Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
যাঁরা শবরীর প্রতীক্ষায়?
Arnab Goswami

অর্ণব গোস্বামী সৌভাগ্যবান, দ্রুত তাঁর জামিন মিলে গেল

অর্ণব গোস্বামী বিখ্যাত ব্যক্তি। বিখ্যাত সাংবাদিক। তিনি টিভি চ্যানেলে প্রতি দিন ঝড় তোলেন, তাই তিনি বিখ্যাত।

মুক্ত: জামিনের পর অর্ণব গোস্বামী, মুম্বই, ১১ নভেম্বর। পিটিআই

মুক্ত: জামিনের পর অর্ণব গোস্বামী, মুম্বই, ১১ নভেম্বর। পিটিআই

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২০ ০২:৩৪
Share: Save:

গত এগারো নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় রায় দিলেন, অর্ণব গোস্বামীকে জামিন দেওয়া হবে। নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়— গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তাই, নয় নভেম্বর জামিনের জন্য আবেদন করা হলে ফাস্ট-ট্র্যাক করে মামলার শুনানি হল এগারো তারিখ। ওই সন্ধেতেই অর্ণব গোস্বামী মুক্তি পেলেন, বাড়ি ফিরলেন।

অর্ণব গোস্বামী বিখ্যাত ব্যক্তি। বিখ্যাত সাংবাদিক। তিনি টিভি চ্যানেলে প্রতি দিন ঝড় তোলেন, তাই তিনি বিখ্যাত। তাঁর গ্রেফতার, কারারোধ এবং কারামুক্তিও তাঁর খ্যাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কম ঝড় তুলল না। কিন্তু মুশকিল— ঝড়ের ঝাপটায় গুলিয়ে গেল কতকগুলো গুরুতর কথা। সংবাদমাধ্যমে, সমাজমাধ্যমে দেখা গেল তাঁর গ্রেফতারকে বলা হচ্ছে সংবাদ জগতের উপর সরকারি আক্রোশ, বাক্স্বাধীনতার উপর কোপ ইত্যাদি। তাঁর জামিনকে সাংবাদিকের স্বাধীনতার জয় বলে উল্লাস শোনা গেল। অপপ্রচার ও ভুল প্রচারে তৈরি হল আর এক রকমের ‘ফেক নিউজ়’।

ঘটনা হল, অর্ণব সাংবাদিক হলেও সাংবাদিকতা-বিষয়ক কোনও ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত হননি, তাঁর ‘কণ্ঠ’ রোধের কোনও চেষ্টা হয়নি। সেই দিক দিয়ে এই ঘটনাকে ঠিক বাক্স্বাধীনতার উপর সরকারি হস্তক্ষেপ বলা যায় না। খোলাখুলি ভাবে বিজেপি-সমর্থক সাংবাদিক হলেও অর্ণবের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগটি ছিল ভিন্ন গোত্রের, এক জনের আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার। সুতরাং এর থেকে সোজাসুজি এই সিদ্ধান্ত করা চলে না যে, মহারাষ্ট্রের শিবসেনা সরকার বিজেপি-সাংবাদিকের মুখ বন্ধ করছে। তাঁর অন্তর্বর্তিকালীন জামিনপ্রাপ্তি ও সাময়িক কারামুক্তি নিশ্চয়ই সুসংবাদ। কিন্তু একে সংবাদ জগতের স্বাধীনতার জয় বলা যায় না।

তবে এই প্রসঙ্গে একটা অন্য প্রশ্ন উঠবে। বৃহত্তর প্রশ্ন। সেটা বাক্স্বাধীনতার প্রশ্ন না হলেও রাজনীতির প্রশ্ন বটেই। অর্ণবের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের পিছনে কি রাজনৈতিক বিরোধিতার কোনওই ভূমিকা নেই? বিজেপি সাংবাদিকের কণ্ঠ রোধের জন্য না হোক, তাঁকে বিপাকে ফেলার জন্য শিবসেনা সরকারের রাজ্যে এই অভিযোগ এত দূর এসেছে, এই বক্তব্য কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? যায় না, এবং যায় না বলেই বিষয়টা মহারাষ্ট্র ছাড়িয়ে বাকি দেশের সমাজের কাছেও খুব জরুরি, উদ্বেগজনক। গণতন্ত্রের রাজনীতিতে বিপক্ষ কাউকে বিপদে ফেলার জন্য আইন-বিচার ইত্যাদিকে কী ভাবে ব্যবহার করা হয়, তা আমাদের আজ খুব পরিচিত, এ দেশে, ও দেশে, বিদেশে। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার নানা কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে, কিংবা রাজ্য সরকারগুলিকে দিয়ে, অনুগত সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে যে কাণ্ড করে চলেছে কয়েক বছর ধরে, উদ্ধব ঠাকরে সরকার তারই একটা পাল্টা ডোজ় দিচ্ছেন— এই আর কী।

অথচ, বিজেপি-বিরোধী হওয়াটাই কিন্তু যথেষ্ট নয়, একটা লিবারাল আদর্শ মানাটাও জরুরি, আজও, শত প্ররোচনার সামনে দাঁড়িয়েও। তাই, বলতেই হবে, রাজনীতিগত মতানৈক্যের কারণে অর্ণব গোস্বামীকে বিপদে ফেলার চেষ্টা হয়ে থাকলে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কেন্দ্রীয় সরকার নানা রাজ্যে নানা বিরোধীকে নানা মামলায় ফাঁসিয়ে ভয় দেখানোর কাজ প্রতি দিন করে চলেছে বলেই সেই যুক্তিতে কোনও রাজ্যের অবিজেপি সরকার এই একই কাজ করলে তা সমর্থনীয় হয়ে যায় না। ‘হোয়াটঅ্যাবাউটারি’ জিনিসটা একেবারেই কুযুক্তি, কুতর্ক। প্রশ্নের উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেই ‘অন্যায়’ ‘ন্যায়’ হয়ে যায় না। কেন্দ্রেই হোক রাজ্যেই হোক, বিজেপি-ই হোক বিরোধী দলই হোক— রাষ্ট্রশক্তি ব্যক্তি-নাগরিককে এই ভাবে কোনায় ঠেলে দিয়ে তাকে বিপন্ন করলে তা প্রতি ক্ষেত্রেই একই রকম বিপজ্জনক, আপত্তিকর, ভয়ঙ্কর। এতে কোনও দলরং নেই, বরং এক দলের কাজে অন্য দলের খারাপ কাজকে আরও অনেকটা দুঃসাহস জোগানোর ব্যবস্থা আছে।

অর্ণব গোস্বামীর ক্ষেত্রে বরং একটা অন্য প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তদন্তে সহায়তা করার জন্য তিনি স্বেচ্ছায় পুলিশের সঙ্গে গেলেন না কেন? তিনি কি চাইছিলেন, বিষয়টা টানাটানি-জোরাজুরি অবধিই পৌঁছক, তাতে তাঁরই সুবিধে?

শেষ পর্যন্ত যে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত মনে করেছে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্নের সঙ্গে সমঝোতা চলে না, অর্ণব গোস্বামীর শুনানি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি করতেই হবে, এবং অন্তর্বর্তিকালীন জামিন দিতে হবে— এ এক সুসংবাদ। গণতন্ত্রে যত ক্ষণ না অভিযুক্তের অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, তত ক্ষণ পর্যন্ত জামিন একটি নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। যে রাষ্ট্র তা মানে না, তাকে গণতান্ত্রিক দেশ বলা মুশকিল।

অর্ণব গোস্বামী প্রসঙ্গে মাননীয় বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের কথাটা মনে রাখার মতো: ‘‘আমরা যদি আজকেই এর একটা হেস্তনেস্ত না করি, তা হলে কিন্তু আমরা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলব। আমি ওঁর চ্যানেল দেখি না, আদর্শের দিক থেকে আমাদের অনেক দূরত্ব থাকতে পারে, কিন্তু সাংবিধানিক বিচারে তার প্রতিফলন পড়তে পারে না...’’।

বিচারপতি চন্দ্রচূড় এই প্রথম এমন কথা বলছেন না। গত কয়েক বছরে অনেকগুলি ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তি-স্বাধীনতার কথা এতটাই জোরের সঙ্গে বলেছেন। অনেকগুলি মামলায় গণতন্ত্রের প্রধানতম, মৌলিকতম এই আদর্শটির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। অর্ণব গোস্বামীর সৌভাগ্য।

সৌভাগ্যই বটে। গত কয়েক মাসে, গত কয়েক বছরে ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতিতে আরও কত সাংবাদিক, কত ব্যক্তি-নাগরিক ঠিক একই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন! তাঁদের অনেকে এখনও কারারুদ্ধ— বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্ট, এমনকি সুপ্রিম কোর্টে তাঁদের জামিন মঞ্জুর হয়নি বলে!

বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, এগারো নভেম্বরের ঠিক পর পরই এসেছিল ষোলো নভেম্বর। কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের হেবিয়স কর্পাস ধারায় জামিন শুনানিকে জায়গা দিতে পারেনি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত, পিছিয়ে দিয়েছে কুড়ি তারিখ— আজ। কাপ্পানের বিরুদ্ধে কিন্তু অভিযোগ সরাসরি যুক্ত সাংবাদিকের মত-স্বাধীনতার সঙ্গেই। তিনি উত্তরপ্রদেশের হাথরসে সেই ধর্ষিত ও নিহত মেয়েটির বিষয়ে রিপোর্টিং করছিলেন, সঙ্গে ছিলেন আরও তিন সহকর্মী সাংবাদিক— আতিকুর রহমান, আলম আর মাসুদ। প্রত্যেকেই গ্রেফতার হয়েছেন দেশদ্রোহিতার অভিযোগে! চিফ জাস্টিস বোবডে বলেছেন, ৩২ নম্বর ধারা হেবিয়স কর্পাসের নামে এই ধরনের বহু মামলা জমে আছে, সুতরাং তাড়া করা যাবে না। আইনজীবী কপিল সিব্বল কেরলের জার্নালিস্ট ইউনিয়নের তরফে এই মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনি দাবি তুলেছেন, তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে কোনও রকম তথ্যপ্রমাণ নেই যখন, তাঁকে জামিন দেওয়া হোক!

আজ, শুক্রবার, সেই গুরুত্বপূর্ণ শুনানির দিন। জামিন পাবেন কি কাপ্পান— অর্ণবের মতো?

কিংবা— জামিন পাবেন কি প্রতিবাদী মিরান হায়দর, আসিফ ইকবাল তনহা, শিফা-উর রহমান? জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্র এঁরা, সিএএ-বিরোধী আন্দোলন করায় গ্রেফতার হয়েছেন দিল্লি-হত্যাকাণ্ডে ‘উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগে— এখনও কোনও প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও এঁরা বন্দি। এঁদের জামিন না-মঞ্জুর, জেলে এঁরা যথেষ্ট জামাকাপড়ও পাচ্ছেন না, নিজেদের উকিলের সঙ্গে দেখা করার অনুমতিও তাঁদের দেওয়া হচ্ছে না। ৯ নভেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট পুলিশকে রিপোর্ট দিতে বলেছে চার সপ্তাহের মধ্যে, বারো জানুয়ারি আবার শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। অর্থাৎ, তাড়া নেই তেমন।

কিংবা, জামিন পাবেন কি জেএনইউ-এর ছাত্র উমর খালিদ, যিনি সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সৌজন্যে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে অভিযুক্ত? কিংবা ওই আন্দোলনের প্রতিবাদী জেএনইউ-এর নাতাশা নারোয়াল ও দেবাঙ্গনা কালিতা, দিল্লি পুলিশ যাঁদের অন্য অভিযোগে বন্দি করে রেখেছে? কালিতা সুপ্রিম কোর্টেও জামিন পাননি।

কিংবা, কী হবে শারজিল ইমামের, যিনি সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে ‘চাক্কা জ্যাম’-এর ডাক দিয়ে ইউএপিএ আইনে বন্দি হয়েছেন? দিল্লি হাইকোর্ট তাঁর জামিন আবেদন অগ্রাহ্য করেছে। নভেম্বর পুরোলে তাঁর জেলবাসের প্রায় তিনশো দিন হবে। অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রেও তাড়া নেই বিচারবিভাগের।

সাংবাদিকদের কথায় ফিরি। জামিন কি পাবেন আসিফ সুলতান, কাশ্মীরের সাংবাদিক, যাঁকে বিজেপি-বিরোধী প্রতিবাদের দায়ে জেলে রাখা হয়েছে ২০১৮ সাল থেকে— বার বার জামিন অগ্রাহ্য হয়েছে? কিংবা প্যাট্রিসিয়া মুখিম— ফেসবুক পোস্টে সরকার-বিরোধী কথা লিখেছিলেন বলে তিনি বন্দি, মেঘালয় হাইকোর্ট তাঁকে জামিন দেয়নি গত দশ নভেম্বর? বাস্তবিক, কাশ্মীরে ২০১৯ সালের অগস্টে ৩৭০ ধারা রদের পর থেকে ৫৫৪ জন হেবিয়স কর্পাস পিটিশন করেছেন আদালতে, তার পাঁচ শতাংশেরও কম, মাত্র ৩৯টি ক্ষেত্রে এখনও অবধি শুনানি হয়েছে। বর্ষীয়ান, অসুস্থ ভারাভারা রাও-এর জামিনের ব্যাপারে অনেক অনুরোধ, আবেদন, প্রতিবাদ, আলোচনা সত্ত্বেও তা মেলেনি। এলগার পরিষদ মামলায় ২০১৮ থেকে আজ পর্যন্ত অনেককে বন্দি করা হয়েছে, প্রত্যেকের জামিনের প্রশ্ন আদালতে অস্বীকৃত।

একটা অন্য কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অর্ণব গোস্বামী আগেও নাগরিক অধিকারের প্রশ্নটির কেন্দ্রবিন্দু হয়েছেন। এই যেমন, গত মে মাসে। অর্ণব গোস্বামীর পালঘর নিধন কাণ্ডের রিপোর্টিং বিষয়ে যে অভিযোগ উঠেছিল, তার প্রায় সবটাই নাকচ হয়ে গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। অর্ণবকে এই বিষয়ে আরও নতুন কোনও ফৌজদারি মামলায় যেন হেনস্থা না করা হয়, তার সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল। সেই বারেও বিচারকদের মধ্যে ছিলেন মাননীয় বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তিনি ও তাঁর বেঞ্চ বলেছিলেন, সাংবাদিকের স্বাধীনতা হল নাগরিক স্বাধীনতার একেবারে গোড়ার কথা। বাক্স্বাধীনতাকে যে কোনও মূল্যে হোক, রক্ষা করতেই হবে, না হলে ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ থাকবে না!

এই ভারতে আজ এর থেকে জরুরি কথা আর কিছু হতে পারে না। গণতন্ত্রের মৌলিকতম নীতিটির সুরক্ষায় শেষ পর্যন্ত বিচারবিভাগের উপরই তো আমরা ভরসা রাখব! স্থানকালপাত্র নির্বিশেষে...

অন্য বিষয়গুলি:

Arnab Goswami Mumbai Police Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy