পাউচ কেক থেকে এম জি রোড। এ সব পরিব্যাপ্ত করে ২ অক্টোবর জাতির জনকের জন্মদিন পালন হল। বাপুজি যে পরিশুদ্ধ দেশের কল্পনা করতেন, দেশের কান্ডারি থেকে খুচরো নেতারা ঝাড়ু হাতে নেমে সেই স্বচ্ছতার নামে আর এক বার শপথ নিলেন: আর কোনও পুরীষপ্রকট পথঘাট নয়, নয় কোনও মাঠঘাটের প্রাতঃকালীন অভ্যাস। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব দেখা করলেন স্বচ্ছতার প্রধান কান্ডারির সঙ্গে, স্বচ্ছ ভারত দিবসে।
যদিও রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষ প্রতিনিধি লিয়ো হেলার গত নভেম্বরেই স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা পরিষেবার পরিদর্শনে এসে বলে গিয়েছেন, শৌচাগার বানিয়ে রাখলেই হয় না, যা বানানো হয়েছে তার ৬৫ শতাংশই অসুরক্ষিত, ব্যবহার করে মাত্র ৬ শতাংশ। আর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পুরীষমুক্ত পরিচ্ছন্নতা আনার যে প্রকৌশল নেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে জলবাহিত নিকাশি ব্যবস্থা আবশ্যিক না করলে যুগ যুগ ধরে এক দল মানুষকে দিয়ে যে ভাবে বর্জ্যনিকাশের সামাজিক অভ্যাস চলে আসছে ভারতের ইতিহাসে, সেটা বদলাবে না, শৌচাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি বর্জ্যনিকাশি ব্যবস্থায় সাফাইকর্মী হিসেবে আরও মানুষকে নিয়ে আসবে, আর যে হেতু এই কাজটি আমাদের দেশে জাতনির্ভর, তাই জাতভিত্তিক শোষণ থেকে বেরিয়ে আসার পথ ক্রমে আরও সঙ্কীর্ণ হয়ে আসবে। হেলার সাফ জানিয়ে দেন, স্বচ্ছতার অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নটা স্রেফ তোলাই হয়নি।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই প্রতিবেদনকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। গাঁধী জয়ন্তীতে মোদী বা কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই সাফাইকর্মীদের প্রসঙ্গ তোলেন না। ভাঙাচোরা ব্যবস্থায় বিষাক্ত পয়ঃপ্রণালীতে সাফাইকর্মী মৃত্যুর ভয়াবহ পরিসংখ্যানও স্মরণ করা হয় না। প্রশ্নহীন ভাবে চেপে দেওয়া হয় যে, সুপ্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈষম্যমূলক বৃত্তি-ব্যবস্থায়, একটি বিশেষ জাতের মানুষকে দিয়েই মানুষের বর্জ্য বহন করানোর কাজ আজ অবধি চলে আসছে। ফলে ‘স্বচ্ছতাই সেবা’ বুলিটি সাফাইয়ের কাজে যুক্ত সমস্ত মানুষের মানবাধিকারকে টুঁটি টিপে মারার ব্যবস্থা হয়েই থেকে যায়। পয়ঃপ্রণালীর ক্লেদ সাফাইয়ের কাজ যে হেতু কাউকে কোনও তূরীয় আধ্যাত্মিক আহ্লাদ দিতে পারে না, সাফাইয়ের কাজকে আধ্যাত্মিক মুক্তি বলার মধ্য দিয়ে আড়াল করা হয় যে, এর ফলে অস্পৃশ্যতার ও অবমাননার অভিশাপের মধ্যে তাঁদের পুঁতে রাখা হয়। নতুন গৌরবে ভরপুর ‘স্বচ্ছ ভারতে’ দু’হাজার বছরের বঞ্চনা ও শোষণের ইতি তো ঘটেই না, বরং ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির কর্মযোগীটি ভাঙ্গি, ডোম, হাড়ি, কাওড়া, হড়, হালালখোর ইত্যাদি জাতের মুক্তির মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
অম্বেডকর সে কালেই বলেছিলেন, আমাদের দেশে বর্জ্য সাফাইয়ের কাজ সামাজিক পেশা নয়, সেটি আসলে জাতগত আত্মপরিচয়। এই পরিচয় জাতব্যবস্থার নিগড়ে বাঁধা, তাই পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যসমাজে মানুষ দ্বারা মনুষ্যবর্জ্য সাফাইয়ের কাজ যদি থেকে যায়, তাকে কিছুতেই নিছক পেশা বা আধ্যাত্মিকতা হিসেবে দেখা যেতে পারে না। আর কী সেই সাফাইয়ের কাজ? মরাঠি ‘কোর্ট’ সিনেমায় (২০১৫) শেষ অবধি জানা গিয়েছিল যে ধাঙড় লোকটি মোটেই আত্মহনন-টনন করেননি, (সারা দিন যে সেপটিক ট্যাঙ্কে শরীর চুবিয়ে মলমূত্র পরিষ্কার করে, তাঁর আবার আত্ম-টাত্মর বোধও থাকবে, এ রকমটা তো হয় না) বরং সওয়াল-জবাবের জট কাটিয়ে আমাদের জানানো হয়: এই সব মানুষকে যখন নামিয়ে দেওয়া হয় বিষাক্ত গ্যাসভরা ড্রেনে, তাঁদের কাছে কোনও সুরক্ষামূলক মাস্ক থাকে না, চিকিৎসার ইনশিয়োরেন্স থাকে না, তাঁরা কোথাও কোনও অভিযোগ দায়ের করতে পারেন না কারণ সমাজ তাঁদের কোনও ভাবে গ্রহণ করেনি। বিষাক্ত গ্যাসে দমবন্ধ মৃত্যু যে আসলে জাতের কারণে প্রাপ্য ভবিতব্য নয় বরং হত্যাকাণ্ড, সেটা বলে দেওয়ার কেউ থাকে না। সে যে আসলে এত বড় ও দীর্ঘ সভ্যতার অবহেলা আর হিংস্রতার শিকার, সেটা বুঝলেও তাঁর ফুঁসে ওঠার কিছু নেই, কারণ ফুঁসে ওঠা যে যায় সেটাই তাঁর অজানা।
চেষ্টা কি আর হয়নি? কত আগেই তো সংবিধানের ১৭ ধারা বলেছে, অস্পৃশ্যতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনের এই ধারার ওপর ভিত্তি করে ১৯৮৯-এ জাতীয় তফশিলি জাতি-জনজাতি অর্থবণ্টন ও উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি হয়েছে বর্জ্য-সাফাইকারীদের অর্থসাহায্যের জন্য। সঙ্গে সঙ্গেই আনা হয়েছে বর্জ্য-সাফাইকারীদের মুক্তি ও পুনর্বাসনের জাতীয় প্রকল্প। বর্জ্য-সাফাইকারীদের শনাক্ত করে, পরিসংখ্যান গ্রহণ করে, তাঁদের জন্য বিকল্প জীবিকার নীতি নেওয়া হয়েছে। ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে বর্জ্য-সাফাইকরণে মানুষের নিয়োগ নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এই নিষিদ্ধকরণ ধারাটি পড়ে থাকার পর ১৯৯৭-এ যখন সেটা শেষ অবধি কার্যকর হয়, দেখা গিয়েছে ইতিমধ্যে কত বেড়ে গিয়েছে বর্জ্য-সাফাইকারীর সংখ্যা। তাঁদের নিযুক্তি হয়েছে আর্মিতে, পাবলিক সেক্টরে, ভারতীয় রেলে। শেষে ২০০৩ সালে এসে দেখা গেল, কয়েকটি জাতকে দিয়ে বাধ্যতামূলক বর্জ্য-সাফাই নিষিদ্ধকরণ ও তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ ৬০০ কোটি হয় গিয়েছে পকেটে পকেটে, নয়তো খরচ না হয়ে পড়ে আছে কোনও অন্ধকার গহ্বরে। সংবেদনশীলতা তৈরির লাগাতার কোনও প্রচেষ্টা না থাকায় সমাজে জাতভিত্তিক অস্পৃশ্যতা ও শোষণের ভয়াবহতা নিয়ে কোনও বোধোদয় ঘটেনি, বর্জ্য-সাফাইয়ের চক্র থেকে বেরিয়ে সামাজিক সুরক্ষা পেয়ে অর্থাৎ লেখাপড়া শিখে কাজকর্ম করে এই জাতের মানুষের শ্রমিক শ্রেণিতে পরিণত হওয়ার কোনও সুযোগই ঘটেনি।
২০০৩ সালে সাফাই কর্মচারী আন্দোলনের পক্ষে সংবিধানের ৩২ ধারাকে উদ্ধৃত করে জোরালো দাবি জানানো হয়, যাতে পঞ্চায়েত, পুরসভা ও পুরনিগমের প্রতি স্তরে পর্যবেক্ষক নিয়োগের জন্য, যাঁরা বর্জ্য সাফাইয়ের চিরাচরিত পদ্ধতি অনুসৃত হলেই তা আইনি পথে মোকাবিলা করবেন। এই আবেদন দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়ে দেয়, বর্জ্য সাফাইয়ের সঙ্গে জাতপাতের যোগকে না বুঝলে, আর সেই যোগ না পাল্টালে কোনও ভাবেই এই চক্র থেকে বেরনো যাবে না। এই প্রথম করা সমীক্ষায় দেখা গেল যে শিক্ষা বা বিকল্প পেশার সুযোগ খাতায় কলমে থাকলেও অস্পৃশ্যতা জারি থাকায় জাতগত পেশায় থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন কত মানুষ। কিংবা কী ভাবে পয়ঃপ্রণালীর বিষে পরিবারের এক জনের মৃত্যুতে প্রাপ্য খেসারত হাতে না পৌঁছনোয় পরিবারের আর এক সদস্যের ওই পেশায় নেমে পড়া ছাড়া উপায় থাকেনি।
আজ দেখতে পাচ্ছি, নেতানেত্রীদের পিছনে নীল শাড়ি সাফাইকর্মীরা ঝাড়ু হাতে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকছেন। হাসিমুখ— কারণ এ হল জাতির গরিমার কাজ! মনে পড়ে জাতির জনকের ১৯৩৬ সালের বয়ান যে— সারা দেশ অসহযোগে গেলেও ভাঙ্গি কিন্তু করে যাবে বর্জ্য-সাফাইয়ের কাজ, কারণ সেটাই তাদের জাতির প্রতি ‘সেবা’। সঙ্গে সঙ্গেই মন অস্থির হয় অম্বেডকর নামে সেই লোকটির জন্য, যিনি এসে গর্জে উঠে বলবেন ‘ভাঙ্গি ঝাড়ু ছোড়ো’। ওই বছরই লেখা হয় অ্যানাইহিলেশান অব কাস্ট, যেখানে অম্বেডকর বলেন হিন্দু ধর্মের শাস্ত্র ও আচারেই নিহিত আছে জাতপাতের বৈষম্য, তাকে নির্মোহ ভাবে আঘাত না করে নিচু জাতকে মুক্ত করা যাবে না। প্রসঙ্গত, শাস্ত্রের প্রতি এই আঘাতকে কিন্তু গাঁধী মেনে নিতে পারেননি।
আমাদের অবস্থান এ সবের বাইরে, মধ্যবিত্ত ঘেন্নাপিত্তির। ফলে বর্জ্য ও পুরীষের মধ্যে শরীর ডুবিয়ে তা নিকাশ করার অভিজ্ঞতার যে দলিল, তাকে বোঝার বা প্রকাশ করার ক্ষমতাই আমাদের নেই। এমনকি ভাঙ্গিরা যদি আমাদের রাজনৈতিক চেতনায় থাকেও, অস্পৃশ্যতা হটানোর দাবি যদি উঠেও আসে, ‘ভাবনী ভাবাই’ নামে গুজরাতি সিনেমার শেষের (১৯৮০) মতো, প্রতিবাদে আত্মহননকারী ভাঙ্গি বাবার গর্জনের পরই গল্পকথন তার পরিসর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। আমরা এই সিনেমায় যা দেখছিলাম, সেটা হয়ে পড়বে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক। আমাদের নজর ভাঙ্গিদের জীবন থেকে স্বভাবতই আর এক বার সরে আসবে আমাদের নিজেদের জীবনের দিকে। আমরা সবাই তো আসলে লীলা মজুমদারের ‘বদ্যিনাথের বড়ি’র কলু, ‘দড়িবাঁধা’টার বাবা তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে গভীর নর্দমায় নামিয়ে দিলে আমরা ভাবব, আহা ওই ড্রেন-পথে যোগ আছে বুঝি বিদ্যেধরী নদীর। কুমিররা বোধ হয় ওখানেই গুঁড়ি মেরে আছে। সেই কুমিরের দড়িবাঁধা বাচ্চাটাকে গিলে নেওয়ারই তো কথা, তাতে আমরা আশ্চর্য বা ব্যথিত বা ক্রুদ্ধ হবই বা কেন!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক , সাহিত্যের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy