Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

এ বাউল চলেছে কোথায়

বীরভূম জেলায় কোনও বাউলই বোধহয় আর সাধনপথে নেই। থাকলেও দু-এক জন খুব আড়ালে আছেন। কেউ তাঁদের কথা সে ভাবে জানেন না। প্রকৃত বাউলের বড়ই অভাব আজ। অথচ বাউল হিসেবে সরকারি কার্ডধারী লোকগানের শিল্পী সংখ্যা এ জেলাতেই ছশোর বেশি। লিখছেন আদিত্য মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতন চিরকাল বাউল আর বাউলের গানকে লালন করে এসেছে। ক্ষিতিমোহন সেন এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে গরুর গাড়িতে চেপে কেঁদুলির পৌষ সংক্রান্তির মকর মেলায় গিয়েছেন।

গান গেয়ে চলেছেন বাউলেরা। জয়দেব-কেঁদুলির মেলায়। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

গান গেয়ে চলেছেন বাউলেরা। জয়দেব-কেঁদুলির মেলায়। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৩৪
Share: Save:

যদি বলি বীরভূমে আর বাউল নেই, তা হলে অনেকেরই সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হবে। কিন্তু এটাই সত্যি। এখন আমরা যাদের গেরুয়া বা গুদুরি গায়ে ভাবের গান, তত্ত্বের গান গাইতে দেখি, তাঁরা আসলে ‘গায়ক বাউল’। ধর্মেকর্মে আখড়াবাসী নন প্রায় কেউই। বীরভূমের প্রাচীন আখড়াগুলি এখন সুখী গৃহকোণ। অথবা জমিসম্পত্তির যন্ত্রণায় জীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত। সব আশ্রমেই প্রায় উৎসব-অনুষ্ঠান-সাধন-ভজন-গানের আলোচনা উঠে গিয়েছে। রসকলির ফারাককথা, একতারার চরণ-চারণ, গাবগুবির ঠাঁটবাট, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে নাচ অথবা কোমরের বাঁয়াতে তাল তুলে উচ্চ লম্ফন—এ সব আর ‘গায়ক বাউল’-এরাও পারেন না। মঞ্চে এখন সব তারের যন্ত্র। ব্যাঞ্জো-কিবোর্ডের আখরমালায় ধরা বাউলের গান। একতারার গাবগুবিতেও তারের সংযোগ।

তবে, এটা মানতেই হবে, এর ফলে বাউল গান শ্রুতি মধুর হয়েছে আরও। দেশ-বিদেশের শ্রোতা দর্শক তা গ্রহণ করেছেন ভাল ভাবেই। আর এর ফলেই প্রতি রাতে কয়েক ঘণ্টার অনুষ্ঠান করে বাউলদের রোজগার মন্দ হচ্ছে না। দিনজীবী বাউল উঠে আসছেন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ বিত্তে। সাধারণের মতোই এসি, গাড়ি প্রভৃতি প্রয়োজন পড়ছে। পাচ্ছেনও। বাউল সঙ্গীতের বাহিরাণাই তাঁকে দিয়েছে এই সম্মান, প্রতিপত্তি। ধর্মের খোলস খুলতে পেরেই এসেছে এই আভিজাত্য। এ বড় আনন্দেরই খবর। মাটির মমতা মাখানো সুর, গানের দর্শন— সবই তো আছে। শুধু সময়ের সঙ্গে পা মেলাতে গিয়ে গৌণধর্মী বাউল তার প্রকৃতি সাধনা-সহ অন্যান্য গুপ্ত আচরণবিধিকে সরিয়ে রেখেছে। এখন স্বরলিপিহীন এই বাউল গান বিশিষ্ট শিল্পীরাও গাইছেন নিজের মতো করে। শিক্ষিত-পরিশীলিত-ধ্রুপদী গানের শিল্পীরাও ঢুকে পড়ছেন বাউল গানে। তাতেই অসুবিধা হচ্ছে দীনজীবী ভিক্ষাজীবী ট্রেনে-বাসে গেয়ে পেট চালানো বাউলদের।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতন চিরকাল বাউল আর বাউলের গানকে লালন করে এসেছে। ক্ষিতিমোহন সেন এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে গরুর গাড়িতে চেপে কেঁদুলির পৌষ সংক্রান্তির মকর মেলায় গিয়েছেন। ফিরে এসে কবিকে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কোনও দিন কেঁদুলির মেলায় যাননি। বাউলের টানেও না। বরং পারুলডাঙার নবনীগোপাল দাসকে আহ্বান জানিয়ে শুনেছেন তাঁর গান। নবনীগোপালের জন্য দু-একটি গানও লিখেছেন। অন্য দিকে, লালন ফকিরের গানের দেহতত্ত্ব, সহজতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, ভাব সম্মিলন, মানুষ ভজন এবং জাতিভেদহীনতা উপনিষদের কবিকে আকৃষ্ট করেছিল।

১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবরে ‘হিতকরী’ পত্রিকার মতে, ১১৬ বছর বয়সে লালনের মৃত্যু হয়। আর ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ যান শিলাইদহে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন ফকিরের দেখা হয়নি। অন্যদের কন্ঠে তিনি লালনের গান শুনেছেন। ছেঁউরিয়ার লালন মাজারের ধারেপাশে এখনও একটি গুঞ্জন শোনা যায়, ‘রবীন্দ্রনাথ নাকি লালন সাঁই-এর গান লেখা মূল খাতাটি এনেছিলেন। কিন্তু আর ফেরত দেননি’। যদিও এ অভিযোগের যথার্থ উত্তর দিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন, জমিদারি এস্টেটের কর্মী বামাচরণ ভট্টাচার্য ওই খাতাটির গানগুলি নকল করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ তার থেকেই কুড়িটি বেছে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’তে প্রকাশ করেন। এর পরেই সুধী জনের নজরে আসে বাউল এবং বাউলগান। এর পর শিলাইদহ থেকে স্থায়ী ভাবে শান্তিনিকেতন চলে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ও-পার বাংলার লোকায়ত মরমি সুর আর রাঢ় বাংলার রুক্ষ রৌদ্ররসে ভেজা সুরের সমন্বয় তাঁকে আকুল করেছে। তিনি উভয় ক্ষেত্রেই খুঁজে পেয়েছেন উপনিষদের বার্তা। আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরেছেন বাংলার বাউলগানের আন্তরসত্তাকে। মূলত তিনি এবং তাঁর শান্তিনিকেতনই লালন ফকির ও বাউল গানের আবিষ্কারক ও প্রচারক।

বাউলের তথা লোকায়ত সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রাধান্য পায়নি কোনও দিন, মূর্তি পুজোও সেখানে গুরুত্বহীন। তাই যখন লালন গাইলেন—‘‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে...’’, তখনই প্রিয় হয়ে উঠলেন তিনি। অবশ্য ভারতের মাটিতে বহু আগেই মানব মহাসম্মিলনের গান গেয়ে গিয়েছেন মহা-সাধকেরা। নানুরের কবি দ্বিজ চণ্ডীদাস তো কবেই বলেছেন, ‘‘সবার উপরে মানুষ সত্য / তাহার উপরে নাই’’।

তার পরে ১৪৭৪-এ নিত্যানন্দ, ১৮৮৬-তে চৈতন্য দেব মনুষ্যত্ব, মানবতা আর মানব প্রেমের আলোকমালায় সাজিয়ে দিয়েছেন এ ভারতভূমি। নিত্যানন্দের ছেলে বীরচন্দ্রই মূলত তথাকথিত পতিত-অন্ত্যজ-ব্রাত্য জনকে বৈষ্ণবের ছত্রচ্ছায়ায় এনে হাজির করেছেন, মর্যাদা দিয়েছেন। আউল-বাউল-সাঁই-দরবেশ -কর্তাভজা-রামকানালি এমন বহু গৌণ গোষ্ঠী সাধন পথের ভিন্নতা সত্তেও মানবপ্রেম ও সম্মিলনের বার্তাই দিয়ে এসেছে। সিরাজ সাঁই, লালন ফকির, দুদ্দু শাহ থেকে সমস্ত বাউল জনই সেই পথের পথিক। বরং লালনের থেকে দুদ্দু আরও খানিকটা এগিয়ে। তিনি তখনই বলতে পেরেছিলেন—‘‘জাতাজাতি সৃষ্টি করে ভারতকে শ্মশানে দিলে...’’।

বাংলাদেশের বাউলেরা সাদা বসন ব্যবহার করেন, সেখানে এ-পার বাংলার বাউলদের পরনে থাকে গেরুয়া বা বহুছিটের গুদুরি। আঞ্চলিক শব্দ ও সুর দু’পারকেই প্রভাবিত করেছে। জয়দেব-কেঁদুলির মেলায় গেলে এ সত্য প্রমাণিত হয়। এই মেলাতেই বিনা নিমন্ত্রণে লক্ষ বাউল বা শিল্পী আসেন। জয়দেব কবিকে গুরু মেনেই এই বাউল সমাবেশ। জনশ্রুতি, এখানের ‘মন্দিরা’ মৌজায় ছিল তাঁর পর্ণ কুটির আর রাধামাধবের প্রাচীন মন্দির। সে সব আর কিছু নেই। সব চলে গিয়েছে অজয় নদের গর্ভে। এখনকার সুন্দর টেরাকোটা অলঙ্কৃত মন্দিরে বিরাজ করেন রাধাবিনোদ। বৃন্দাবন যাওয়ার পথে কবি জয়দেব তাঁর আরাধ্য রাধামাধবকে নাকি সঙ্গেই নিয়ে গিয়েছেন—এমনটাই মনে করা হয়। বর্তমান মন্দিরটি বর্ধমানের মহারানি ব্রজকিশোরী তাঁর সভাপণ্ডিত, কেঁদুলির যুগলকিশোর মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় দশকে নির্মাণ করে দেন। কেঁদুলির তীর্থক্ষেত্রে গ্রামীণ একটি মেলা ছিলই, সেখানেই আসতে শুরু করলেন বাউল-ফকির-কীর্তনীয়ারা। গৌণধর্মী নানা সাধক জনের সাধনভূমি হয়ে উঠল শ্মশানের কোল ছুঁয়ে থাকা কেঁদুলি। জনমহলে ‘বাউলমেলা’ নামে পরিচিত হলেও, মেলাটি ক্রমশ বাউলদের বিতর্কিত কিছু কাজকর্ম এবং কীর্তনীয়াদের দখলে চলে যাচ্ছে।

সত্যিকারের বাউল থাকেন সাধন-পথে। সে পথে অনেক কিছুই নিষিদ্ধ। পরমার্থ আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে মনের মানুষের সন্ধানে ব্রতী হন এক জন বাউল। শিষ্য পরম্পরায় চলে সে সাধনা। কিন্তু, বীরভূম জেলায় কোনও বাউলই বোধহয় আর সাধনপথে নেই। থাকলেও দু-এক জন খুব আড়ালে আছেন। সামনে আসনে না। কেউ তাঁদের কথা জানেনও না। প্রকৃত বাউলের বড়ই অভাব আজ। অথচ বাউল হিসেবে সরকারি কার্ডধারী লোকগানের শিল্পী সংখ্যা এ জেলাতেই এখন ছশোর বেশি। অধিকাংশ বাউল শিল্পীর এখন সাধারণের মতো ভরা সংসার।

এখন বাউল গান জয় করেছে বিশ্ব। গায়কদের হাতে পয়সা এসেছে। এ বড় আনন্দের। শান্তিনিকেতন থেকে কেঁদুলির অজয় তট পর্যন্তই সে গতিধারাই প্রসারিত। অন্যত্রের অন্ধকার সরকারি কার্ডখানির অবলম্বনেই আলো-আঁধারে বাঁধা।

লেখক কবি ও গবেষক, মতামত নিজস্ব

অন্য বিষয়গুলি:

Baul Singer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy