জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সমর্থনে কলকাতার রাজপথে মিছিল।
শুক্রবার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অবধি মিছিলে হেঁটে, ফোলা পা নিয়ে ফিরে এসে এক প্রবীণ ডাক্তার নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেছেন এই কথাগুলো, ‘‘আমার সন্তানসম জুনিয়র ডাক্তারদের কুর্নিশ। আমাদের নতুন করে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে শেখালে।’’
কথাগুলো খেয়াল করা চাই। ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে, তার উত্তর লুকিয়ে এই পোস্টে। চিকিৎসাসঙ্কট দীর্ঘ হতে দেখে কেউ বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী এক বার এনআরএস-এ গিয়ে দুটো কথা বললেই কি আন্দোলন উঠে যেত না?’ কেউ বলেছেন, ‘ও তো মিটেই যাচ্ছিল, মুখ্যমন্ত্রী এসএসকেএম-এ গিয়ে আরও চটিয়ে দিলেন কেন?’ কারও প্রশ্ন, ‘এই কি সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি সবার আগে ছুটে যেতেন বিপন্নের পাশে?’ উত্তর না খুঁজে পেয়ে অনেকে মুখ্যমন্ত্রীর ঔদ্ধত্য, অহংবোধকে দায়ী করেছেন। কিন্তু বিষয়টা যখন এত গুরুতর, তখন এমন চটজলদি বিশ্লেষণ ঠিক নয়। ভাবতে হবে, মুখ্যমন্ত্রী যদি চাইলেই পারতেন, তা হলে চাইতে পারলেন না কেন?
পারলেন না, কারণ তাঁর প্রশাসনের যে পদ্ধতি গত সাত বছর এ রাজ্য দেখেছে, তাতে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দায়বদ্ধতা আর দলীয় নেতার বশ্যতাস্বীকার, এ দুটোর তফাত কমতে কমতে প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সে তফাত করেন না, তা রাজ্যবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যখন তিনি ডাক্তারদের প্রতিবাদকে ‘রাজনৈতিক’ বলে দাগিয়ে দিলেন। অথচ প্রতিবাদের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল মেডিক্যাল কলেজে দলীয় রাজনীতির আধিপত্য। এটা কাকতালীয় নয় যে, শিক্ষকদের গণপদত্যাগে রাশ টানতে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে চিকিৎসক-নেতা নির্মল মাজিকে কলেজ অধ্যক্ষের ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। এই নেতার জন্যই একটি সবুজ তোয়ালে মোড়া চেয়ার রাখা থাকত অধ্যক্ষের চেয়ারের ঠিক পাশে। কেন বার বার অধ্যক্ষ বদলাচ্ছে অথচ নেতার চেয়ার সরছে না, গত বছর এই প্রশ্ন করতে এক প্রবীণ শিক্ষক-চিকিৎসক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘সকলেরই চাকরির ভয়, প্রত্যন্ত প্রান্তে বদলির ভয়। কার ঘাড়ে ক’টা মাথা রয়েছে যে নির্মল মাজির চেয়ার সরাবে।’’
শুধু রোগীর প্রতি ডাক্তারের, আর ডাক্তারের প্রতি রোগীর দুর্ব্যবহারের মধ্যে এই আন্দোলনের ব্যাখ্যা খুঁজলে হবে না। চাকরি-করা ডাক্তারের প্রতি রাজনীতি-করা ডাক্তারের দুর্ব্যবহার, তাকেও হিসেবে রাখতে হবে বইকি। এই আন্দোলনের সব চাইতে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক নয়। তেমন মুহূর্ত দু’টি। একটাতে নির্মল মাজিকে ঘিরে ধরে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দিচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তাররা, পুলিশ তাঁকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার পরও গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ চালাচ্ছেন। অন্যটায় আর এক চিকিৎসক-নেতা শান্তনু সেনের প্রতি আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারদের স্লোগান, ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ, ফিরে যাও ফিরে যাও।’
রাজনৈতিক নেতা কী ভাবে বার বার অতিক্রম করেছেন প্রশাসনকে, তার অজস্র উদাহরণ মেলে প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে। চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণের প্রধান যন্ত্র— বদলির ভয়। বদলি আটকানোর দরবার করতে ডাক্তাররা নেতাদের কাছে গেলে তাঁদের বসার চেয়ার অবধি জোটেনি। স্বাস্থ্যভবনের কর্তারা অধিকাংশই রাবার স্ট্যাম্প হয়ে থেকেছেন। জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘট এ রাজ্যে কম হয়নি, বরাবরই মেডিক্যাল শিক্ষা অধিকর্তা আর স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে ডাক্তারদের বৈঠকের পর তা উঠেছে। এ বার কোনও প্রশাসনিক কর্তার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি জুনিয়র ডাক্তাররা। মেডিক্যাল কলেজে পাঁচ বছর কাটিয়ে তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, কে হেলে আর কে কেউটে।
অতএব বৈঠক থেকে কী প্রাপ্তি হল, সে প্রশ্ন করে লাভ নেই। ওই বৈঠকটাই প্রাপ্তি। ওটাই প্রতিবাদের স্বীকৃতি। নির্মল-শান্তনুদের পেরিয়ে ডাক্তারদের কথা পৌঁছল মুখ্যমন্ত্রীর কানে (এক চিকিৎসকের কথায়, এই নেতারা ‘জ্যামার’-এর কাজ করছেন) এবং, কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও, জনসমক্ষে এক বৈঠকে তৃণমূল-বিজেপি-সিপিএম নির্বিশেষে ‘ডাক্তার’ পরিচয়কে স্বীকৃতি দিতে হল মুখ্যমন্ত্রীকে। যদি মনে হয়, ‘এর জন্য এত?’ তা হলে মনে রাখতে হবে, ডাক্তারদের সংগঠনে দলীয় দখলদারি চলছে দীর্ঘ দিন। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল নির্মল মাজির নিয়ন্ত্রণাধীন, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন শান্তনু সেনের। ফলে ডাক্তারদের কথা বলার জায়গা হারিয়ে গিয়েছিল। কোন রোগী ভর্তি হবেন, কার পরীক্ষা আগে করা দরকার, কাকে কত দিন ভর্তি রাখতে হবে, এমন নিপাট মেডিক্যাল সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে, কোন বিভাগের কী যন্ত্রপাতি মঞ্জুর করা দরকার, কোন উদ্যোগ অগ্রাধিকার পাবে, এমন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, সর্বত্র আধিপত্য দেখা গিয়েছে দলীয় নেতাদের— যাঁদের কিন্তু পরিষেবার সহজলভ্যতা কিংবা মান, কোনও বিষয়ে দায়বদ্ধতা নেই, আগ্রহও নজরে আসেনি।
তাই, যা শুরুতে ছিল জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তার দাবি, তা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘুরে গেল সব ডাক্তারদের মর্যাদার স্বীকৃতির লড়াইতে। জুনিয়রদের সমর্থনে শয়ে শয়ে সিনিয়র ডাক্তার পদত্যাগ করলেন, এ রাজ্যে মেডিক্যাল কলেজে শাসক-বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। ঠিকই, এটা ‘টোকেন’ পদত্যাগ। এ-ও ঠিক যে, সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই, এমন নয়। তবু এ কথাটা অস্বীকার করা চলে না যে, এ হল দলীয় আধিপত্য-সর্বস্ব প্রশাসনের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর। অনেকে বলছেন, ‘জয় হয়েছে দু’পক্ষেরই’, কিন্তু তাতে সত্যটা আবছা হয়ে যায়। লড়াইটা কী নিয়ে চলছিল, সেটা মনে রাখতে হবে। গেট চিরকালই ছিল, রক্ষীও আছে, কিন্তু ‘আমি অমুকের লোক’ বলে পঞ্চাশটা লোক ইমার্জেন্সির ভিতরে ঢুকে এলে রক্ষী কেন, সুপারও কিছু করতে পারেন না। আধিকারিকের উপর নেতার ছড়ি ঘোরানো, আর ডাক্তারের মাথায় গুন্ডার ডান্ডা, এ দুটোর সাক্ষাৎ যোগ রয়েছে। জুনিয়র ডাক্তারেরা অবশ্য বৈঠকে সে কথাটা বলতে পারেননি। হয়তো সাহসে কুলোয়নি, কিংবা হয়তো ভরসা করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর উপর। তিনিই দলকে সংযত, প্রশাসনকে সক্রিয় করবেন, এটাই ভরসা।
কী করবেন মুখ্যমন্ত্রী? বার বার দেখা যাচ্ছে, যখন দলীয় আধিপত্যের জেরে মস্ত সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, তখন প্রশাসনিক প্রতিকার খোঁজা হচ্ছে। যেমন, কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া এ বছর সম্পূর্ণ অনলাইন করা হল, যাতে ছাত্রনেতাদের বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু স্কুলে, মাদ্রাসায় নিয়োগে দলীয় রাজনীতি-প্রসূত সঙ্কট সমাধানের জোর শিক্ষা দফতর খুঁজে পাচ্ছে না। কৃষি সমবায়ে নির্বাচন এড়াতে হয় অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বসছে, নয় মনোনীত প্রার্থী দিয়ে বোর্ড গঠন হচ্ছে। তাতে সমবায়ের মৌলিক চরিত্র নষ্ট হচ্ছে, কাজ ব্যাহত হচ্ছে। পঞ্চায়েতের উপর রাজনৈতিক আধিপত্যের ফাঁসে গৃহনির্মাণ প্রকল্প মার খাচ্ছে, তা তৃণমূল দলও স্বীকার করে। অন্য দিকে, সরকারের বিরুদ্ধে যেখানে বিচার পেতে পারত নাগরিক, সেই তথ্যের অধিকার কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, দলঘনিষ্ঠদের কবলে ঠুঁটো জগন্নাথ। ফলে হস্টেল থেকে চাকরি, যে কোনও দাবিতে অনশনে বসতে হচ্ছে ন্যায়-বঞ্চিতদের। ‘বিরোধী’ থেকে ‘প্রতিবাদী’ স্বীকৃতি পেতেই প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা এত জরুরি বলেই মাত্র এক সপ্তাহে প্রশাসনিক শীর্ষকর্তার দেখা মিলল।
মেডিক্যালে কর্মবিরতির সাত দিন বহু কষ্ট পেলেন রাজ্যবাসী, অপূরণীয় ক্ষতি হল বহু পরিবারে। সেই বেদনা-বিষাদের কৃষ্ণমেঘের পাশে রুপোলি আভাস যদি কিছু থাকে, তা হল ক্ষিপ্ত, অধৈর্য নেত্রী থেকে সুবিবেচক, ধৈর্যশীল প্রশাসকের ভাবমূর্তিতে মমতার বিবর্তন। নেতা মানুষের প্রত্যাশা তৈরি করেন, আবার মানুষের প্রত্যাশাও তৈরি করে নেতাকে। আত্মসম্মান বজায় রেখে সরকারি পরিষেবা প্রদান, এবং গ্রহণ— নাগরিকের প্রত্যাশা এটাই। শতকষ্টেও ডাক্তারের প্রতি নাগরিকের সমর্থন এটাই বোঝায় যে, নেতার অনুগ্রহ সে চায় না, হুমকিও অসহ্য। দলীয় রাজনীতি নাগরিককে নিজভূমে বহিরাগত করে তুলেছে। এ ভাবে বাঁচা যায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy