—ফাইল চিত্র।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে সংযত না বলিয়া উপায় নাই। তাহাতে নাটকীয়তা ছিল বিলক্ষণ, কিন্তু আধিক্য ছিল না। কাশ্মীরের ঘটনাক্রমকে আরও একটি ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ বলিবার বিপজ্জনক প্রলোভনটি তিনি সযত্নে এড়াইয়াছেন। প্রশ্ন উঠিতেছে, যেখানে কাশ্মীরে টেলিভিশন সংযোগ বিচ্ছিন্ন, সেখানে সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের উদ্দেশে ভাষণ তাঁহাদের নিকট পৌঁছাইবে কোন পথে? নেহাত করিতে হয় বলিয়াই প্রশ্নটি করা, নচেৎ এই ভাষণ যে প্রকৃত প্রস্তাবে উপত্যকার জন্য নহে, বরং অবশিষ্ট দেশের জন্য— তাহাতে সংশয় নাই। ভাষণটিকে এই প্রেক্ষিতেই দেখা বিধেয়। প্রধানমন্ত্রী সোশ্যাল মিডিয়ার নাড়িনক্ষত্র জানেন। ফলে, তিনি বিলক্ষণ জানিবেন, গত কয়েক দিনে নেট-দুনিয়ায় দুইটি ‘রসিকতা’ ঘুরিতেছে— অতঃপর কাশ্মীরে জমি কেনা চলিবে, এবং ‘ফর্সা’ কাশ্মীরি মহিলাদের বিবাহ করা সম্ভব হইবে। বিজেপির নেতারাও এ হেন রসিকতা করিতেছেন, সাধারণ মানুষের কথা বলা বাহুল্য। কোনও ভূখণ্ড জয় করিলে সেখানকার মাটি ও নারীর উপর জয়ীর অধিকার প্রশ্নাতীত— নাদির শাহের কথা ভাবিলেই সংশয় থাকিবে না। অনুমান করা চলে, নেতা ও অনুগামীরা কাশ্মীরের ঘটনাক্রমকে হয়তো দখল হিসাবেই দেখিতেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁহার ভাষণে এই ভুলটি ভাঙাইয়া দিলে পারিতেন। তিনি সম্ভবত কথাটিকে উল্লেখযোগ্য জ্ঞান করেন নাই।
অনুল্লিখিত থাকিল আরও বেশ কিছু কথা। যেমন, ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ ধারার বিলুপ্তির ফলে কাশ্মীরি মানুষের কতখানি উপকার হইবে— ছাত্রছাত্রী হইতে সাফাইকর্মী, সরকারি আধিকারিক হইতে শ্রমিক, কাহার কী লাভ হইবে— সে কথা ফলাও করিয়া বলিলেও প্রধানমন্ত্রী বলেন নাই, এই ধারাগুলি থাকায় কাশ্মীরের মানুষের কী সুবিধা হইতেছিল। কাশ্মীরে ভূমি সংস্কারের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন নাই; রাজ্যে চাকুরির ক্ষেত্রে, জমি-বাড়ি কিনিবার ক্ষেত্রে স্থানীয়দের বাড়তি সুবিধার কথা বলেন নাই; রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে বিধানসভার অনস্বীকার্য গুরুত্বের কথাও স্বীকার করেন নাই। তিনি জানাইয়াছেন, ৩৭০ ধারার দৌলতে রাজ্য সরকারের অসহযোগিতায় কেন্দ্রীয় কল্যাণমূলক আইনও রাজ্যে বলবৎ করা যায় নাই। কিন্তু জানান নাই, মেহবুবা মুফতির পিডিপির সহিত জোট সরকার চালাইবার সময় বিজেপি কেন সেই উন্নয়নের সদর দরজা খুলিয়া দেয় নাই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট, তাঁহার আশা যে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর উপত্যকায় বেসরকারি লগ্নি আসিবে, এবং তাহাই হইবে উন্নয়নের ভগীরথ। কথাটি এই বাজেটের সুরে মিলিয়াও যায়। কিন্তু, গোটা দেশে তো ৩৭০ ধারা ছিল না কখনও। সেখানে যদি বেসরকারি লগ্নির অভাবে নাভিশ্বাস উঠিতে পারে, কাশ্মীরে কী ভাবে লগ্নি উপচাইয়া পড়িবে, প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা করিলেন না।
বরং, জম্মু-কাশ্মীরকে অঙ্গরাজ্য হইতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করিবার যুক্তি হিসাবে যে ভাবে উন্নয়নের প্রসঙ্গটি টানিলেন, তাহা বিপজ্জনক। প্রধানমন্ত্রী জানাইলেন, রাজ্য সরকার উন্নয়ন করিতে পারে নাই। কেন্দ্র রাশ ধরিলেই বিতস্তা-চন্দ্রভাগায় উন্নয়নের প্লাবন আসিবে। কথাটি প্রত্যক্ষ ভাবে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় দর্শনের পরিপন্থী। সংবিধান-প্রণেতারা যদি বিশ্বাস করিতেন যে রাজ্য সরকারের অধীনে উন্নয়ন হয় না, তাহার জন্য কেন্দ্রের বিকল্প নাই, তবে সম্ভবত ভারত নামক দেশটি যুক্তরাষ্ট্র না হইয়া বেশ কিছু কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সমষ্টি হইত। নরেন্দ্র মোদীর অবস্থানটি একক কেন্দ্রের দর্শনে পুষ্ট। সর্বশক্তিমান কেন্দ্র। এবং, সেই অবস্থান যে শুধু কাশ্মীর উপত্যকাতেই সীমাবদ্ধ থাকিবে, সেই ভরসা নাই। রাজ্যে উন্নয়নের প্রকৃত বা কল্পিত অভাব যদি কেন্দ্রীয় দখলের যুক্তি হইয়া উঠে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ দুর্ভাবনার কারণ যথেষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy