শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির দেবী কাত্যায়নীর মাটির চালিতে মাটির পাখি
দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে চালির পাখি। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্য। আগামী প্রজন্ম পুরনোকে জানুক, চিনুক এইটুকু চান পুরনো দিনের শিল্পীরা।
আশ্বিনের এক বৃষ্টিভেজা দিন। কৃষ্ণনগরের নেদেরপাড়ার শেষ মাথায়, বাগদি পাড়া ঢোকার বড় রাস্তার পাশে শ্যাওলা ধরা সরু গলি। শেষে একতলা বাড়ি। টিনের চাল দেওয়া একফালি বারান্দায়, দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে শোলার পাখি তৈরি করছেন ৬৫ বছরের তৃপ্তি মালাকার।
শোলার তৈরি গা, ঠোঁট, ল্যাজ আর কাগজের তৈরি ডানাওয়ালা এই পাখির কোনও পা নেই। কী কাজে লাগে এই পাখি? উত্তরে তৃপ্তি বলেন, "এ পাখি ব্যবহার হয় প্রতিমার চালিতে কল্কার মাথায় বসানোর জন্য।"
তিনি জানান, প্রধানত দুর্গার চালিতে শোলার পাখির ব্যবহার থাকলেও কিছু কিছু জগদ্ধাত্রী প্রতিমার চালিতেও এই পাখি ব্যবহার হয়। ইদানিং চালিতে এই পাখির ব্যবহার খুব কমে এলেও এখনও বেশ কিছু বনেদি বাড়ি, প্রাচীন বারোয়ারির দুর্গা প্রতিমার চালিতে এই পাখি ব্যবহার করছে বলে জানান তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তেহট্টের বেতাই থেকে কৃষ্ণনগরে মালাকার বাড়ির বউ হয়ে আসেন তৃপ্তি। বাবাও ছিলেন শোলা শিল্পী, সেই সূত্রে বাবার কাছেই শোলার কাজের হাতেখড়ি তৃপ্তির। কৃষ্ণনগরে এসে বরের সঙ্গে শোলার কাজ করতেন তিনি। সে সময়ই দেখেছিলেন চালিতে লাগানোর জন্য এই ধরনের পাখি নিতে আসছেন প্রতিমা শিল্পী, পুজো বাড়ির লোকজন।
ছেলেবেলার স্মৃতি হাতড়ে তৃপ্তি বলেন, "বাবাও শোলা দিয়ে অনেকটা এমনই দেখতে পাখি তৈরি করতেন আমাদের খেলার জন্য। কিন্তু চালিতে বসানোর জন্য পাখি তৈরি কৃষ্ণনগরেই প্রথম দেখি।" টোপরের উপর যে শোলার ময়ূর বসানো হয় বাঁশের কাঠিতে গেঁথে, এই পাখিও চালির কল্কার উপর সে ভাবেই গেঁথে বসানো হয় বলেও জানা গেল তাঁর কাছে। চালিতে দু'টি কল্কার মধ্যে 'খোঁচ' বা 'মনসা পাতা' নামে পাতার আকৃতির একটা নকশার চলও আগে খুব ছিল, যা এখন প্রায় উঠেই গিয়েছে। কলকার পরিবর্তে সেই খোঁচের উপরেও অনেক সময় কেউ কেউ এই পাখি বসাতেন বলেও জানান তিনি। পাখির এখন কাগজের ডানা হলেও আগে ডানাও তৈরি হত শোলা দিয়েই।
বর্তমান প্রজন্মের ভুলতে বসা এই শোলার পাখি যে শুধু শোলার হয়, তা নয়। মাটির সাজের প্রতিমাতেও মাটির তৈরি এমন পাখির চল আছে বলে জানা গেল শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্য সত্যনারায়ণ গোস্বামীর কাছে। তিনি বলেন, "বড় গোস্বামী বাড়ির মাটির সাজের ৩৫০ বছরের প্রাচীন দুর্গা প্ৰতিমা যিনি কাত্যায়নী রূপে পুজিতা হন, তাঁর চালির মাটির কল্কার উপর শুরু থেকেই মাটির পাখি বসছে।" শান্তিপুরের বেশির ভাগ প্রাচীন বারোয়ারি বা বাড়ির পুজো, যেমন ২৫০ বছরের ডাবরে পাড়া বুড়ো বারোয়ারি, ১৮০ বছরের চৈতল পাড়া বারোয়ারি, জজ বাড়ি, মৈত্র বাড়ি-সহ আরও কিছু বাড়ি ও বারোয়ারির চালিতে শোলার পাখি এখনও ব্যবহার করা হয়। আবার, কয়েকটি বাড়িতে যেমন রায় বাড়িতে আগে চালিতে পাখি দেওয়া হলেও ইদানিং হয় না বলে জানান সত্যনারায়ণ।
সাজ শিল্পীদের কাছ থেকে জানা গেল, এক একটি চালিতে কল্কার সংখ্যা হিসাবে ৪০ থেকে ৫০টি মতো পাখি লাগে। হলুদ, সাদা, সবুজ নানান রঙের এই পাখি হলেও সাদা আর হলুদ পাখির চাহিদা বেশি বলেও জানান তাঁরা। কৃষ্ণনগরের এক প্রতিমা শিল্পী নারায়ণ চন্দ্র পাল ও সাজ শিল্পী চাঁদু পাল জানালেন, "আগে কলকাতার অনেক বনেদি বাড়ির প্রতিমার চালিতে পাখি ও খোঁচের ব্যবহার ছিল, যা এখন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে।" এখন চালিতে পুঁথি, কল্কায় প্লাস্টিকের ফুল, কাগজের ফুলের ব্যবহার বেশি হয় বলেও জানান তাঁরা।
কলকাতা শোভাবাজার রাজবাড়ির ছোট তরফের দুর্গা প্রতিমার চালিতে এখনও পাখি ও খোঁচের ব্যবহার হয় বলে জানালেন শোভাবাজার রাজবাড়ির সদস্য আলোক কৃষ্ণ দেব। তেমনই আবার কলকাতার বিডন স্ট্রিটের দত্ত বাড়ির বর্তমান সদস্য অজয় দত্ত জানান, তাঁদের বাড়ি ১৯০৫ সাল থেকে শিব-দুর্গার পুজো হয় দুর্গা পুজোয়। শুরুর দিকের ১৯১৩ সালের তাঁদের প্রতিমার একটি আলোকচিত্রে তিনি চালিতে পাখি ও খোঁচ দেখেছিলেন। তবে তাঁর জীবনে নিজের চোখে তাঁদের প্রতিমার চালিতে খোঁচ ও পাখি তিনি দেখেননি বলেও জানান তিনি।
দুর্গা প্রতিমার চালিতে এই পাখির ব্যবহার কী ভাবে শুরু হল সে প্রসঙ্গে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের বর্তমান সদস্য তথা অধ্যাপক ও গবেষক প্রবাল রায় চৌধুরী বলেন, "পাখির ব্যবহারের নির্দিষ্ট কোনও কারণ পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন জন শ্রুতি, লৌকিক গল্প কাহিনি থেকে কয়েকটি কারণ অনুমান করা যায়। ১, চালির অলঙ্কার হিসাবে। ২, পূর্ববঙ্গের লোকাচারে যে সুখ-সারির কথা পাওয়া যায় সেই সুখ-সারি পাখির প্রভাবও এই পাখিতে থাকতে পারে। ৩, নীলকণ্ঠ পাখির প্রতিরূপ হিসাবেও এই পাখির চল হতে পারে।"
শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্য সত্যনারায়ণ গোস্বামী বলেন, "সাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে প্রতিমার চালির পাখির রং লাল হলেও বাড়ির বয়স্কদের মুখে শুনেছি, নীলকণ্ঠ পাখির প্রতিরূপ হিসাবেই আমাদের চালিতে পাখি দেওয়া হয়।"
দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে চালির পাখি। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্য। আগামী প্রজন্ম পুরনোকে জানুক, চিনুক এইটুকু চান পুরনো দিনের শিল্পীরা। চালির কল্কায় বসুক উড়ন্ত পাখি, বেঁচে উঠুক হারিয়ে যেতে বসা শোলা শিল্প। এখন এমনটাই প্রত্যাশা তৃপ্তি মালাকার, চাঁদু মালাকারদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy