Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Education

সাম্প্রদায়িক সংঘাতের প্রেক্ষিত ‘ভারতবর্ষ’ গল্প

মহামারি পরিস্থিতি চলছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউন। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পঠনপাঠন বন্ধ রয়েছে। তাই বলে তো সময় থেমে থাকবে না। পড়াশোনা জারি থাকুক। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়াদের জন্য বাংলা বিষয়।মহামারি পরিস্থিতি চলছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউন। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পঠনপাঠন বন্ধ রয়েছে। তাই বলে তো সময় থেমে থাকবে না। পড়াশোনা জারি থাকুক। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়াদের জন্য বাংলা বিষয় নিয়ে কলম ধরলেন আব্দুল খায়ের সেখ

আব্দুল খায়ের সেখ
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২০ ০৪:৫৭
Share: Save:

বর্তমান ভারতের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে সর্বাধিক স্পর্শকাতর’ বিষয় হল দেশবাসীর ধর্মীয় পরিচয় ও সংস্কার বোধ। তাই স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্যে স্বদেশের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে ঘুরে-ফিরে এসেছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে মানবধর্মের সংঘাতের বিষয়টি।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ‘ভারতবর্ষ’ গল্পে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের এই প্রেক্ষিতকেই প্লট বা আখ্যান হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তবে তিনি মানুষের সঙ্কীর্ণ ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই বলেছেন। দেশবাসীর ধর্মীয় মোহান্ধতার অসারতাকে তুলে ধরে মানবতাকে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ভারতবর্ষের মূল সুর যার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।

মূল আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখক পরিচিতি তুলে ধরা অনর্থক হবে না। ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’, ‘আনন্দ পুরস্কার’, ‘শরৎ স্মৃতি পুরস্কারে’র মতো একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ (১৯৩০-২০১২) জন্মসূত্রে মুর্শিদাবাদের মানুষ। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর মুর্শিদাবাদের খোশবাসপুর গ্রামে এক সাহিত্যিক পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। মা-বাবা দুজনেই অল্পবিস্তর সাহিত্যচর্চা করতেন। ফলে, অল্প বয়সেই তিনি সাহিত্যর প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম গল্প ‘কাঁচি’ প্রকাশিত হয়।

এর পর তাঁর লেখার ধারা থেমে থাকেনি। একের পরে এক উপন্যাস, ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন ‘নিশি মৃগয়া’, ‘মায়ামৃদঙ্গ’, ‘হিজল কন্যা’, ‘স্রোতে ভেসে আছি’, ‘তৃণভূমি’, ‘অলীক মানুষে’র মতো উপন্যাস এবং ‘ভালোবাসা ও ডাউন ট্রেন’, ‘মাটি’, ‘রক্তের প্রত্যাশা’, ‘মানুষের জন্ম’ প্রভৃতি ছোটগল্প। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘অলীক মানুষ’। আমাদের আলোচ্য ‘ভারতবর্ষ’ ছোটগল্পটি ‘সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের শ্রেষ্ঠগল্প’ (১৯৯৪) থেকে নির্বাচিত।

প্রথমেই বলে রাখি, দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে ইতিপূর্বে পড়ুয়ারা অবগত হয়েছ। সে ক্ষেত্রে ছোটগল্প থেকে তিন ধরনের প্রশ্ন হয়ে থাকে। এক, বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্ন, দুই, সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন ও তিন, রচনাধর্মী প্রশ্ন।

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্ন ও সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নের মান ‘এক’। রচনাধর্মী প্রশ্নের মান ‘পাঁচ’। ছোটগল্প থেকে একটি রচনাধর্মী, বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্ন পাঁচটি এবং সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী দু’টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। অর্থাৎ, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, বেশির ভাগ নম্বর বরাদ্দ থাকছে বহুবিকল্প ধর্মী এবং সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই পড়ুয়াদের এই প্রশ্নের দিকে নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বলা ভাল, মূল পাঠ্য বই পড়ার কোনও বিকল্প নেই। যে যত ভাল করে মূল পাঠ্য গল্পগুলিকে পড়তে পারবে, তার কাছে এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ততটাই সহজ হবে। গল্পগুলি পড়ার ক্ষেত্রে দ্রুত-পাঠের পাশাপাশি নিবিড় পাঠ খুব জরুরি। আর রচনাধর্মীর ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকে পাঠ্যবিষয় নির্ভর। এ ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের নিবিড় পাঠ অত্যন্ত কাজে আসবে।

‘ভারতবর্ষ’ গল্পের সূচনায় রাঢ় বাংলার একটি গ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে। যে গ্রামে বিদ্যুতের সুবিধা নেই। থাকার মধ্যে আছে একটি আড়ত, হাস্কিং মেসিন, একটি ইটের ভাটা। এবং একটি ছোট বাজার যেখানে বিদ্যুৎ রয়েছে। আশেপাশের গ্রামের মানুষের সন্ধ্যাবেলার আড্ডাস্থল এই বাজারের চায়ের দোকান।

রাঢ় বাংলায় জাঁকিয়ে শীত পড়ে। সে বার বৃষ্টিতে শীত আরও ধারালো হয়ে উঠল। মাঠে পাকা ধান থাকায় লোকের মেজাজ গেল বিগড়ে। চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে তারা অপেক্ষা করছিল একটা রোদ ঝলমলে দিনের। এর পাশাপাশি আল্লা-ভগবানের মুন্ডুপাত করছিল। এমন সময় সেখানে এক থুত্থুরে চেহারার জরাজীর্ণ বুড়ি লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসে হাজির হয়। সকলেই তাকে নিয়ে পড়ে। সে তেজের সঙ্গে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চায়ের দাম মিটিয়ে চলে যায়। আশ্রয় নেয় গ্রামের বুড়ো বটতলায়।

দিন কয়েক পরে বাদলা থামলে বটতলায় বুড়ির নিঃসাড় শরীর দেখা যায়। চৌকিদারের পরামর্শ মতো হিন্দুরা চ্যাংদোলা করে নদীর চড়ায় মৃতদেহ ফেলে আসে। কিন্তু বিকেলে দেখা যায় এক অদ্ভুত দৃশ্য, গ্রামের মুসলমানরা কবর দেবে বলে বুড়ির মৃতদেহকে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে। কারণ, তারা অনেকেই ‘কলেমা’ পড়তে শুনেছে বুড়িকে। এ কথা শুনে হিন্দুরা অনেকেই দাবি করে, বুড়ির মুখে তারা ‘হরিনাম’ শুনেছে। শুরু হয় দু’পক্ষের বচসা। মারামারির উপক্রম হয়। চৌকিদার কোনও ক্রমে যুযুধান দু’পক্ষকে থামাতে উদ্যত হয়।

এমন সময়ে বুড়ি উঠে বসে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উভয়পক্ষকে গালি দেয়। সে হিন্দু না মুসলমান— এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘আমি কি তা দেখতে পাচ্ছিস নে?’— বলে হাঁটতে হাঁটতে পড়ন্ত রোদের আলোয় আবছা হয়ে মিলিয়ে যায়।

গল্পের শেষে বুড়ির মিলিয়ে যাওয়া যেমন ধর্মান্ধ ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার দিকটিকে তুলে ধরেছে, তেমনই তার তীর্যক ভাষায় উত্তর ‘আমি কি তা দেখতে পাচ্ছিস নে?’— মানবতার দিকটিকেই ইঙ্গিত করে। সে দিক থেকে গল্পটি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের আত্ম-সমীক্ষণের ভাষ্য।

গল্পটি পড়ে আমাদের বুঝতে অসুবিধা নেই, কী ধরনের প্রস্তুতি আমাদের নিতে হবে। প্রথমেই বলি, বহুবিকল্প ভিত্তিক প্রশ্ন এরকম হতে পারে—

এক, ডাক পুরুষের বচন অনুসারে মঙ্গলবারের বাদলা চলে— ক. পাঁচ দিন, খ. তিন দিন, গ. সাত দিন ঘ. এক দিন। দুই, বুড়িকে ‘হরিবোল’ বলতে শুনেছিল— ক. ভটচাজ মশাই, খ. নিবারণ বাগদি, গ. মকড়ি নাপিত ঘ. ফজলু সেখ। যথার্থ উত্তরটি তোমাদের নির্বাচন করতে হবে। তবে এত ক্ষণে পাঠ্য বিষয়টি যারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছ, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাদের কাছে নেহাতই সাধারণ বিষয়, তা হয়তো তোমর অনেকেই উপলব্ধি করছো।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের ক্ষেত্রে— এক, ‘প‌উষে বাদলা’ কাকে বলে? দুই, ‘বচসা বেধে গেল।’ — বচসার কারণ কী? — এই জাতীয় প্রশ্নগুলোকে তোমরা দেখে রাখতে পারো। অন্যদিকে, রচনাধর্মী প্রশ্নের ক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখতে পারো। এখানে প্রশ্ন দু’ভাবে হতে পারে। এক, ‘ভারতবর্ষ’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার। দুই, ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটি ‘সাম্প্রদায়িকতার প্রেক্ষিতে রচিত হলেও এখানে মানবতার জয় ঘোষিত হয়েছে’—ব্যাখ্যা করো। এমন ধরনের বিষয়গুলি উত্তর দেওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে। অথবা, তিন, ‘হঠাৎ বিকেলে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল’— কোন দৃশ্যের কথা বলা হয়েছে? দৃশ্যটিকে অদ্ভুত বলা হয়েছে কেন?—এমন ভাবে উদ্ধৃতি তুলে প্রশ্ন থাকতে পারে। সুতরাং সামগ্রিক বিষয়ের উপর প্রশ্ন থাকতে পারে, আবার, উদ্ধৃতি তুলেও প্রশ্ন দিতে পারে।

উল্লেখ্য, তৃতীয় প্রশ্নটির ক্ষেত্রে তোমরা একটু সচেতন থাকবে। এমন ধরনের লাইন আরও একটি আছে— ‘তারপর‌ই দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য।’— এই লাইনটি আগেরটির সঙ্গে গুলিয়ে যেতে পারে। তোমাদের মনে রাখতে হবে, লাইন দু’টির প্রেক্ষিত আলাদা।

প্রথম ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, হিন্দু সমাজের লোকেরা চৌকিদারের নির্দেশে বুড়িকে মৃত ভেবে নদীর চড়ায় রেখে আসে এবং বিকেলে মুসলমানরা কবর দেবার জন্য সেই মৃতদেহকে পুনরায় গ্রামে নিয়ে আসে। বুড়ির মৃতদেহ নদীর চড়া থেকে ফিরিয়ে আনার দৃশ্যকে প্রথম ক্ষেত্রে অদ্ভুত বলা হয়েছে।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, মৃত মনে করা বুড়ির নড়ে-চড়ে বসাকে ‘অদ্ভুত দৃশ্য’ বলে নির্দেশ করা হয়েছে। এই রকম ভ্রান্তি এড়িয়ে চলার একমাত্র পন্থা পাঠ্য বিষয়টিকে ভাল ভাবে পড়া অর্থাৎ নিবিড় পাঠ। কেবল ছোটগল্প বলে নয়, নিবিড় পাঠ ব্যতীত কোনও বিষয়েই আমাদের সম্যক ধারণা জন্মাবে না।

লেখক নাজিরপুর বিদ্যাপীঠ (উচ্চ মাধ্যমিক)-এর সহশিক্ষক।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy