ধলভুমগড়ে বিশ্বযুদ্ধের আমলের খাঁ-খাঁ পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে কখনও না-ই যেতে পারি, বড়বাজারের গিজগিজে ভিড়ে এক দিন ঠিক পৌঁছে যাব দেখো। নতুন বছরগুলোয় কোনও নিশানা বা ‘গোল’ ঠিক করা হয়ে ওঠে না ইদানীং। বছরগুলো আকছার পরস্পরের পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয়। মানে এটা ১৪২৭ না হয়ে ১৪২০ হলেও ঠিক ক্ষতি হত না, কিংবা ১৪২৯ বা ৩৪। একঘেয়েমি ও অপচয়ের সেই চরকিপাকেই তো দিনরাত কাটছে। বড়জোর আর একটু স্বাচ্ছন্দ্য বা আরামের বন্দোবস্ত করছি। কিংবা গোলপোস্ট বাঁচানোর ভঙ্গিতে ধসে যাব জেনেও আছড়ে পড়া সমস্যাকে ঠেকিয়ে রাখা। তাতেই কত বিকেলের নরম হলদে রোদ, সন্ধে পোয়ানো বাতাসের স্নিগ্ধতা লোপাট। এ বার তার হক আদায় করব আমি।
টিপেটুপে পয়সা জমিয়ে কোনও জমকালো লেজার ট্রিপে যদি নাও যেতে পারি, কোনও এক অবেলায় বড়বাজারের ভিড়ে ঠিক পৌঁছে যাব। নন্দরাম মার্কেটের দিক কিংবা হাওড়া ব্রিজের আধখানা হাতার মুখে মানুষের শরীরের গন্ধে ল-ম্বা শ্বাস নিয়ে খুঁজব তাকে। পাকদণ্ডির আঁকিবুকিতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘার মতোই ওয়রিয়ের মাকড়সার জাল বা চট-প্লাস্টিকের ছাউনি ভেদ করে এক দিন ঠিক পেয়ে যাব ধবধবে আর্মানি গির্জার চুড়ো। বছর পয়লার ‘বাকেট লিস্টে’ তোমার সঙ্গে এই পথ হারানোর ‘ডিল’ থাকল কলকাতা।
আরও পড়ুন: যে দিন সুস্থ আকাশের নীচে সমবেত প্রশ্বাস নিতে পারব, সে দিনই নতুন করে পয়লা ঘোষিত হবে
কোনও এক অফিসফেরত সন্ধেরাতে ক্যামাক স্ট্রিটে কুলপি খেতে যাওয়ার কথা ছিল আমাদের! ও সব পাগলামির কী বয়স আছে বলে আমিই পিছিয়ে এসেছি। আশৈশব শুনে আসছি, এটা কোরো না, সেটা কোরো না। কম্পিউটার ক্লাসে ফাঁকি মেরো না। চুরি করে হজমি খেয়ো না, পরনারীর দিকে তাকিয়ো না, ভেন্ন জাতধম্মে মেলামেশা কোরো না! এ বার বোঝ ঠ্যালা কে নিষ্পত্তি করবে কে আপন, কে পর। কাছের প্রিয়জনের বা নিজের বিষ নিঃশ্বাসকেই তো ভয় পাচ্ছি। এ কুরুক্ষেত্রের অন্ধকার হাতড়ে কে জানে, কে কখন কার হন্তারক হয়ে ওঠে।
অন্ধ হলে যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না, লকডাউনেও সময় থমকে থাকে না। ডিএল রায়ের নন্দলালের মতো বাড়ি-বন্দি পড়ে থাকলেই পৃথিবীর অসুখ সারবে না। এ সময়টা পৃথিবীর দেনা শোধবারও সময়। দূরে সরেও পাশে থাকার লগ্ন। নাগপুরে আটকে থাকা নন্দীগ্রামের শ্রমিকের থমথমে স্বরে ভিডিয়ো, চার দিন ভাতবিহীন মুড়ি খেয়ে থাকা কান্নার শ্বাস স্রেফ ভার্চুয়াল নয়। তা বিষিয়ে দিতে পারে আমার ভাতপাতের থালা, শহরময় উদ্ভ্রান্ত ঘুরে দাঁড়ানো খিদের জ্বালা মারণ ভাইরাস হয়ে এক দিন না এক দিন মিশে যাবে আমার অফিস যাওয়ার রাস্তায়, চেনা মুদি দোকানের মোড়ে, প্রিয় পানশালার ফুটপাতে। অশক্ত একলা বৃদ্ধের মতো বাড়ির বাইরে পুলিশকে ডেকে দশটি হাজার টাকার সাহায্য না-ই করলেন, রোজ অফিস যাওয়ার পথের সঙ্গী রিকশাওয়ালার সপরিবার একবেলা খাওয়ার বন্দোবস্তটি কি করা যায়! পাড়ার পিছনের গলির ঝুপড়ির ওদের জন্য এই প্রথম নিজের স্বার্থেই উতলা হয়ে উঠছি। কী হবে, ওরা তো চান করে টাইমের কলে, সাবান মাখার বিলাসিতা ওদের জীবনে নেই। এই প্রথম ভাবছি, নিজে বাঁচার স্বার্থেই ওদের জন্য একটা কিছু করতে হবে।
পাশাপাশি ঘর বা এক ছাদের নীচে বন্দি মানুষটির সঙ্গে যাপনও কি যৌথ জীবন হয়ে উঠতে পেরেছে? এ দুঃসময়টা কেটে গেলে বয়স্ক আত্মীয়ার রোগশয্যার পাশে বসতে হবে। ছোটবেলার হারানো চিঠি ফের খুলে পড়ব তখন। সেই ডানপিটে ক্লাস সেভেনের সঙ্গে লেপ্টে বিভূতিভূষণ পড়ব। অফিসটাইমে বিরক্ত করা অকাজের বন্ধুটির জন্য রেশনের আটার মতোই না-হয় সপ্তাহে বরাদ্দ হোক কিছু খুচরো সময়। কারণ, যা চলছে, চলছিল, তা ঠিক তেমনই অনন্ত কাল ধরে নিস্তরঙ্গ চলবে না, হঠাৎ সব থমকে যেতে পারে তাও তো দেখিয়ে দিয়েছে জীবন।
আরও পড়ুন: এ বার পয়লা বৈশাখেও ঘরবন্দি থাকতে হবে ভেবে বিষণ্ণতা আছেই
সারা ক্ষণ কানে বাজছে করোনা, করোনা! না কি, কোরোনা, কোরোনা! এটাই সময়। রণ রক্ত সফলতার বাইরে জীবনকে দেখাও এ বার শুরু করতে হবে। বেলা এগারোটায় ঘুঘুর ডাকের জন্য ঠিক কান পাতব। দুপুরের ভাতপাতের উদ্বৃত্ত বাঁচাতে না-পারি মাছের কাঁটা নিয়ে কাক-বেড়ালের অপেক্ষা করব। বাজারের থলে হাতে খামখা তাড়াও অনেক হল। ভোরের ট্রেনে শহরে আসা সবুজ-বেচা মানুষের সঙ্গে একটু গল্প করব। তুচ্ছ হাতের কাজকে সম্মান করব। স্মার্টফোনে বুঁদ না-থেকে শহর-গ্রামের সাইনবোর্ড, মানুষের মুখগুলো পড়া শুরু করব। আত্মরতিও যে এমন একঘেয়ে লাগবে, কে ভেবেছিল। এই শহরে, মফস্সলে ট্রেনে বা মেট্রোয় ভিন্ভাষার একটু গুনগুনের অপেক্ষায় কানটা চাতক হয়ে আছে। একাকিত্ব ছাড়া এমন যৌথতা আর কিসে মালুম হত।
মহামারি বা অতিমারি কিন্তু বার বার পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছে। এ নববর্ষ তবে নতুন হোক। জীবনের মন্ত্র হোক করো, করো!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy