Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

অসুস্থ প্রবণতা 

যে ভাবে নেত্রীকে হাসির খোরাক বানানো হইল ‘মানসিক রোগগ্রস্ত’ বলিয়া, তাহাতে প্রমাণিত হয় যে বঙ্গীয় সমাজের এক বিরাট অংশ আজও মানসিক রোগগ্রস্ত তথা ‘পাগল’দের হাসির খোরাক হিসাবেই দেখে, অসুস্থ বলিয়া নহে।

জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে নবান্নে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র

জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে নবান্নে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৯ ০৫:৩৫
Share: Save:

রোগীর আত্মীয়-পরিজনদের হাতে চিকিৎসকদের হেনস্থার বিরুদ্ধে এক আন্দোলন সদ্য সমাপ্ত হইল। সমাজের নানা স্তর হইতে আন্দোলনে অকুণ্ঠ সমর্থনও আসিল। কিন্তু এই একই সমাজের অভ্যন্তরে যে বিরুদ্ধ স্বরকে হেনস্থা করিবার দানবীয় প্রবণতা ক্রমশ উদ্দাম হইয়া উঠিতেছে, তাহা লইয়া আন্দোলন কেন, সামান্য প্রতিবাদও দানা বাঁধিতে দেখা গেল না। অথচ চিকিৎসক নিগ্রহের তুলনায় তাহা কম মর্মান্তিক নহে। এতখানি অধৈর্য ও আক্রমণপরায়ণতা যে সমাজের ভিতর কোথায় দানা বাঁধিয়া থাকে, ভাবিলে স্তম্ভিত হইতে হয়। এবং যে কোনও বিরুদ্ধ স্বরকে এই ভাবে আক্রমণ করিবার প্রবণতাটির বিরুদ্ধে যে শুভবোধ জাগিয়া উঠিয়া ‘আর নহে’ বলিতে অপারগ হইতেছে, তাহা দেখিলেও অসুস্থ লাগিতে পারে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়াইয়াছে যে, যিনি যাহা বলিতেছেন, তাহাই যেন তাঁহার ভুবনে শেষ কথা। কেহ অন্য কিছু বলিলেই তাঁহারা পাগল কিংবা মানসিক বিকারগ্রস্ত। কিংবা শারীরিক ভাবে অসমর্থ কিংবা অসুস্থ।

সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ইহার দৃষ্টান্ত সুপ্রচুর, প্রাত্যহিক, বহুপরিচিত। তাহা সত্ত্বেও একটি ঘটনার উল্লেখ না করিয়া পারা যায় না। সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেও ‘পাগল’ তকমা দিয়া উন্মাদাশ্রমে পাঠাইবার নিদান হাঁকা হইল। মুখ্যমন্ত্রী যাহা করিয়াছেন, তাহা ঘোরতর অন্যায় হইতে পারে, তাঁহার কার্যের প্রতিবাদ অবশ্যই তাঁহাকে শুনিতে হইতে পারে, কিন্তু কোনও ভদ্র নাগরিক সমাজে সেই ক্ষোভের নিশানাটি হইবার কথা ছিল তাঁহার প্রশাসনিক ব্যর্থতা— অশালীন ব্যক্তিগত আক্রমণ নহে। যে ভাবে নেত্রীকে হাসির খোরাক বানানো হইল ‘মানসিক রোগগ্রস্ত’ বলিয়া, তাহাতে প্রমাণিত হয় যে বঙ্গীয় সমাজের এক বিরাট অংশ আজও মানসিক রোগগ্রস্ত তথা ‘পাগল’দের হাসির খোরাক হিসাবেই দেখে, অসুস্থ বলিয়া নহে। মানসিক রোগ লইয়া এই তীব্র তাচ্ছিল্য অত্যন্ত আপত্তিকর, বস্তুত ইহা এক গভীরচারী সামাজিক রোগ। ঘরোয়া আলোচনাতেও তাই বিরুদ্ধবাদী বা ভিন্ন আচরণকারীদের হামেশাই পাগল আখ্যা দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক দৃষ্টান্তটি এই ব্যাপ্ত প্রবণতার মধ্যেও বিশেষ ভাবে উদ্বেগজনক, কেননা প্রমাণিত হইল যে রোগ নিরাময়ের দায়িত্ব যাঁহাদের উপর, সেই চিকিৎসককুলও এই রোগে আক্রান্ত।

প্রশ্ন উঠিতে পারে, রঙ্গ-তামাশা কি তবে পরিত্যাজ্য? কখনওই নহে। কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণকে রঙ্গ-তামাশা বলা যায় না। সচেতন, দায়িত্বশীল নাগরিক সমাজ এই বিভাজনরেখা অতিক্রম করে না। নব্য বঙ্গসমাজ ক্রমশ সেই সীমারেখাটি ভুলিতেছে। আর তাহার সমালোচনার জায়গা লইয়াছে কুৎসিততম ব্যক্তিগত আক্রমণ। এবং যখন অনায়াসে এক জন মহিলা বিরুদ্ধবাদীকে যৌন হেনস্থার হুমকি দেওয়া যায়, এবং প্রশাসনিক প্রধানকে ‘পোস্ট মেনোপজ়াল সিনড্রোম’ আক্রান্ত বলা হয়, বোঝা যায় যে এই আক্রমণের মধ্যে কত প্রবল পুরুষতান্ত্রিক আস্ফালন রহিয়াছে। পুরুষ নেতা হাজার অন্যায় করিলেও কি বলা হয় যে, তিনি কোনও বিশেষ হরমোনের বশবর্তী হইয়া এমন কাজ করিয়াছেন? বলা হয় কি যে, তিনি সন্তানহীন বলিয়া মা-বাবাদের দুঃখ বুঝেন না? সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনাক্রমে প্রমাণ, এই ভয়ানক অসংবেদনশীলতা বাঙালি সমাজের গৌরবতিলক হইয়া বসিয়াছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengal Doctors Strike NRS Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy