কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস। ফাইল ছবি
প্রচলিত ধারণা যে অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লবই বুঝি পৃথিবীর বায়ুদূষণের সূচনার মূলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বায়ুদূষণের ইতিহাস মানবসভ্যতার মতোই প্রাচীন। আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে সভ্যতার এগিয়ে চলার প্রতিটি বাঁকেই জড়িয়ে আছে বায়ুদূষণ। বৈজ্ঞানিক স্পেনগ্লার ও সেক্সটন ১৯৮৩ সালে ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত তাঁদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন প্রাগৈতিহাসিক গুহাগাত্রে পাওয়া ভুষোকালির কথা। এটি আগুনের ব্যবহারে ক্ষতিকারক গ্যাস উৎপাদন ও বায়ুদূষণের সাক্ষী।
কৃষিসভ্যতার পত্তন হয় দু’হাজার বছরের আগে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের রোমান সভ্যতা ও একই সময়ে চিনের হান সভ্যতায় ধাতব অস্ত্রকে আকার দিতে আগুনের ব্যবহার করা হত। রোমান সভ্যতায় পশুপালনের স্থানও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ সব কিছুর অনিবার্য ফল ছিল বিষাক্ত মিথেন গ্যাসের উৎপাদন। এ ব্যাপারে হল্যান্ডের উটরেক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সিলিয়া সাপার্ট গ্রিনল্যান্ডের বরফের গভীরে আটকে থাকা সে সময়ের বায়ুবুদ্বুদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। দেখিয়েছেন, সে সময়ে মিথেন কী ভাবে বায়ুদূষণ ঘটিয়েছে।
ইনকা সভ্যতা ধাতু নিষ্কাশন করতে শিখেছিল। ১৫৩২ সালে স্পেন দখল করে ইনকা সাম্রাজ্য। তার পরে সেখানে সিসা, বিসমাথ ইত্যাদি মিশ্রিত রূপা-র আকরিক থেকে স্থানীয় পদ্ধতির চেয়েও অমার্জিত পদ্ধতিতে রূপা নিষ্কাশন করা শুরু হয়। ফলশ্রুতি এইসব ধাতুকণায় বায়ুদূষণ, যার সাক্ষ্য রয়ে গেল কাছাকাছি কোয়েলসচায়া অঞ্চলে জমে থাকা বরফে। ওহিও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পাওলো গ্যাব্রিয়েল এই বরফ নিয়ে গবেষণায় উঠে এসেছে সেই তথ্য ।
অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লব বায়ুদূষণকে ত্বরাণ্বিত করেছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে ২৭ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে পেনসিলভেনিয়ার শিল্পবেষ্টিত ডোনোরা শহরে তার সর্বনাশা প্রকোপ বুঝি চোখ খুলে দিল সবার। ওই শহর পাঁচ দিন ধরে দূষিত গ্যাস এবং ধাতুকণার আস্তরণে অন্ধকারে ঢাকা ছিল।এই ঘটনায় হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন, মারা যান ২০ জন। এই ঘটনায় বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পরিবেশ সচেতনতা জাগিয়ে তোলার জন্য জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে প্রতি বছর পাঁচ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালনের কথা ঠিক হয় ১৯৭২ সালে। এটি প্রথম পালিত হয় ১৯৭৪ সালে। তবে দুর্ভাগ্যের কথা, এটি পালনের দশ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে ঘটল ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা। পৃথিবীর ভয়ালতম শিল্পবিপর্যয়।
এই বছর ২০১৯-এর ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’-এর ‘থিম’ বা প্রতিপাদ্য, বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের জন্য দায়ী বাতাসের কিছু বিষাক্ত গ্যাস,যেমন, সালফার ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইড, অ্যামোনিয়া, মিথেন ইত্যাদির মাত্রাধিক উপস্থিতি। এ ছাড়া রয়েছে বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন ক্ষতিকারক ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম), যেমন ধুলো, ফ্লাইঅ্যাশ, ধোঁয়া, অ্যারোসোল ইত্যাদি। এরা আকার অনুযায়ী দু’প্রকারের, পিএম২.৫ (ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটারের কম) এবং পিএম ১০ (ব্যাস ১০ মাইক্রোমিটারের কম)।
দূষিত গ্যাসের উৎস প্রধানত কারখানা এবং ইঞ্জিনচালিত যান। আর ক্ষুদ্র বস্তুকণার উৎস রাস্তা বা নির্মাণশিল্পের ধুলোজাতীয় কণা, কৃষিকাজ, কয়লা ইত্যাদিতে জীবাশ্ম-জ্বালানির অদাহ্য কণা। কৃষিকাজ, পশুপালন, জীবাশ্ম-জ্বালানির দহন তৈরি করে মিথেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো গ্যাস। রেফ্রিজারেটর, প্রসাধন দ্রব্য ইত্যাদির স্প্রে জোগায় ফ্লোরিনেটেড গ্যাস। ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ নামে পরিচিত এই গ্যাসগুলি তাপমাত্রা বাড়িয়ে পৃথিবীতে প্রাণের বাসযোগ্য অবস্থানকে বিনষ্ট করে। ‘স্মগ’ বা ধোঁয়াশা তৈরি হয় সূর্যালোকের সঙ্গে নাইট্রোজেনের অক্সাইডের বিক্রিয়ায়।
বায়ুদূষণকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর ও পয়লা নভেম্বর জেনেভায় বায়ুদূষণের ওপর প্রথম বিশ্ব সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেখানে বায়ুদূষণকে এক ‘অদৃশ্য ঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, সারা পৃথিবীতে প্রতি দশজনে ন’জন দূষিত বাতাস গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর বায়ুদূষণের জন্য অকালমৃত্যু ঘটছে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের। ফুসফুসের অসুখের শতকরা ৪৩ ভাগ ঘটে বায়ুদূষণের কারণে। এর জন্য ফুসফুসের ক্যানসার ও অন্যান্য অসুখে প্রতি বছর প্রাণ হারান অন্তত ১৮ লাখ মানুষ। হৃদরোগের শতকরা ২৫ ভাগের কারণ বায়ুদূষণ যা প্রতি বছর ছিনিয়ে নেয় অন্তত ২৪ লক্ষ প্রাণ। আবার স্ট্রোকে মৃত্যুর শতকরা ২৪ ভাগের কারণ বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের জন্য প্রতি বছর ১৪ মানুষ মারা যান স্ট্রোকে। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে বায়ুদূষণের জন্য ভারতবর্ষে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়ে যায় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-র তিন শতাংশ।
বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে আসানসোল-দুর্গাপুর-রানিগঞ্জের অবস্থানটি বেশ চিন্তার। এই শিল্পাঞ্চল জন্মেছেই কয়লাখনির জন্য বায়ুদূষণের জন্মদাগ নিয়ে। এ ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য শিল্পগত দূষণ, নির্মাণশিল্পের দূষণ, উন্মুক্ত স্থানে কয়লা পোড়ানো, রাস্তার অনুপাতে মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন ইত্যাদি। সে কারণে দূষণের মানদণ্ড, ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’, পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০— এই অঞ্চলে প্রায় সবসময়েই থাকে স্বাস্থ্যগত সীমার ওপরে। যেমন পয়লা জুন ২০১৯ দুপুরে আসানসোলের একিউই ১৬০, পিএম২.৫ ৭৪ এবং পিএম১০ ১১১। এই অবস্থান হাঁপানি রোগী, শিশু বা বৃদ্ধের শ্বাসকষ্ট কারণ হতে পারে।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বৃক্ষরোপণ বা বনসৃজন বড় জরুরি। আবাস এলাকার অন্তত তিরিশ ভাগ হওয়া উচিত বৃক্ষসবুজ। চারিদিকে থাকা উচিত ‘গ্রিনবেল্ট’। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যানবাহনের দূষণ। কারখানার অবস্থান হতে হবে আবাস এলাকার থেকে দূরে। শিল্পদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কড়া ভাবে। প্রয়োজন প্রথাগত কয়লা ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে ধোঁয়াবিহীন জ্বালানির ব্যবহার। রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে আন্তঃসরকারি প্যানেলের মতে কয়লা নির্ভর বিদ্যুতের উৎপাদন ধীরে ধীরে ২০৫০-এর মধ্যে সম্পূর্ণ বন্ধ না করতে পারলে বিশ্ব উষ্ণায়ন আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে এক ভয়াবহ সঙ্কটের সৃষ্টি করবে।
আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy