প্রতীকী ছবি।
বাংলা ভাষায় শিশু-কিশোর সাহিত্য চর্চার ইতিহাস দুশো বছরেরও পুরনো। ১৮১৮ সালে হুগলির শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত ‘দিগদর্শন’ পত্রিকাটিকেই বাংলা ভাষার প্রথম কিশোর পাঠ্যপত্রিকা মনে করা হয়। পরে অবশ্য সখা (প্রকাশকাল ১৮৮৩), বালক (১৮৮৫), সাথী (১৮৯৩), সখা ও সাথী (১৮৯৪), মুকুল (১৮৯৫) ইত্যাদি কিশোর পাঠ্য পত্রিকা হিসাবে বেশ জনপ্রিয় হয়। আরও পরে সন্দেশ, মৌচাক, শিশুসাথী, রংমশাল, পাঠশালা, পক্ষীরাজ, রামধনু, ভাইবোন ইত্যাদি ছোটদের পত্রিকাগুলি একে একে হাজির হয় বিবিধ বৈচিত্র নিয়ে।
বীরভূম জেলায় ছোটদের পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে তেমন কোনও আলোকিত ঐতিহ্যের সন্ধান আমরা পাই না। তবে এ জেলার শিশুসাহিত্যের চর্চা শুরু হয় একশো বছর আগেই। জেলার বিখ্যাত পণ্ডিত, গবেষক শিবরতন মিত্রের (জন্ম ১৮৭১ খ্রি:) হাত ধরে এই চর্চার সূচনা। বহু প্রাচীন পুথি এবং গ্রন্থ সংগ্রহের পাশাপাশি শিবরতন বীরভূম ও বীরভূম সংলগ্ন ঝাড়খণ্ডের গ্রামগুলি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন ছোটদের আশ্চর্য সব রূপকথার কাহিনি। যা বাংলার লোকসাহিত্যেরও অনন্য সম্পদ। পরে তাঁর সংগৃহীত গল্পগুলি থেকে বাছাই করে বেশ কিছু গল্প ‘সাঁঝের কথা’, ‘নিশির কথা’ এবং ‘কল্পকথা’ নামে তিনটি বই-এ অন্তর্ভুক্ত হয়। সাঁঝের কথা প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে কলকাতার আশুতোষ লাইব্রেরি থেকে। সহজ সরল ভাষায় গল্পগুলোর লিখিত রূপ দেন শিবরতন। সত্য , সুন্দর এবং মানবিক চেতনায় কিশোর মনকে গড়ে তোলাই তাঁর এই গ্রন্থ প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল। কলকাতা থেকে দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে এই দুর্লভ রূপকথা সংগ্রহের কাজ করেছিলেন শিবরতন। সম্ভবত এই দূরত্বের কারণেই তাঁর এ সব কাজের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি তখন। অথচ সাঁঝের কথা প্রকাশের মাত্র এগারো বছর আগে ১৯০৮ সালে দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ প্রকাশ করে রূপকথা সাহিত্যে মহীরুহ হয়ে রয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। বীরভূমের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তেমন সৌভাগ্য শিবরতন মিত্রের হয়নি। রূপকথার এই গল্পগুলি ছাড়াও খুব ছোটদের জন্য তিনি ‘বর্ণমালা’ নামে বর্ণ শেখার একটি বই-ও লিখেছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ কলকাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ছিল এক সময়। বলা দরকার যে, বীরভূম জেলার শিশুসাহিত্যে এমন অনেক ব্যক্তিত্বই রয়েছেন, যাঁরা শুধু বীরভূমেরই নন, সারা বাংলার শিশুসাহিত্যের সম্পদ। তাই বীরভূমের শিশুসাহিত্যিক হিসাবে তাঁদের চিহ্নিত করা যায় না কোনও ভাবেই। তবু আলোচনা এই জন্যেই যে, এঁদের কারও কারও জন্মসূত্রে, কর্মসূত্রে অথবা বসবাসের সূত্রে বীরভূমের মাটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বলা যায়, পরবর্তী সময়ে বীরভূমের শিশুসাহিত্য চর্চা কিছুটা হলেও তাঁদের চেনানো পথেই এগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে।
যেমন ব্রতচারীর জনক গুরুসদয় দত্ত ছিলেন বীরভূম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। পেশাগত দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন শিশুপাঠ্য নানা রচনা। ১৯৩২ সালে এই বীরভূমের মাটিতেই তিনি গড়ে তোলেন তাঁর বিখ্যাত ব্রতচারী সঙ্ঘ। নিজে মাঠে নেমে ছড়া ও গানের মাধ্যমে জেলার বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের শেখান শরীরচর্চার নানা কৌশল। সেই ব্রতচারীর গান ও ছড়া আজও শিশুসাহিত্যের অন্যতম সম্পদ। ভজার বাঁশি, পাগলামির পুঁথি, চাঁদের বুড়ি— শিশুদের জন্য লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। রয়েছেন স্বামী সত্যানন্দও (জন্ম ১৯০১), যিনি ঠাকুর সত্যানন্দ নামে পরিচিত। এই জেলার ছোটদের সাহিত্য চর্চায় বিশেষ ভূমিকা রয়েছে তাঁরও। ছোটদের জন্য স্বামী সত্যানন্দ লিখেছেন গল্প, কবিতা, ছড়া, নাটক এবং প্রবন্ধ। তাঁর লেখা ‘রবিন হুড’ নাটকটি সেসময় বেশ জনপ্রিয় হয়। খুব ছোটদের জন্য তাঁর লেখা ‘গদাধরের অ-আ-ক-খ’ আজও এক আশ্চর্য আনন্দপাঠ।
সিউড়ি শহরের এক বাসিন্দা ননী ভৌমিক (জন্ম ১৯২১), তাঁর ‘ধুলোমাটি’ উপন্যাসটির জন্য বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। এই ননী ভৌমিকও সচেতন ভাবেই ছোটদের জন্য কলম ধরেছিলেন। অবশ্য কর্মসূত্রে তিনি এক সময় রাশিয়ায় চলে যান। মূলত সেখানেই তিনি ধারাবাহিক ভাবে শিশুসাহিত্য চর্চায় নিজেকে যুক্ত করেন। রুশ শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল রচনা সমূহ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন দক্ষ হাতে। তাঁর সেই সব অনুবাদ বই আকারেও বের হয়। ‘দাদুর দস্তানা’ এ রকমই একটি ছোটদের জন্য লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। তারাশঙ্কর, শৈলজা, ফাল্গুনী— এই তিন বিখ্যাত কথাশিল্পীর নাম এ জেলায় এক সঙ্গেই উচ্চারিত হয়। তিন জনেই জন্মসূত্রে বীরভূমের মানুষ। তিন জনই ছোটদের জন্য লিখেছেন বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস। লিখেছেন ছোটদের কবিতাও। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (জন্ম ১৯০১) ছিলেন খয়রাশোলের রূপুষপুর গ্রামের মানুষ। ছোটদের জন্যে রয়েছে তাঁর চিরকালীন বেশ কিছু গল্প। অধিকাংশ গল্পের পটভূমিই কয়লাখনি অঞ্চল অথবা সীমান্ত বীরভূমের খেটে খাওয়া মানুষজন। তৎকালীন বাংলার একাধিক পূজাবার্ষিকীর অনিবার্য লেখক ছিলেন শৈলজানন্দ। লিখেছেন মৌচাক, পাঠশালা, মাসপয়লা, শুকতারা, কিশোর ভারতীর মতো ছোটদের পত্রিকাগুলিতেও। ছোটদের জন্য মোট আটটি বই লিখেছেন শৈলজানন্দ। এগুলির মধ্যে ভূতুরে বই, পেস্তার বরফি, ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প, ছোটদের ভালো ভালো গল্প উল্লেখযোগ্য। তাঁর কিশোর গল্প বিষয় বৈচিত্রে ছিল অনন্য। ভূতের গল্প, ডাকাতের গল্প, হাসির গল্প যেমন লিখেছেন, তেমনই লিখেছেন রূপকথার গল্প-ও। শৈলজানন্দের আঞ্চলিক সাহিত্যকে অনুসরণ করেই মূলত যাঁর বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব, বীরভূমের অন্যতম রত্ন সেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছোটদের জন্য লিখেছেন হাত খুলেই। বীরভূম জেলা এবং জেলার তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের চড়াই উৎরাই-এর নানা ছবি তাঁর কলমে উঠে এলেও ছোটদের জন্য ছোটদের মতো করেই লিখেছেন বহু সহজ, সরল, সামাজিক গল্প। যা ছোটদের প্রকৃত অর্থেই বড় হয়ে ওঠার পথনির্দেশ। সন্দেশ, রং মশাল, শুকতারায় লিখেছেন নিয়মিত। গল্প এবং কবিতা লিখেছেন বাংলার বিভিন্ন বার্ষিকীতেও।
শৈলজানন্দের গ্রাম রুপুষপুরের কাছাকাছি নাগরাকোন্দা গ্রামে ১৯০৪ সালে জন্ম সাহিত্যিক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের। কর্মজীবনের প্রায় বিশ বছর কলকাতায় কাটালেও, বীরভূমের সঙ্গে তাঁর ছিল নাড়ির যোগ। তাঁর বেশ কিছু রচনায় প্রকাশ পেয়েছে এই জেলার গ্রাম ও গ্রামজীবন। ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন কয়েকটি উপন্যাস এবং বেশ কিছু গল্প। ‘গুণধর ছেলে’ ছোটদের জন্য তাঁর একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ‘পাতালের পাকচক্র’, ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ বা ‘কালো রুমাল’-এর (গোয়েন্দা উপন্যাস) মতো রচনাগুলি ছোটদের সাহিত্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য সংযোজন। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের কৈশারক পত্রিকাতেও লিখেছেন ছোটদের গল্প।
‘শনিবারের চিঠি’র বিখ্যাত সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের আদি বাড়ি বোলপুরের কাছাকাছি রাইপুর গ্রামে। সমালোচক এবং কবি হিসাবেই বিখ্যাত তিনি। বড়দের জন্য লিখেছেন অজস্র গদ্য পদ্য। তবে ছোটদের জন্যেও কলম ধরেছিলেন এই দুঁদে সম্পাদক। বহু সময় সম্পাদকের অনুরোধ রক্ষার জন্যেও তাঁকে লিখতে হয়েছে ছোটদের উপযোগী লেখা। তাঁর ‘বোলপুর’ শীর্ষক কবিতাটি আজও কিশোরপাঠ্য কবিতা হিসাবে বহু কিশোর সংকলনের সম্পদ হয়ে রয়েছে।
আবার জন্মসূত্রে হুগলি জেলার মানুষ প্রভাত মোহন বন্দোপাধ্যায় (জন্ম ১৯০৪) ছাত্রাবস্থাতেই চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। সেখানেই থেকে যান স্থায়ী ভাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য প্রভাতমোহন ছোট-বড় সবার জন্য লিখলেও ছোটদের লেখক হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত। ছোটদের জন্য লিখেছেন বহু মজার ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ এবং নাটক। নিয়মিত লিখেছেন সন্দেশ, আনন্দমেলা-সহ বহু উল্লেখযোগ্য পত্রপত্রিকায়। আছে ‘তিন্তিরি’ নামে একটি ছড়ার বইও। চিত্রশিল্পী হিসাবেও তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল। স্ত্রী ইন্দিরা দেবীও ছিলেন সুলেখিকা ও শিল্পী। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ইন্দিরা দেবীও বেশ কিছু গল্প-কবিতা লিখেছেন। শ্রীনিকেতনে ছোটদের নিয়ে নাটকের গ্রুপও তৈরি করেছিলেন। পাশাপাশি সিউড়ির মানুষ লীনা দত্তগুপ্ত (জন্ম ১৯০৯) ছোটদের ভালবেসে লিখেছেন বেশ কিছু ছড়া ও কবিতা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘আলোর ফুলকি’ নামে বিখ্যাত ছোটদের সংকলনে তাঁর একটি ছড়া প্রকাশিত হয়। প্রায় শেষ জীবনে প্রকাশিত (১৯৯৪) লীলা মজুমদারের শুভেচ্ছা সমৃদ্ধ তাঁর ছোটদের জন্য ছড়ার বই ‘কেয়া পাতার নৌকো’ জেলার শিশুসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক সুধীর করণ (জন্ম ১৯২৪) বড়দের পাশাপাশি সমানতালে লিখে গিয়েছেন ছোটদের জন্যেও। ছোটদের জন্য লিখেছেন অজস্র ছড়া-কবিতা এবং গল্প। বিশ্ব সাহিত্যের কিছু উল্লেখযোগ্য গল্প-কবিতা অনুবাদ করে তুলে দিয়েছেন ছোটদের হাতে। পাহাড়ী বাবার দাঁতাল হাতি, হীরা মুক্তো মনি পান্না, ঠগ বর্ধন, ইত্যাদি গল্পের বই এবং ছড়ার বই ‘ভুত্তারুয়া’ আজও ছোটদের প্রিয় গ্রন্থতালিকায় জায়গা করে নেয়।
জেলার আরও কয়েক জন বিখ্যাত মানুষ লিখেছেন ছোটদের জন্য। তবে রচনার সংখ্যার নিরিখে তা জেলার শিশুসাহিত্যিকে তেমন প্রভাবিত করতে না পারলেও তাঁদের অল্প সংখ্যক রচনাই ছোটদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে কীর্ণাহারের নিমড়ার বাসিন্দা, গবেষক এম আবদুর রহমানের ‘কিশোর নজরুল’ গ্রন্থটির কথা বলা যায়। নজরুলের জীবনের কিশোরবেলার দিনগুলি সহজ সরল ভাবে তুলে ধরেছিলেন তিনি এই গ্রন্থে। গবেষক, বীরভূম অনুসন্ধানী গৌরীহর মিত্রও কলম ধরেছিলেন ছোটদের জন্য। লাভপুরের কাছে হাতিয়া গ্রামের মানুষ আদ্যনাথ রায়চৌধুরী যেমন ছোটদের বর্ণ চেনানোর জন্য লিখেছিলেন মজাদার ছন্দে সহজ কবিতা, তেমনই লিখেছিলেন ছোটদের জন্য নাটকও। তাঁর ‘বাঘ গরিল্লা ও রাক্ষস’ নাটিকাটি সাফল্যের সঙ্গেই মঞ্চস্থ হয় সে সময়।
এ ভাবেই পরিচিত এবং অল্পপরিচিত বহু কলম বীরভূম তথা বাংলার শিশু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। সেই ধারা আজও বহমান।
(লেখক কবি ও সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy