Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Poila Baisakh Special

স্বাভাবিক হও বাংলা, এই গোমড়াপনা মানায় না তোমাকে

কেটে যাবে এই দুর্যোগ। ফিরে আসবেই ফুরফুরে দিন। আমরা সমস্বরে বলব— ‘এস, সুসংবাদ এস।’ প্লিজ আর দেরি নয়।

লকডাউনে নববর্ষ। ফাইল চিত্র।

লকডাউনে নববর্ষ। ফাইল চিত্র।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২০ ১৬:৩৫
Share: Save:

সে গল্প একেবারে অমল শৈশবের। কানের কাছে গুরুজন গেয়ে রাখতেন, পয়লা বৈশাখ কোনও ঝঞ্ঝাট নয়, বায়নাবাজি, অবাধ্যতা নয়, কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি নয়, এমন কিছু নয় যাতে পিঠে দু’চার ঘা দিতে হয়। কারণ এই দিনটা যেমন কাটাবে, তেমনই কাটবে সারাটা বছর। ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনে আসা বাঙালি শিশুর পক্ষে বছরের মাঝখানের একটা নববর্ষ নিয়ে একটু বিভ্রান্তি ছিলই। কোন বছরটা কেমন কাটবে? এপ্রিল থেকে যেটার শুরু সেটা, নাকি জানুয়ারি থেকে যেটা শুরু হয়েছে, তার বাকিটুকু? সেই বিভ্রান্তি মাথায় রেখেই পয়লা বৈশাখ লক্ষ্মীসোনা হয়ে থাকার একটা চেষ্টা করা হত। নতুন বছর, নতুন জামা, নতুন প্যান্ট, দোকানে দোকানে নতুন খাতা আর সেই সঙ্গে বাংলা হোক-ইংরেজি হোক, নতুন ভাবে ভাল থাকার একটা গুড উইশ নিজের ভিতরেই ঘুরঘুর করত। সেই সব দিন আর নেই। থাকার কথাও নয়। সে সব গল্প একেবারে অমল শৈশবের। বড় জোর কৈশোরের।

আবার সামনে একটা আস্ত নতুন বছর। একটা আস্ত নববর্ষ। এবং এমন একটা নববর্ষ, যা বাঙালির ইতিহাসে কখনও এসেছে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি যেখানে দাঁড়িয়ে, তাতে নিষ্ঠুর রসিকতার মতো বলতে ইচ্ছে করে, এত ‘নতুন’ একসঙ্গে বাঙালি তার আবহমানে দেখেনি। বাঙালি কোন ছার, মানব সভ্যতাই এ জিনিস আগে ক’বার প্রত্যক্ষ করেছে, তা হাতে গুনে বলা যায়। বাঙালির অফিসিয়াল ইতিহাস তো মাত্র হাজার বছরের! এই হাজারটা বছরে কম মন্বন্তর আর মহামারি এ জাত পেরিয়ে আসেনি। কিন্তু এ বারেরটা যতটা ‘নতুন’ কিসিমের, আগেরগুলো তেমনটা ছিল না। এক অচেনা অসুখ, তার কোনও নিদান নেই, চিকিৎসা নেই, তার সামনে দুমড়ে পড়া একটা গোটা সভ্যতা—এ জিনিস ভগ্নস্বপ্নের কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস ছাড়া অন্যত্র সবিশেষ দেখা যায়নি।

এর মধ্যেই নববর্ষ। না, এ বছর নতুন জামাপ্যান্ট হবে না। বৈশাখের হলকা বাতাসের প্রথম ঝলক গায়ে মেখে ট্যালকম পাউডারের হালকা সুগন্ধের মতো ফুরফুরে বিকেলে কোনও সাহিত্য আড্ডা বসবে না বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিটে। ‘বৈশাখি আসর’-এর অজুহাতে নিধুবাবু আর শ্রীজাতকে একপাতে বসিয়ে বাঙালিকে প্যাকেজ বাঙালিয়ানা খাওয়ানোর চেষ্টা করবে না কোনও টিভি চ্যানেল। বাঙালির পাতে ‘বাঙালি খাবার’ তুলে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর রসিকতাও এ বছর স্থগিত রেস্তরাঁয়। কোনও পুরনো চালই আর চালা যাবে না এ বছর। এমনকি ‘হে নূতন’ গানটিও এ বছরের মতো তোলা রইল হারমোনিয়ামের ঢাকনার নীচে মলাটহীন হলুদ হয়ে যাওয়া খাতাটির পাতায়।

আশা, আগামীদিনে ফের দেখা যাবে এই ছবি। ফাইল চিত্র।

অথচ, ১৪২৭ এক আশ্চর্য বছর। বাঙালির অভিধানে ঢুকে পড়ল তিন তিনটে জম্পেশ শব্দ। ‘কোয়রান্টিন’, ‘আইসোলেশন’ আর ‘লকডাউন’। বাঙালি কোয়রান্টিনকে চিনত উনিশ শতক থেকেই। স্বামী বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থের ‘সুয়েজ খাল: হাঙ্গর শিকার’ পরিচ্ছেদেই ছিল কোয়রান্টিনের কথা। “১৪ জুলাই রেড সী পার হয়ে জাহাজ সুয়েজ পৌঁছুল। সামনে—সুয়েজ খাল। জাহাজে— সুয়েজে নাবাবার মাল আছে। তার উপর এসেছেন মিসরে প্লেগ, আর আমরা আনছি প্লেগ সম্ভবত— কাজেই দোতরফা ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়। এ ছুঁৎছাঁতের ন্যাটার কাছে আমাদের দিশী ছুঁৎছাঁত কোথায় লাগে!” এই ছুঁৎমার্গকে স্বামীজি ‘কারাঁটীন’ বলেছিলেন। সেই ছুঁৎমার্গ আজ আর মিশরে সুয়েজের নীলাভ জলে নয়, একেবারে বাঙালির চায়ের দোকানে, বাজারের মাচায়, মশারির চালে। এই সব দুর্যোগ কেটে গেলে পাড়ার মোড়ের গজলসায় কেউ কারওকে জমা নিলে বলা হবে— ‘মালটাকে কোয়রান্টিন করে দিল একেবারে।’ সোশ্যাল মিডিয়ায় কারওকে হ্যাটা করতে গেলে কমেন্ট বক্সে লেখা হবে— ‘দাও ওকে কোয়রান্টিন করে।’ এ যেন ফিরে এল শরৎবাবুর পল্লিসমাজ। একঘরে করার এক নতুন টার্ম— এই মাত্র।

আরও পড়ুন: কবি-রাজ রবীন্দ্রনাথ: পাঁচন দাওয়াই কি এখন করোনায় কাজ করবে?

এরই পিছে পিছে ‘আইসোলেশন’। একলষেঁড়ে, ডিপ্রেশন-বিলাসী বাঙালির পাতে একেবারে হাতে-গরম টার্ম। করোনা-দুর্বিপাক এক বার কাটতে দিন, দেখবেন ‘আইসোলেশন’-এর ছব্বা। কফিহাউসে এমন উক্তি শোনা যেতেই পারে— “কী, আজকাল দেখছি না কেন? আইসোলেশনে নাকি?” অথবা একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে তরুণ কবি বলে উঠতেই পারেন, “গত দিন দশেক আইসোলেশনে থেকে দেখলাম, নতুন কিছু লিখতে পারি কি না।’’ প্রবাদপ্রতিম কবিতা এই ভাবে বিনির্মিত হতে পারে— ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, আমি তিন মাস আইসোলেশনে থাকব।’

বঙ্গজীবনে ভয়ের অনুষঙ্গে কি বেঁচে থাকবে ‘লকডাউন’? পাড়ায় চাঁদা নিয়ে ঝামেলা হলে কি গেরস্তকে শুনতে হবে—‘বেশি কপচালে একেবারে লকডাউন করে দেব’? অথবা বাংলা ছবিতে এমন সিকোয়েন্স আসতেই পারে, যেখানে মস্তান হাতকাটা ছকু নায়িকার বাবাকে সন্ধের গলিপথে এই বলে চমকাচ্ছে—‘আর কোনও বাতেলা শুনতে চাই না। আমাদের কথা না শুনলে গোটা গুষ্টি লকডাউন করে দেব।’

রাজনৈতিক হুমকিতেও কি টার্ম হিসেবে চলে আসবে ‘লকডাউন’? বিরোধী নেতা হুমকি দেবেন, ‘আমাদের দাবি না মানলে, আগামী সাত দিন এলাকা লকডাউন করে দেব।’ শাসক দল বলবে, ‘বিরোধীদের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে আগামী সাত দিন আপনার এলাকায় লকডাউন পালন করুন।’ বাংলা গানে হানা দেবে ‘লকডাউন’। উত্তর-জীবনমুখী পর্বে ‘মগজে লকডাউন’ নিয়ে বাংলা রক পরিবেশিত হবে সিটি সেন্টারের ‘ফ্ল্যাশ মব’-এ।

এই সব ভোকাবুলারির পাশাপাশি এমন সব কথাও হয়তো শোনা যাবে, ‘নিজের মনটাকে একটু স্যানিটাইজ কর। না হলে তোমার সঙ্গে মেশা যাচ্ছে না।’ ফ্যাশনিস্তা বঙ্গললনার হাতব্যাগ থেকে আঁতেল বাঙালির বোহেমিয়ান ঝোলার ভিতরে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে স্যানিটাইজার। কথার লব্জে কি তা উঠে আসবে না? প্রেম কেটে যাওয়ার পরে বাঙালি যুবক কি বন্ধু মহলে বলবে না, ‘আমি এখন স্যানিটাইজড। আবার নতুন করে শুরু করব?’ করোনা-কঠোর দিন বিগত হলে কি থেকে যাবে না বার বার হাত ধোওয়ার অভ্যেস। ‘ও আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি’ বলে কি নিস্তার পাওয়া যাবে কোনও পুরনো হিসেব থেকে?

ফিরে আসবে হালখাতার সেই দিন। ফাইল চিত্র।

হবে। সব হবে। শুধু কাটতে দাও এই মেঘ। কত দিন, আর কত দিন শুধু উদ্বেগ আর আশঙ্কা বুকের ভিতরে চেপে একটা একটা করে দিন কাটানো যায়? রাষ্ট্রবিপ্লব বা মন্বন্তরেরও অন্ত অনুমান করা যায়। কিন্তু এ তো ‘যিস রাত কে সুবহ্‌ নেহি’-র চাইতেও কালান্তক! ফেসবুক জুড়ে একটাই আর্তি, আর কত দিন? কোয়রান্টিন, আইসোলেশন আর লকডাউন-কে কড়া রিয়্যালিটি থেকে বাকধারায় উঠে আসার জন্য দরকার স্বস্তি-সময়ের। একটা নিরবচ্ছিন্ন শান্ত, পড়ে থাকা বছর দরকার ঘুমঘুমির মাঠের মতো। যা পেরিয়ে আমরা পৌঁছব আমাদের চেনা বাংলায়। ১৪২৭ কি সেই বার্তা আনছে? শত মন্বন্তরেও মরিনি আমরা, মারির পর মারি পেরিয়ে এসেছি। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের কালেও তো জীবনছন্দে ঘাটতি পড়েনি বাঙালির! কবিতায়, গানে, ছবিতে দুঃসময়ের মোকাবিলা করেছেন সেই সময়ের সৃষ্টিশীলরা। পরে অমরত্ব পেয়েছে সেই সব কবিতা-গান-নাটক-ছবি। তবে কেন মুখ ভার করে নিজেকে বিষের পায়ে সমর্পণের খেলা?

কেটে যাবে এই দুর্যোগ। ফিরে আসবেই ফুরফুরে দিন। আমরা সমস্বরে বলব— ‘এস, সুসংবাদ এস।’ প্লিজ আর দেরি নয়। নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে এ বছর না হয় তোলা থাক নতুন জামার আহ্লাদ। শুধু প্রার্থনা— এই বছরই যেন ফিরে আসে আমাদের সেই সব দিন, আমাদের রাস্তার আড্ডার দিন, আমাদের চায়ের দোকানের গুলতানির দিন, আমাদের কলেজ স্ট্রিট আর অফিস ছুটির পরের ফুরসতের দিন-রাত। অবসরকে অবসরের চেহারাতেই ফিরে পেতে চাই আমরা। নিরবচ্ছিন্ন উদ্বেগ-মাখা লকডাউনের চেহারায় নয়। স্বাভাবিক হও বাংলা। এই গোমড়াপনা মানায় না তোমাকে।

আরও পড়ুন: অনলাইনে পয়লা বৈশাখ বাঙালি চালু করলেই পারে!

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali New Year Poila Baisakh Special
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy