েছে ৭৪টি। মুম্বইয়ের ৩৬টির মধ্যে ৩০টি এনডিএ-র দখলে। কোঙ্কণ-ঠাণের মতো সমৃদ্ধ এলাকায় তিন ভাগের দু’ভাগ আসন তাদের। কিন্তু বিজয়রথের চাকা গ্রামের রাস্তায় বসে গিয়েছে। ১৮৯টির মধ্যে বিজেপির জোট মাত্র ৮৭টি আসন পেয়েছে। একই ছবি হরিয়ানাতেও। শহর এলাকায় ৩১টির মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ২০টি আসন। কিন্তু গ্রামে ৫৯টির মধ্যে ২০টির বেশি আসন বিজেপি জিততে পারেনি।

২০১৭-য় গুজরাতের বিধানসভা ভোটে গ্রামের মানুষের ক্ষোভ বিজেপি শিবিরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। এ বার মহারাষ্ট্রেও বিদর্ভের খরা, তার জেরে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং ঋণ শোধ করতে না পেরে চাষির আত্মহত্যা বিজেপিকে বেগ দিয়েছে। বিজেপির আসনে ভাল থাবা বসিয়েছে কংগ্রেস-এনসিপি। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এনডিএ-র ১৫টি আসন কমেছে। শহরের মধ্যবিত্ত এখনও মোদী সরকারের উপর আস্থা রাখছেন। কিন্তু গ্রামের মানুষের মনে প্রশ্ন— পেট চলবে কী করে! অর্থাৎ মোদী তাঁর জনপ্রিয়তা, কর্তৃত্ব, ছাপ্পান্ন ইঞ্চির পৌরুষ, সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠোরতা, জাতীয়তাবাদ নিয়েও অর্থনীতির সঙ্কটের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেননি।

অবশ্য কংগ্রেস তথা বিরোধী শিবির যদি মনে করে, চিন্তা নেই, এ ভাবেই পাঁচ বছর পরে লোকসভা ভোটে মোদী-অমিত শাহ ধরাশায়ী হবেন, তা হলে ভুল করবেন। কারণ লোকসভা ভোট দেখিয়েছে, জাতীয় স্তরে এখনও মোদীর বিকল্প কেউ নেই। তাঁকে হারাতে হলে দরকার বিকল্প রাজনীতি।

লোকসভা ভোটে মোদীর তুরুপের তাস দেশপ্রেম ছিল ঠিকই। তিনি বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন, তিনিই একমাত্র পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে পারেন। পাকিস্তান ও মুসলিমদের এক করে দেখিয়ে হিন্দুদের এককাট্টা হতে হবে বোঝাতে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে পরিমিত হিন্দুত্বের মিশেলও করেছিল বিজেপি। কিন্তু এ সবের সঙ্গে গরিবের জন্য বাড়ি, রান্নার গ্যাস, শৌচালয়ের মতো জনমুখী প্রকল্পও ছিল। রাহুল গাঁধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রবাবু নায়ডুরা তার মোকাবিলা করার চেষ্টা করেও কেউই মোদীর বিকল্প হয়ে উঠতে পারেননি, বিকল্প নীতিও দেখাতে পারেননি।

আর একটি কথা। ভোটাররা সম্ভবত লোকসভা ও বিধানসভায় আলাদা রকম ভাবে ভোট দেন। ২০১৮-য় মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে মানুষ কংগ্রেসকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তিন রাজ্যেই বিজেপি ভাল ফল করেছে। আবার ওড়িশায় লোকসভা ভোটের সঙ্গে বিধানসভা ভোট হয়েছিল। একই ভোটার একই দিনে ভোট দিতে গিয়ে কেন্দ্রে বিজেপির জন্য ইভিএম-এর বোতাম টিপেছেন। কিন্তু রাজ্যে বিজু জনতা দলকে ভোট দিয়ে ফের ক্ষমতায় এনেছেন। অর্থাৎ বিধানসভা ভোটে স্থানীয় বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। হরিয়ানার ভোটে যেমন জাঠদের বিজেপির অ-জাঠ মুখ্যমন্ত্রীকে হটানোর চেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। রাজ্যের বিজেপি মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বড় হয়ে উঠেছে।

হরিয়ানায় হয়তো বিজেপি সে দিকে নজর দেয়নি। লোকসভা ভোটের মতো এ বারেও উগ্র জাতীয়তাবাদের তাস খেলেই বাজি মাত করা যাবে ভেবে শুধু কাশ্মীরের ৩৭০ রদ, জওয়ানদের বীরগাথাই প্রচার করেছেন মোদী-অমিত শাহ। কিন্তু দুই ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ বার বার সে ভুল করবেন বলে ধরে বসে থাকলে সেটা কংগ্রেসেরই বোকামি হবে। হয়তো সে কথা বুঝতে পেরেই হরিয়ানা-মহারাষ্ট্রে প্রত্যাশার থেকে বেশি ভাল ফল করেও সনিয়া বা রাহুল বেশি কিছু বলেননি। বরঞ্চ চাষি থেকে ছোট ব্যবসায়ীর সমস্যা নিয়ে সরব হয়েছেন।

আগামী বছর দিল্লিতে বিধানসভা ভোট। পুরোটাই শহুরে এলাকা। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল দিল্লির আমজনতা, মধ্যবিত্তের জন্য নিশ্চুপে কাজ করে যাচ্ছেন। দিল্লির সরকারি স্কুলের পরিকাঠামোয় চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো বদল এসেছে। পাড়ায় পাড়ায় সুলভে চিকিৎসার জন্য মহল্লা ক্লিনিক খুলেছে। কেজরীবাল আর সব সমস্যার জন্য কেন্দ্রকে দুষছেন না। তার বদলে নিজেকে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তুলে ধরছেন। চাপের মুখে কেজরীবালের সঙ্গে লড়তে তাঁর মাঠেই নামতে হচ্ছে বিজেপিকে। মোদী সরকার আশপাশের রাজ্য থেকে রুটিরোজগারের সন্ধানে দিল্লিতে এসে আশ্রয় নেওয়া মানুষকে সুবিধা দিতে বেআইনি কলোনিকে আইনি করে দিচ্ছে। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গের ভোটেও বলা বাহুল্য, রাজ্যের বিষয়ই প্রধান হয়ে উঠবে।

তবে মোদীর স্বস্তিতে থাকার কারণ নেই। সেনার জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে তিনি জওয়ানদের সঙ্গে দীপাবলি কাটাতে পারেন। তাতে অর্থনীতির আকাশে আতসবাজির রোশনাই আসে না। সীমান্তে পাহারায় থাকা জওয়ানদের মনোবল বাড়াতে হবে। যে গাড়ি কারখানায় শ্রমিকের চাকরি যাচ্ছে, যে ব্যবসায়ীর রোজগার কমে যাচ্ছে, যে চাষি ফসলের দাম না পেয়ে রাস্তায় পেঁয়াজ-টম্যাটো ফেলে দিচ্ছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আর্থিক বৃদ্ধির হারকে অন্তত ৮ শতাংশের ঘরে টেনে তুলতে হবে। না হলে ভোটের বাক্সে আজ না হয় কাল তার প্রভাব পড়বেই। মোদীকে সামনে রেখেই বিজেপির বিজয়রথ ছুটছে। রথের চাকা গর্তে পড়লে তাঁকেই দায় নিতে হবে।

আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার ইতিমধ্যেই অর্থনীতির সমস্যা নিয়ে মোদী সরকারকে নিশানা করছে। বিরোধীদের সঙ্গে মোকাবিলা তো পরে। মোদী আগে তাঁর আঁতুড়ঘরের তির সামলান।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy