Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

বিষধোঁয়া আর বিষধুলোয় মরণাপন্ন জনপদের কাহিনি

পাহাড়ি নদীর স্বচ্ছ জল আজ কালো। বাড়ির টিনের চাল ফুটো করে দিচ্ছে দূষিত ধুলো। বিপন্ন বক্সার কথা লিখছেন শুভজিৎ বসুদূষিত বাতাসে প্রবল শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তাই এলাকার মানুষজন নিত্য নাক-মুখ ঢেকে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেন। এলাকার প্রতিটি ঘরে এখন পেটের অসুখ।

এখন পাহাড়ি নদী বসরার শীত জলের সেই অতীত আকর্ষণ ঘুচে গিয়েছে!

এখন পাহাড়ি নদী বসরার শীত জলের সেই অতীত আকর্ষণ ঘুচে গিয়েছে!

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৭:০৪
Share: Save:

অতি বিষাক্ত কার্বাইড দূষণে বসরা নদীর ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন। বক্সা অরণ্যের বুক বেয়ে বইছে পাহাড়ি নদী বসরা। এই বক্সা অরণ্যের পশু চিতাবাঘ, হরিণ, হাতি, বাইসন এই জলের উপরই নির্ভরশীল। বিগত কয়েক বছর আগে এই বসরা নদীর জলেই মিলত বহু রকমের মাছ। এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা ছাড়াও এই নদীতে মাছ ধরতেন আশেপাশের চা-বাগানের শ্রমিকরাও। ভুটানের পাহাড় থেকে নেমে আসা জলে চলত লোকালয়ে সেচের কাজ। কিন্তু পরিচিত সেই ছবি আজ বদলে গিয়েছে। এখন প্রতিদিন দবষণের সঙ্গে অসম লড়াই করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয় মানুষজনেরা।

এখন পাহাড়ি নদী বসরার শীত জলের সেই অতীত আকর্ষণ ঘুচে গিয়েছে! বর্তমানে বসরা নদীর জলে হাত বা পা দিলেই শরীর জ্বলতে শুরু করে। লাল হয়ে যায় চামড়া। শরীরে রীতিমতো ফোস্কা পড়ে যায়। এই নদীর স্বচ্ছ জলকে চোখের সামনে ঘোলাটে হয়ে উঠতে দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এখন বসরার জল কোথাও কোথাও হয়ে উঠেছে কুচকুচে কালো। নদী জুড়ে গেঁজে ওঠার মতো সাদা ফেনা ভাসছে।

এক ডাকে সবাই যাকে চেনে, সেই বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প আজ চূড়ান্ত ভাবে বিপন্ন। এই প্রকল্পের কর্মীদের চোখেমুখে এখন নিত্যদিনই আতঙ্কের ছাপ। তাঁরা সকলেই মনে করছেন যে, দূষণের কারণে এই ব্যাঘ্র প্রকল্পের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালানো রীতিমতো দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে।

সকলের চোখের সামনে দিনের পর দিন ধরে অবাধে চলছে নদীর উৎসের মুখে বেপরোয়া ভাবে বিষাক্ত ডলোমাইট উত্তোলন। আর এই শিল্পাঞ্চলের পরিত্যাক্ত বর্জ্যে বর্তমানে বসরা নদী বিষাক্ত রূপ ধারণ করেছে। বনকর্তাদের বক্তব্যেও প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে আরও বড় কোনও বিপর্যয়ের আশঙ্কা।

শুধু জঙ্গল সংলগ্ন এলাকাই নয়, আলিপুরদুয়ার জেলার পাহাড় সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলও এখন দূষিত আবহাওয়া এবং বিষাক্ত পরিবেশের কবলে। কালচিনি ব্লকের রাঙামাটি চা-বাগানের পাশেই প্রতিবেশী দেশ ভূটান। সে দেশের সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে পাশাখা শিল্পাঞ্চল। সেখানে মোট ৪৬টি কারখানা বর্তমান। সেই কারখানাগুলির সবই মোটামুটি সিলিকন, কাচ, লোহা ও কার্বাইডের। এই সব কারখানা থেকেই কালো মেঘের মতো বিষ প্রতিদিন সমতলে চলে আসে। সকলেই অবগত যে, সেই দূষণের কারণেই কালচিনি ব্লকের রাঙামাটি চা- বাগান এলাকার বাসিন্দারা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। প্রায় সারাবছরই তাঁদের লেগে রয়েছে নানা ধরের কঠিন চর্মরোগ। বিভিন্ন বয়সের লোকেদের হচ্ছে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা। শিশু আর প্রবীণদের সমস্যা হচ্ছে সব চেয়ে বেশি। যখন-তখন মানুষের মৃত্যু ঘটছে। মরছে বিভিন্ন গবাদি পশুও। কারখানার কালো মেঘের মতো বিষধোঁয়ার ছোঁয়া লাগতেই সবুজ গাছপালা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। অরণ্য ধংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। চাষের জমি বন্ধ্যা জমিতে পরিণত হচ্ছে।

মাছ ধরতে নদীর জলে নামলেই এলাকার মানুষজনের শরীর বিষাক্ত হয়ে উঠছে। মানুষের এই কঠিন পরিণতিতে বনকর্মীরাও রীতিমতো সরব। তাঁদের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণও রয়েছে। তাঁরা আশঙ্কা করছেন যে, এই দূষণে মানুষের এই পরিণতি হলে বন্যপ্রাণীদের অবস্থা কী হবে! নদীর মাছ হু-হু করে কমে যাচ্ছে। জলের উদ্ভিদ সব মরে যাচ্ছে।

শুধু কি কার্বাইডের দূষণ! নদীর দেহ জুড়ে ডলোমাইটের পসরা। বহু আগে পূর্বে এখানকার বাসিন্দারা নদীর জলকে পানীয় হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিছু বছর ধরে বন্যায় বিঘার পর বিঘা জমিতে মিশেছে ডলোমাইট মিশ্রিত বিষাক্ত জল। তাতেই জমি শুকিয়ে কাঠ! ডলোমাইটের গুঁড়ো পাহাড় থেকে ভেসে সমতলে নামছে। এলাকার মানুষের ঘরদোর সব সাদা হয়ে যাচ্ছে। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে রেখেও তেমন কোনও লাভ হয় না এখানে আর! ঘরের বাইরে বেরোলে তো কথাই নেই!

দূষিত বাতাসে প্রবল শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তাই এলাকার মানুষজন নিত্য নাক-মুখ ঢেকে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেন। এলাকার প্রতিটি ঘরে এখন পেটের অসুখ।

পানীয় জল থেকে রান্না করা খাবার— ডলোমাইট আর কার্বাইডের বিষে কখন যে সব গেঁজিয়ে উঠছে, তার টেরটুকুও কেউ পান না! পরিস্থিতি এমনই যে, বাড়ির টিনের চালও বিষাক্ত কার্বাইডের ধুলোয় ফুটো হয়ে যাচ্ছে! সব গ্রাস করছে বিষধুলো, বিষধোঁয়া! গোটা অঞ্চলে প্রচুর গরিব মানুষজনের বসবাস। তাঁদের পক্ষে ভিটেমাটি ছেড়ে উপায়ও নেই অন্য কোথাও চলে যাওয়ার। ক্রমশ মৃত্যুর দিকে হেঁটে চলেছেন বুঝতে পারলেও তাঁদের করার কিছুই নেই!

একমাত্র সরকারই পারে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে। সরকারের তরফে যদি এই দূষণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়, তবেই হয়তো কিছুটা আশার আলো দেখতে পারেন এলাকার বাসিন্দারা। কিন্তু গোটা বিষয়টি আবার অান্তর্জাতিক স্তরের বিষয়ও।

এর থেকে পরিত্রাণের উপায় তবে কী! কোনও প্রান্ত থেকেই মিলছে না কোনও সদুত্তর! এক সময়ের শান্তির নীড়, সুস্থিত জনবসতির এই অঞ্চল শেষ পর্যন্ত বাঁচবে কী করে, কে সেই পথ দেখাবে?

(লেখক নকশালবাড়ির বেঙ্গাইজোত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Basra River Pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy