গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
বাংলা নববর্ষ ১৪২৭, এসে পড়ল। কিন্তু এ কেমন নববর্ষ। এমন নববর্ষ জীবৎকালে কেউ কোনওদিন দেখেছে কি না সন্দেহ। চিনের উহান প্রদেশ থেকে যে আনুবীক্ষণিক ভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছিল, তা আজ প্রায় সারা পৃথিবীকে নিজের গ্রাসে নিয়ে এসেছে। আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, নেপোলিয়ন বা হিটলার— কেউ যা পারেনি সেটাই করে দেখিয়েছে প্রায় অদৃশ্য একটা ভাইরাস। সারা পৃথিবী তার ভয়ে কাঁপছে। আশঙ্কায় স্তব্ধ হয়ে আছে। কাজকর্ম শিকেয় তুলে, ‘অর্থনীতি, রোজগার পরে দেখা যাবে আগে তো বাঁচি, সুস্থ থাকি’ এই মর্মে নিজেদের বেঁধে রেখেছে ঘরে। শুরু হয়েছে এক অভূতপূর্ব লকডাউন।
বাকি সবার মতো বাঙালিও এই লকডাউনের অন্তর্গত। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বাকি জেলা শহর, মফস্সল বা গ্রাম ও দেশের অন্যান্য বাঙালি অধ্যুষিত জায়গার দৃশ্য প্রায় একই রকম।
তবে কিছু যে ভুল কারণে উৎসাহী মানুষ বেরিয়ে পড়ছেন না তা নয়। কিন্তু সামগ্রিকতার বিচারে এমন জনমানবহীন রাস্তাঘাট আগে কেউ দেখেছে বলে মনে করতে পারা যাচ্ছে না। ঝাঁপ ফেলা দোকানপাট। শূন্য ফ্লাইওভার। ছোটগলি। নির্জন রেলস্টেশন। কেউ কোথাও নেই। যেন আচমকা সবাইকে ভিনগ্রহের প্রাণীরা এসে তুলে নিয়ে গিয়েছে। যেন রাবার দিয়ে কেউ মুছে দিয়েছে মানুষজন। সব এমন নির্জন যে শোনা যাচ্ছে শহরের রাস্তাতেও নাকি ভাম, শিয়াল বেরিয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন: সামনে কঠিন পথ, প্রশাসনের মানবিক মুখ জরুরি
আর এই সবের মধ্যে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এল বাংলা নববর্ষ। বাঙালির এমনিতেই বারোমাসে তেরো পার্বণ। সারা বছরই আমাদের কিছু না কিছু উৎসব, অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। আমাদের জীবন যেমনই হোক না কেন, মোটের উপর আমরা হাসিখুশিই থাকি। বা বলা যায়, এই সব উৎসববঙ্গজীবনের নানান ওঠাপড়ার মধ্যে সেই সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিমের মতোই আমাদের ভাল রাখে, আনন্দে রাখে। কিন্তু এবার যেন সে গুড়েও বালি।
এই লকডাউনের মধ্যে এমনিতেই চুপিচুপি চলে গিয়েছে বাসন্তী পুজো। এবার পালা নববর্ষ তথা গণেশপুজোর।
হাতিবাগান, গড়িয়াহাট থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় চৈত্র মাসে সেল চলে। মানুষ ঝেঁটিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জামাকাপড় থেকে টেবলের ঢাকনা, ব্যাগ, জুতো, সবকিছুর উপর। ‘সেল’-প্রিয় বাঙালিরশপিং সিজন বলতে পুজো আর এই চৈত্র মাস। যা এবার হলই না। মানুষের অভ্যাসের থেকে বাদ গেল এই কেনাকাটা। আর বিপুল সংখ্যক দোকানদার ও হকারের হয়ে গেল বিশাল ক্ষতি। চৈত্রমাসে যে সর্বনাশের কথা বাঙালি এতদিন কাব্যিক ভাবে পড়ে এসেছিল সেটাই এবার প্রত্যক্ষ করল রূঢ়ভাবে।
লকডাউনের আপাতত সময়সীমা এপ্রিলের শেষ দিন অবধি। আবার সেদিনই পয়লা বৈশাখ। মানে সেদিনও সবাইকে বাড়িতে থাকতে হবে। বেরনো চলবে না। ফলে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যে নববর্ষের গণেশ পুজো হয় তা বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে বাঙালির বড় প্রিয় হালখাতা। বন্ধ থাকবে দোকানে গিয়ে কেনাকাটা, বাংলা ক্যালেন্ডার পাওয়া। মিষ্টি মুখের অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যাবে।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
নতুন বছর আসবে, কিন্তু বড় ম্লান ভাবে। বড় একাকী হবে তার আগমন। আমরা তাকে দেখেও কিছু করতে পারব না। তাকে বরণ করার মতো অবস্থাই যে আমাদের এবার নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এমন অবস্থায় নববর্ষ পালন করতে না পারাকে নিয়ে হা-হুতাশ করা কি খুব দরকার? যেখানে সারা বিশ্ব এক অদ্ভুত অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেখানে একবছর নাহয় নববর্ষ না-ই পালন হল, তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?
আসলে আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার দুটো দিক আছে। একটি হল পরিমাণগত বেঁচে থাকা ও অন্যটি হলগুণগত বেঁচে থাকা। সারা বছরই আমরা এই পরিমাণগত বেঁচে থাকাতেই জড়িয়ে থাকি। সেই ঘুম থেকে উঠে রোজগার করতে যাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ। কাজের জায়গায় নানান সমস্যা ও খারাপ ব্যবহার সহ্য করা। আবার সব কাজ সেরে সেই ট্রেনে, বাসে মেট্রোতে যুদ্ধ করতে করতে গ্রামে, শহরে বা মফস্সলের বাড়িতে ফেরা। আর যাঁরা বাড়ির দেখাশোনা করেন তাঁদের প্রতিটা দিনই একই রুটিনের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া।
এসবের মধ্যে এই উৎসব আমাদের বেঁচে থাকার একঘেয়ে পরিমাণগত দিকটা সরিয়ে কিছুটা হলেও জীবনের গুণগত মান বৃদ্ধি করে। ওই একটা দুটো দিনের জন্য আমরা বেঁচে থাকার চাপ ও চিন্তা ভুলে যাই। আমাদের মনের নিভে আসা প্রদীপে নতুন করে তেল ঢালি। আরও কিছুদিন এই রোজকার লড়াই চালিয়ে নিয়ে যাবার রসদ পেয়ে যাই।
আরও পড়ুন: চাই প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সামঞ্জস্য
নববর্ষ আমাদের এই পরিমাণগত জীবনে এক ধরনের খুশির হাওয়া নিয়ে আসে। সকাল সকাল মন্দিরে লাইন লাগানোই হোক, নানান প্রতিষ্ঠানে পুজোই হোক, হালখাতা করতে যাওয়ার আনন্দই হোক, কিছু একটা কেনার খুশিই হোক, বইপাড়ায় নববর্ষের আড্ডাই হোক বা টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে গানসহযোগে অনুষ্ঠানই হোক। আমাদের, বাঙালিদের কাছে নববর্ষ বিশেষভাবে আনন্দের সময়। সারা বছরের নানান ভিনদেশি সংস্কৃতিতে ডুবে থাকা আমরা এই দিনে আবার কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও বাঙালি হয়ে উঠি। নিজের শিকড়ে ফিরে যাই। শাড়ি, ধুতি পাঞ্জাবি বেরোয় আলমারি থেকে। শুক্তো, শাকভাজা, মাছ, মাংস আর পায়েসের নানান বাঙালি পদ সাজিয়ে মানুষজনকে আহ্বান করতে বাধ্য হয় তথাকথিত মাল্টিন্যাশনাল রেস্তরাঁগুলো। আমরাও ইংরিজির পথে না গিয়ে নিজের মায়ের ভাষায় ‘শুভ নববর্ষ’ লিখে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানাই। কুশল নিই।
শুধু মেসেজে মেসেজে আর ফোনে ফোনেই এবার আমরা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাব। আর বাদবাকি সব পরেরবারের জন্যই নাহয় তোলা থাকবে। হ্যাঁ, মনখারাপ করবে। কিন্তু আমরা জানি, উপায় নেই। আগে আমাদের সুস্থ থাকতে হবে। সবাইকে ভালভাবে থাকতে হবে। মহামারির জন্ম দেওয়া এই ভাইরাসকে আলাদা করে তাকে মেরে ফেলতে হবে। আমরা যদি সত্যিই অমৃতের পুত্র হই তাহলে সামাজিক দূরত্বের মাধ্যমেই আমাদের বেঁচে থাকার সেই অমৃত মন্থন করে তুলে আনতে হবে এক সুস্থ পৃথিবীতে।
তার মাঝেই, প্রিয় বন্ধু কিছুদিনের জন্য দূরে গেলে যেভাবে মনখারাপ হয়, সেভাবে একটু হলেও মনখারাপ করব আমরা। মনখারাপ করব নতুন বছরের না-হওয়া নতুন জামাটার জন্য। সবাই একসঙ্গে বসে না-হওয়া আড্ডার জন্য। রেস্তরাঁয় হইহই করে না খেতে যাওয়ার জন্য। সিঁদুরের ফোঁটা লাগানো আমপাতা আর কচি ডাবের জন্য। দরজার দুই পাশে দাঁড় করানো কলাপাতার জন্য। আর আশা করব বছরের শুরুটা এমন করে হলেও বাকি বছরটা এমন যাবে না। আশা করব, এই বন্দিদশা ক্ষণিকের। আশা করব, বাঙালি নববর্ষের হালখাতার লাড্ডু আর শিঙারা খেতে না পারলেও রথের জিলিপি আর পাঁপড়ভাজা থেকে তারা বঞ্চিত হবে না। আর আশা করব, এবারের এই নববর্ষ মেসেজে মেসেজে কাটালেও রথের আগেই আমরা সবাই ফিরতে পারব আমাদের জীবনে। ফিরতে পারব ট্রাম বাসের ভিড়ে। মেট্রোর এসি-তে। খুচরো না-পাওয়া অটোচালকের রাগে। ফিরতে পারব অফিসপাড়ার ভাত-ডাল আর মুড়ি-বাতাসায়। স্কুলে বাচ্চা পৌঁছতে আসা মায়েদের রোজকার পিকনিকে। চায়ের দোকান আর কফিশপের আলোচনায়। ফিরতে পারব রোজকার কাজের বিরক্তি আর উইকএন্ডের স্বস্তিতে। ফিরতে পারব আমাদের সত্যিকারের বেঁচে থাকায়। আশাকরি, এই নতুন বছর আমাদের শেখাবে আরও সহিষ্ণু হতে। ধৈর্য ধরতে। শেখাবে বেঁচে থাকাকে আরও মূল্য দিতে। শেখাবেপ্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy