টহলরত সেনা। —ফাইল চিত্র।
এই দেশের ফলিত রাজনীতির অভিধানে সংহতি শব্দটির ব্যঞ্জনা উত্তরোত্তর সঙ্কীর্ণ হইতেছে। দল, মত, গোষ্ঠী— কোনও না কোনও একটি বর্গে না মিলিলে এখন মানুষ সাধারণত কোনও বিষয়ে অপরের সহিত সংহতি প্রকাশ করে না। রাজনীতির মেরুকরণ প্রবল হইতে প্রবলতর, সমাজেও তাহার প্রভাব বাড়িতেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি কয়েকটি আশাব্যঞ্জক সঙ্কেত বহন করে। লক্ষণীয় সঙ্কেত। যথা, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একাংশ সুস্পষ্ট ভাষায় বিবৃতি দিয়া জানাইয়াছেন, উপত্যকার মানুষের সহিত আলোচনা না করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে একতরফা জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অধিকারে হস্তক্ষেপ করিয়াছে, তাহা অত্যন্ত আপত্তিকর। এই নিন্দায় তাঁহাদের সহিত সুর মিলাইয়াছেন কাশ্মীরের ডোগরা এবং শিখ অধিবাসীদের একটি অংশ। আবার, পঞ্জাবের সরকার, জনসমাজ এবং শিখ সংগঠন কাশ্মীরের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার পক্ষে সওয়াল করিবার সঙ্গে জানাইয়াছেন, কাশ্মীরি নাগরিকদের, বিশেষত মেয়েদের সম্মান যেন কোনও ভাবে খর্ব করা না হয়। কাশ্মীরের অধিবাসী শিখরাও সমবেত ভাবে অনুরূপ মনোভাব প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদের বক্তব্যের মর্মকথা: আমরা পাশে আছি।
এই সংহতির বাণী দুইটি কারণে ভরসা দেয়। প্রথমত, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াইবার মানসিকতা সর্ব ক্ষেত্রেই শুভ। দ্বিতীয়ত, যে পরিস্থিতিতে এই সংহতি ব্যক্ত হইয়াছে তাহাকে প্রতিকূল বলিলে কম বলা হয়। বিজেপির রাজনীতিতে ধর্মপরিচয়ের ভূমিকা বিপুল, সেই রাজনীতি যে ধর্মপরিচয়কে বিভাজনের প্রকরণ হিসাবে ব্যবহার করিতে সতত তৎপর সেই অভিযোগও বহুচর্চিত। কাশ্মীর সেই বিভাজনী রাজনীতি প্রয়োগের উর্বর ভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হইলে বিস্ময়ের কারণ নাই। অভিযোগ উঠিবার আগেই শাসক দলের নেতারা সমস্বরে তাহা অস্বীকার করিয়া জাতীয়তাবাদের বৃন্দগান গাহিয়া থাকেন, কিন্তু তাহাতে তাঁহাদের রাজনীতির স্বরূপই প্রকট হয়, বোঝা যায় যে, কাশ্মীরে সেই জাতীয়তাবাদ দীর্ঘকালের দমন নীতিকে ষোলো আনা প্রতিষ্ঠিত করিবার প্রকরণ। যে ভাবে শাসক দলের নেতা তথা জনপ্রতিনিধিরা, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী অবধি এ-বার কাশ্মীরি মেয়েদের ‘পাওয়া যাইবে’ বলিয়াছেন, তাহা এই ভয়ঙ্কর রাজনীতিটিকেই উন্মোচিত করে। ঠিক তেমনই, কাশ্মীরের মানুষের সঙ্কটের কথা তুলিলেই যে ভাবে ‘কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিপদের দিনে কোথায় ছিলেন’ বলিয়া শোরগোল তোলা হইয়াছে, তাহাও বলিয়া দেয়, একের বিরুদ্ধে অপরকে লড়াইয়া দিবার ব্যগ্রতা কতখানি তীব্র।
এই প্রেক্ষাপটেই ধর্মপরিচয়ের হিসাব না কষিয়া শিখ-ডোগরা-পণ্ডিতরা যে ভাবে উপত্যকার মানুষের পাশে দাঁড়াইয়াছেন, তাহা বড় ভরসা দেয়। কেবল গণতন্ত্রের ভরসা নহে, সভ্যতার ভরসা। সঙ্কীর্ণ এবং বিদ্বেষধর্মী রাজনীতির কুমন্ত্রণাকে অস্বীকার করিয়া তাঁহারা স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তির পরিচয় দিয়াছেন, বিপন্ন ও সন্ত্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াইয়াছেন। এই স্বাভাবিকতা হয়তো দুর্মর নহে। তাহাকে ধ্বংস করিবার প্রবল চেষ্টা চলিতেছে, চলিবে। সেই কারণেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের সজাগ এবং সক্রিয় থাকা দরকার, যাহাতে সহৃদয়তার উচ্চারণগুলিকে বৃহত্তর জনসমাজের নিকট পৌঁছাইয়া দেওয়া যায়। বস্তুত, সাম্প্রদায়িক এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষের রাজনীতির মোকাবিলায় যথার্থ সামাজিক আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার প্রয়োজন উত্তরোত্তর বাড়িতেছে, কেবল দলীয় রাজনীতির চর্চিত পথে সেই মোকাবিলা আজ আর সম্ভব নহে। তেমন আন্দোলনের মূল্যবান রসদ রহিয়াছে সমাজের মনোভূমিতে। কাশ্মীর প্রশ্নে পণ্ডিত-ডোগরা-শিখ সমাজের সুস্থ প্রতিক্রিয়ায় এই সত্যের প্রতিফলন ঘটিয়াছে। সভ্য, উদার, গণতান্ত্রিক ভারত যদি বাঁচে, এই সত্যের জোরেই বাঁচিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy