বার্তা: রাষ্ট্রপুঞ্জে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চিনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে মনোযোগী মার্কিন বিদেশসচিব, নিউ ইয়র্ক, ২০ অগস্ট। রয়টার্স
রুদ্ধদ্বার বৈঠক খুব অপ্রচলিত নয় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে। বরং তার উল্টোই। বিশ্ব নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওঠানামার হার এতই বেশি যে ঘন ঘন দুয়ার এঁটে বসতেই হয় পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য আমেরিকা, ফ্রান্স, চিন, রাশিয়া, এবং ব্রিটেনের প্রতিনিধিদের। প্রয়োজন এবং ওজন বুঝে ডেকে নেওয়া হয় অন্য দশ অস্থায়ী সদস্য দেশকেও।
যেটা অভিনব, এবং কোনও গুহ্য কারণে যা নিয়ে ঝড় উঠল না কূটনৈতিক বিশ্বে, সেটা হল ওই বন্ধ ঘর থেকে আওয়াজ বাইরে এল সাম্প্রতিক অতীতে এই প্রথম বার। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে মোদী সরকারের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের পর রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য রুদ্ধদ্বার বৈঠক ডাকে অগস্টের গোড়ায়। চিনের অনুরোধে অথবা চাপে তড়িঘড়ি ডাকা ওই বৈঠকের শেষে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরাষ্ট্রের মতামত ছিল, দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে নাক গলানোর মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। পরিষদের অগস্ট মাসের পর্যায়ক্রমিক প্রেসিডেন্টকে (পোল্যান্ডের স্থায়ী প্রতিনিধি) নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল, বাইরে অপেক্ষারত উৎসুক সংবাদমাধ্যমের সামনে বৈঠক নিয়ে একটি বাক্যও খরচ না করতে। পরিষদভুক্ত রাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিদের মধ্যেও অলিখিত শর্ত তৈরি হল, বিষয়টির স্পর্শকাতরতা এবং জটিলতা বিচার করে কেউ যেন মুখ না খোলেন। কিছু বলার থাকলে, সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিষদের পক্ষ থেকেই বিবৃতি দেওয়া হত। যেমন অতীতে বহু বার দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে কী ঘটল? রাষ্ট্রপুঞ্জে চিনের স্থায়ী সদস্য ঝাং জুয়ান উপস্থিত সবাইকে বিস্মিত করে পরিষদের মুখপাত্রের জুতোটি যেন দিব্যি নিজের পায়ে গলিয়ে নিলেন। বৈঠক থেকে বেরিয়েই পরিষদের ঐতিহ্য এবং পরম্পরাকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়ে জানালেন (অবশ্যই তাঁর মতো করে) বৈঠকে কী হয়েছে! তাঁর মোদ্দা বক্তব্য, সমস্ত সদস্যরাষ্ট্রই জম্মু-কাশ্মীরের নিরাপত্তা নিয়ে নাকি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বৈঠকে। সেখানকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি নিয়েও আশঙ্কা কম নয়। তাই নিরাপত্তা পরিষদ মনে করছে, জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে একতরফা কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে বই কমবে না। তাঁর মতে, ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই কাশ্মীর সমস্যা কাঁটা হয়ে রয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ, প্রস্তাব এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব। এর পরই তিনি প্রতিধ্বনি করেছেন তাঁর দেশের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র সেই মন্তব্যটির, যা গত কয়েক সপ্তাহে বার বার বিভিন্ন স্তরে বলছে বেজিং। ‘জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের এই সিদ্ধান্ত চিনের সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর।’ বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বার বার চিনের বিদেশমন্ত্রীকে তাঁদের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেওয়ার পরেও ওই অবস্থান থেকে নড়েনি চিন।
পাকিস্তান ও চিনের প্রবল চেষ্টা সত্ত্বেও কাশ্মীর নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই বৈঠকের জের শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের প্রখ্যাত অশ্বক্ষুরাকৃতি টেবিল পর্যন্ত গড়াল না ঠিকই, যা নয়াদিল্লিতে সাময়িক সুবাতাসও হয়তো আনল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যে নতুন করে ড্রাগনের নিঃশ্বাস পড়তে শুরু করল সাউথ ব্লকের উপর, তাকে ঠেকাতে কিন্তু কেঁচে গণ্ডূষ করতে হতে পারে নয়াদিল্লিকে। গত বছরের এপ্রিলে উহান বৈঠকের পর ডোকলাম-আগুন নিভে কিছুটা শান্তি কল্যাণ হয়েছিল ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে। আগামী অক্টোবর মাসে ভারতের মাটিতে, চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় ঘরোয়া সংলাপ হওয়ার কথা। তার ঠিক আগে ড্রাগনের সঙ্গে নতুন করে কূটনৈতিক যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করা কৌশলগত ভাবে সাউথ ব্লকের কাছে তাই আর যা-ই হোক, বড় সুখকর নয়।
কাশ্মীর নিয়ে বিরোধিতার স্বর তোলার পিছনে যদি শি চিনফিং সরকারের সুপ্রাচীন পাকিস্তান-প্রণয়ই শুধু কারণ হত, তা হলেও কিছুটা হালকা ভাবে বিষয়টিকে দেখার অবকাশ ছিল কেন্দ্রের। কিন্তু এখানে ব্যাপার ঘোরালো। চিন নিজেদের আঁতে ঘা লাগলে কী করতে পারে তার ইতিহাস এবং জ্বলন্ত বর্তমান, কূটনৈতিক বিশ্বের সামনে রয়েছে। ভারত জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করায় বেজিংয়ের রক্তচাপ বাড়ছে অন্য কারণে। চিন সতর্ক হয়ে গিয়েছিল সম্প্রতি সংসদীয় অধিবেশনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তৃতার সময়েই। যেখানে অমিত শাহ বলেছিলেন, জম্মু ও কাশ্মীর বলতে গিলগিট, পাক শাসিত কাশ্মীর এবং আকসাই চিনকেও বোঝায়। আকসাই চিনে পিপলস লিবারেশন আর্মির উপস্থিতি নিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন সে দিন। অথচ, এত দিন পর্যন্ত আকসাই চিনকে ভারত ‘বিতর্কিত ভূখণ্ড’ বলেই মেনে এসেছে। চিনের বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে, জম্মু-কাশ্মীর লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে বিভাজিত করার পর আকসাই চিন নিয়েও সক্রিয় হবে ভারত। পাশাপাশি বাষট্টির যুদ্ধের পর চিনের হাতে পাকিস্তানের তুলে দেওয়া ৫১৮৩ বর্গ কিলোমিটার জমি নিয়েও এ বার টানাপড়েন তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা বেজিংয়ের। নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলওসি) আমেরিকাকে পাশে নিয়ে ভারত যদি কূটনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে পারে, তা হলে কি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখাও (এলএসি) আন্তর্জাতিক আলোচনার মধ্যে চলে আসবে না?
ওই রুদ্ধকক্ষ বৈঠকের পর রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন, উত্তাপ আরও বাড়িয়ে চিন এবং পাকিস্তানকে এক বন্ধনীতে রেখে আক্রমণ শানানোয়, বিষয়টি ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এক ধাক্কায় অনেকটাই গাড্ডায় নিয়ে ফেলেছে। সরব হয়েছে চিনের সরকার নিয়ন্ত্রিত ও সরকারি মুখপাত্র প্রচারমাধ্যম। এ ব্যাপারে প্রায় কোনও সন্দেহ আর রাখা উচিত নয় যে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে যখন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার নিয়ে ইসলামাবাদ উত্তাল হবে, তাতে প্রবল ইন্ধন থাকবে বেজিংয়েরও।
চিন তার সামরিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অন্য দেশগুলিকেও (বিশেষত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্য দেশকে) সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। যাদের তারা কিছুটা সঙ্গে পেয়ে গিয়েছে বলে ভারতের অনুমান, তারা হল রাশিয়া এবং ব্রিটেন। ওই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এই দুই স্থায়ী এবং শক্তিশালী সদস্যরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধিরা যে বেসুরে বেজেছেন (ভারতীয় স্বার্থের প্রশ্নে), তাতে নেপথ্যসঙ্গীতে বেজিং রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে চিনের সাম্প্রতিক অক্ষ, আমেরিকা-বিরোধিতা এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য— এই দু’টি শক্ত পায়ার উপর দাঁড়িয়ে। পাশাপাশি ব্রিটেন অবশ্য— চিন নয়— ইসলামাবাদ তথা ইমরান সরকারের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখতে চায় তাদের নিজস্ব ঘরোয়া কারণে।
বরাবরই তাইওয়ান এবং তিব্বত— চিনের দু’টি স্পর্শকাতর ক্ষেত্র। ঘরোয়া বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রশ্নে, কিংবা কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে বা কমাতে ভারত বরাবরই এই দু’টি বিষয়কে কাজে লাগিয়ে এসেছে। কিন্তু ডোকলাম-পরবর্তী পর্যায়ে যে হেতু এত দিন বেজিংয়ের সঙ্গে আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক প্রশ্নে মৈত্রীর পথেই এগোতে চাইছিল নয়াদিল্লি, তাই যা সরাসরি চিন-বিরোধী, এখনও পর্যন্ত আগ বাড়িয়ে এমন একটি পদক্ষেপও করা হয়নি। অগ্নিগর্ভ হংকং পরিস্থিতি নিয়ে চিনের পাশেই থেকেছে মোদী সরকার।
কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকা নতুন করে ভারত ও চিনের মধ্যে তাপমাত্রা যে ভাবে বাড়িয়ে দিল, তাতে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা চট করে বলা যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy