Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

সময়ের সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে চলেছে বর্ধমানের বাংলা ব্যান্ড

জেলায় বাংলা ব্যান্ডের চর্চাকে আরও এগিয়ে যেতে হলে দর্শকদের সাহচর্য যেমন দরকার তেমনই দরকার সমকালীন ভাষা এবং বিষয় সম্পর্কে সচেতনতাও। লিখছেন রনি আদিত্যপূর্ব বর্ধমান জেলার সদর শহর বর্ধমানের নানা কলেজেকেও স্পর্শ করেছিল বাংলা ব্যান্ডের জোয়ার। প্রথম দিকে অর্থাৎ একুশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য এক ধরনের সংগ্রাম ছিল।

ব্যান্ডের অনুষ্ঠান। নিজস্ব চিত্র

ব্যান্ডের অনুষ্ঠান। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৯ ০১:২৫
Share: Save:

‘‘শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়’, বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে এই ভাঙাভাঙির জন্য দশ বছরও লাগে না। অনেক উচ্চমানের লিটল ম্যাগাজিন চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যায়।’’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এমন মন্তব্যই করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সত্যিই একটা সময়ে সাহিত্যপত্রিকা বা লিটিল ম্যাগাজিন ছিল বাংলার প্রথিতযশা শিল্পী ও সাহিত্যিকদের আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। বিভিন্ন কলেজে দেখা যেত এক দল নবীন কবি যশপ্রার্থী একজোট হয়ে তৈরি করেছে সাহিত্যপত্রিকা। এটি ছিল প্রচলিত ব্যবস্থার বিরদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমও। ফলত একটা সময় কলেজ-সহ উচ্চশিক্ষার যাবতীয় প্রতিষ্ঠানে সাহিত্যপত্রিকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য থাকলেও ধীরে ধীরে গানও নিজেকে প্রতিবাদের একটি মাধ্যম হিসেবে মেলে ধরতে শুরু করে। বিশেষ করে বিশ শতকের নয়ের দশকে নতুন ধরনের বাংলা গানের একের পর এক জনপ্রিয় শিল্পীর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে প্রতিবাদের ভাষাও। কলকাতায় একের পর এক বাংলা ব্যান্ড জন্ম নিতে থাকলে মফস্সলের পড়ুয়ারাও তাতে শামিল হওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। জেলার নানা কলেজে তৈরি হতে থাকে একের পর এক বাংলা ব্যান্ড।

পূর্ব বর্ধমান জেলার সদর শহর বর্ধমানের নানা কলেজেকেও স্পর্শ করেছিল বাংলা ব্যান্ডের জোয়ার। প্রথম দিকে অর্থাৎ একুশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য এক ধরনের সংগ্রাম ছিল। সেই সময়ের ব্যান্ডের শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের অনেকেই নিজেদের হাতে চেয়ার পেতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। নিজেদের লেখা গান পরিবেশনের আগে দর্শকদের অনুরোধে গাইতে হত কলকাতার নানা ব্যান্ডের জনপ্রিয় গান। এই সংগ্রামের ধরন অনেকটাই পাল্টেছে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। সেই সময়ের বাংলা ব্যান্ড এখন একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্পমাধ্যমের মর্যাদা লাভ করেছে। বর্ধমানের মতো শহরেও কলেজের গান জানা পড়ুয়াদের দু’চোখে স্বপ্ন। সেই সময়ে কলকাতার গানের পাশাপাশি, জেলার ও শহরের শিল্পীদের গানেরও চাহিদা তৈরি হতে শুরু করে ছিল। কিন্তু দর্শকদের মন জয় করবে এমন গান রচনা করা এবং ব্যান্ডের শিল্পীদের একজোট করে রাখাটা একটি বিরাট বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিল। কারণ, কলেজে জীবনের শেষে অনেককেই কাজের সন্ধানে পাড়ি দিতে হত ভিন্ রাজ্যে। এক দশকের মধ্যে বর্ধমানে আত্মপ্রকাশ করেছিল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড। তার মধ্যে ‘তৃতীয় বিশ্ব’, ‘সময়’ এবং ‘ড্যামেজ সোসাইটি’-র সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থাকায় খুব কাছ থেকে ব্যান্ডের এই সংগ্রামকে দেখেছি।

সময়টা ২০০৭ সাল। স্কুল জীবন শেষ করে প্রবেশ করেছি বর্ধমানের একটি কলেজে। সেই সময় নবীনবরণে গান গাওয়ার সুযোগটা আচমকাই এসে গেল। গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জুটে গেল কিছু গানপাগল বন্ধু। সঙ্গে সিনিয়ারদের স্নেহও। তবে সেই সময় গানের বিষয়ে প্রবল উৎসাহ থাকলেও বাংলা ব্যান্ডের গান সম্পর্কে তেমন ভাবে কোনও জ্ঞান আমাদের অধিকাংশেরই ছিল না। হঠাৎই কানে এল কলেজের কিছু সিনিয়ার একটি বাংলা ব্যান্ড তৈরি করেছে। এই ঘটনা আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা ছিল। তাই নবীনবরণের পর থেকে কয়েক জন গানপাগলের একত্রিত হয়ে রক মিউজিক সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটেই তৈরি হল ‘তৃতীয় বিশ্ব’ ব্যান্ডটি। অবশ্য কিছু দিন একসঙ্গে কাজ চলে।

কিন্তু গানের নেশা একবার পেয়ে বসলে কি আর তাকে ছেড়ে থাকা যায়? ‘তৃতীয় বিশ্ব’-এর কাজ বন্ধ হলেও আরও একটি দল তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হল। এই সময়েই আসতে থাকে সুপ্রতিম, পার্থ, শেখরের মতো সহযোগী। কলেজের শুভমদা অভিভাবকের মতো আমাদের সাহায্য করেছিলেন। সকলের মিলিত চেষ্টায় তৈরি হয় ‘সময়’ নামে ব্যান্ডটি। প্রথম দিকে শোয়ের সংখ্যা কম হলেও ধীরে ধীরে শহরের নানা প্রান্ত থেকে ডাক আসতে শুরু করে। কয়েক বছর কাজ করার পরে পুরনো দু’জন দল থেকে বিদায় নেয়। তার জায়গায় দিব্যেন্দু সাহা (টোটা) এবং তমাল দাস নামে দু’জন আসে। চলতে থাকে গান লেখা এবং তাতে সুরারোপের কাজ।

২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘সময়’-এর প্রথম অ্যালবাম ‘জোকার’। নতুন বছরে জনপ্রিয়তা পেলেও ফের দলের ভাঙন ঘনিয়ে আসে। এর মধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব এবং ফোর-জি নেটওয়ার্কের আসার সঙ্গে সঙ্গে গান পরিবেশনের প্রেক্ষিতটাই বদলে যায়। ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলির সৌজন্যে মফস্সলের শিল্পীদের আত্মপ্রকাশ বেশ খানিকটা সহজ হয়ে যায়। আগে জেলার বাংলা ব্যান্ডের বড় প্রাপ্তি বা স্বীকৃতির মানদণ্ড ছিল কলকাতায় গিয়ে অনুষ্ঠান করা। কিন্তু পরে ইউটিউবের সৌজন্যে গানের মুক্তি ও বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে পৌঁছনোর কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছে অনেকটাই। এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলিকে কাজে লাগিয়ে দর্শকদের কাছে টানার নানা পরিকল্পনা করছে আধুনিক বাংলা ব্যান্ডগুলি।

‘সময়’ ব্যান্ডের সঙ্গ ছাড়ার তিন মাস পরে যুক্ত হয়েছি বাংলা ব্যান্ড ‘ড্যামেজ সোসাইটি’-র সঙ্গে। এই ব্যান্ডের সঙ্গে করা দু’টি গানের ভিডিয়ো ইউটিউবে মুক্তি পেয়েছে। কলকাতা এবং রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুষ্ঠান করার ডাক আসছে এখন। তবে এখন অনুষ্ঠান করার খরচ আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। কলকাতার কয়েকটি বড় মঞ্চে অনুষ্ঠান পরিবেশন করে যে অর্থ পাওয়া যাচ্ছে তাতে অবশ্য কিছুটা সুরাহা হচ্ছে। কিন্তু পুরোদমে গানের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হলে পারিবারিক এবং আর্থ সামাজিক সমর্থন অনিবার্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই সমর্থন না পেলে বর্তমান সময়ের কোনও শিল্পীর পক্ষেই পরিবার প্রতিপালন করা সম্ভব নয়।

বর্তমানে দুই বর্ধমান জেলায় যে কাজগুলি হচ্ছে সেগুলি নিঃসন্দেহে ভাল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গানের ভাষা এবং ভঙ্গিমাও বদলেছে। আগে মৌলিক গান লেখার দিকে ঝোঁক বেশি হলেও এখন দেখা যাচ্ছে পুরনো হিন্দি সিনেমার বিভিন্ন গানকে আধুনিক সময়ের প্রেক্ষিতে উপস্থাপনের প্রয়াস চলছে। পুরনো রোমান্টিক গানের ‘রক’ সংস্করণ হয়ে উঠছে সমকালীন সময়ের নানা বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু জেলায় বাংলা ব্যান্ডের চর্চাকে আরও এগিয়ে যেতে হলে দর্শকদের সাহচর্য যেমন দরকার তেমনই দরকার সমকালীন ভাষা এবং বিষয় সম্পর্কে সচেতনতাও। আশা রাখি পরের প্রজন্ম এই চর্চাকে আরও দূরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।

বর্ধমানের ব্যান্ডশিল্পী

অন্য বিষয়গুলি:

Rock band Bengali Song Bardhaman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy