Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মনের ভিতরে সেই মনুস্মৃতি

বিধায়ক বিক্রম সিংহ সাইনি যখন তাঁর দলের কর্মীদের এই মর্মে আশ্বাস দেন যে কাশ্মীরে গিয়ে সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করতে আর সমস্যা নেই, তখন বিতর্ক নয়, বিকৃতি প্রকট হয়।

যে দেশে প্রতি ঘন্টায় প্রায় চল্লিশ জন নারী ধর্ষিত হন, সেখানে নারীবাদ নিয়ে এত ঘৃণা কি সত্যিই সাজে?

যে দেশে প্রতি ঘন্টায় প্রায় চল্লিশ জন নারী ধর্ষিত হন, সেখানে নারীবাদ নিয়ে এত ঘৃণা কি সত্যিই সাজে?

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও-এর স্লোগান মাঝে মাঝে মঞ্চ ছেড়ে সাজঘরমুখী হয়ে পড়ে। আর তখন প্রতিবাদী ছাত্রীরা অন্য ‘ব্যবসার সঙ্গে’ যুক্ত আছেন বলে শোনা যায়, প্রখ্যাত আবৃত্তিকার ও বাচিক শিল্পীও ‘অনন্য’ সম্বোধনের হাত থেকে রক্ষা পান না। সম্বোধনকারীরা কি মনে মনে সমাজে ও জীবনে মহিলাদের স্থান সম্পর্কে প্রথম থেকেই এক কট্টর অবস্থান বজায় রেখেছেন? অন্তরের অন্তস্তল থেকে সেই মনুস্মৃতিই কি তাঁদের ঠোঁটে চলে আসে, ভারতীয় সংবিধানকে তাঁরা যার নিরিখে লিখতে চান?

কিছু কাল আগে বিজেপি নেতা অশ্বিনীকুমার চৌবে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ি দেবীকে ‘ঘোমটার আড়ালে’ থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রাবড়ি দেবীর রাজনৈতিক এবং অন্যান্য অবস্থান সম্পর্কে অনেক বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্ত ঘোমটার আড়ালে তাঁর অস্তিত্বকেই ঢেকে ফেলার মধ্যে সমাজে নারীর স্থান নিয়ে একটা সর্বনাশা ইঙ্গিত উঁকি দেয়। উত্তরপ্রদেশের আর এক নেত্রী সাধনা সিংহ বহুজন সমাজবাদী প্রধান মায়াবতীকে ‘নারীজাতির কলঙ্ক’ বলেন। মায়াবতী এর আগে বিভিন্ন কারণে সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁকে ‘নারী’ হিসাবেই দেখা হল। আর ‘কলঙ্ক’ শব্দটিতে তো নারীর জন্মগত অধিকার! গুজরাতের বিধায়ক বলরাম থাওয়ানি এনসিপি নেত্রী নিতু তেজওয়ানিকে পদাঘাত করেছিলেন, চড়ও মেরেছিলেন বলে খবর। নিজের এলাকায় জল সরবরাহের দাবি নিয়ে নিতু তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। নারীর ‘অবলা’ রূপকে পুরুষ-ভারত প্রথম থেকেই পছন্দ করে। তাঁদের শক্তি পুরুষের পূজ্য কিন্তু কাঙ্ক্ষিত নয়। নারীর রক্ষক এবং সুযোগ বুঝে নির্যাতনকারী হয়ে যাওয়া পুরুষ নীল, সবুজ বা গেরুয়া যে কোনও জামাই পরতে পারে।

আমাদের দেশ এখন সেই পুরুষের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী পালন করছে, যাঁর চাইতে বড় নারীবাদী ভারত খুব কমই পেয়েছে। না, ‘নারীবাদ’ নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নিরিখে এই মন্তব্য নয়, নারীকে সসম্মানে পরিবার এবং সমাজের মঞ্চে এসে দাঁড়াবার অধিকার দিতে বিদ্যাসাগর নিজে সারা জীবন লড়াই করেছেন। আর তাঁরই দেশে ‘সেভ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন’এর উদ্যোগে বারাণসীতে গত ২২ সেপ্টেম্বর করা হল ‘পিশাচিনী মুক্তি যজ্ঞ’। উদ্দেশ্য ছিল দেশ থেকে ‘বিষাক্ত’ নারীবাদকে মুছে দেওয়া। ওই দিন ১৫০ জন বিভিন্ন বয়সের স্বামী তাঁদের জীবিত স্ত্রীর শ্রাদ্ধ করলেন, পিণ্ডদান করে গঙ্গাস্নান করলেন। কেউ অস্বীকার করবে না যে আইনের কিছু অপব্যবহার মহিলাদের দ্বারাও হয়ে থাকে। পারিবারিক অশান্তির মূলে অনেক সময় পুরুষের মতো নারীরও ভূমিকা থাকে। কিন্তু যে দেশে বছরে দশলক্ষ কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা হয়, প্রতি ঘন্টায় প্রায় চল্লিশ জন নারী ধর্ষিত হন, মেয়েদের সাক্ষরতার হার যেখানে স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পরও সত্তর ছুঁতে পারেনি, গার্হস্থ্য হিংসার কারণে যে দেশ বিশ্বে সবচেয়ে নিন্দিত, সেখানে নারীবাদ নিয়ে এত ঘৃণা কি সত্যিই সাজে?

কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা উঠে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে। বিতর্ক গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যরক্ষা করে। কিন্তু বিধায়ক বিক্রম সিংহ সাইনি যখন তাঁর দলের কর্মীদের এই মর্মে আশ্বাস দেন যে কাশ্মীরে গিয়ে সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করতে আর সমস্যা নেই, তখন বিতর্ক নয়, বিকৃতি প্রকট হয়। আসলে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের সাবেকি ধারণা পুনর্বার প্রবর্তন করতে পারলে নারীর উপর আধিপত্য কায়েমে সম্ভবত খানিক সুবিধা হয়। সে প্রতিষ্ঠানে যে হৃদয়ের দাবি প্রথমে প্রাধান্য পায়, তা আর কট্টরপন্থীরা কবে মেনেছেন? ‘মন্ত্র’ থেকে ‘মন’ মুছে যাওয়াই তো ধর্ম নিয়ে রাজনীতিকে বার বার সমালোচনার মুখে ফেলেছে। যে দেশ ভগবান কৃষ্ণকে ভক্ত রাধার ‘সখা’ হিসাবে দেখতে জানে, সেই দেশের ‘ধার্মিক’ রাজনীতিকরা অবাক করে দেন। আরএসএস নেতা মোহন ভাগবত বলেছেন, “স্বামী এবং স্ত্রী আসলে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ থাকেন যেখানে স্বামী আশ্বাস দেন যে তিনি স্ত্রীকে দেখবেন, তাঁর প্রয়োজন মেটাবেন আর স্ত্রী বলেন, তিনি বাড়ির দেখাশোনা করবেন।...যদি স্ত্রী এই চুক্তি ভঙ্গ করেন, স্বামী তাঁকে ত্যাগ করতে পারেন।” অর্থাৎ স্ত্রীর কর্মক্ষেত্র বাড়ির চৌহদ্দি আর তিনি তা না মানলে পরিত্যক্ত হতেই পারেন। আপামর নারী জাতির অস্তিত্বকে তাঁরা কী চোখে দেখেন, ভাবলে ধাঁধায় পড়তে হয়।

ভারতের গেরুয়া রাজনীতির অন্যতম প্রধান পুরুষ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী। ক্ষমতায় এসে নারীর নিরাপত্তা এবং সম্মান রক্ষা বিষয়ে অনেক ইতিবাচক কথা আমরা তাঁর মুখে শুনেছি। তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরোধিতায় তিনি সরব থেকে প্রচুর মুসলমান মহিলার ভোটও পান। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাট, পার্কে নীতিপুলিশের দাপাদাপি ছাড়া ‘নারী প্রগতি’র তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো দৃষ্টান্ত দেখিনি। যোগী মহাশয় ২০১০ সালে আইনসভায় ‘মহিলাদের আসন সংরক্ষণ’-এর বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যেটি পরে ২০১৪ সালে তিনি তাঁর ব্লগেও দেন। আদিত্যনাথ যোগীর বক্তব্য, “নারী হলেন ‘শক্তি’। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন ও স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিলে তাঁরা ধ্বংসাত্মক এবং ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারেন।” নারীর স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। যোগীও মনে করেন, “নারীবাদ সমাজের পক্ষে ভীতিপ্রদ।” পশ্চিম থেকে আমদানি হওয়া এই নারীবাদ ভারতের উপর এক অভিশাপ। নারীকে কেবল সঠিক পথে চালনা করতে হবে তাঁর নিজের এবং সমাজের নিরাপত্তার জন্য। স্ত্রীশক্তিকে শৈশবে পিতা, বড় হলে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্র নিরাপদ রাখেন। কিন্তু এমন ‘নিরাপত্তা’য় যে আসলে কী পরিমাণ বিপত্তি, তা হৃদয়বান মানুষ মাত্রই বুঝবেন।

ধর্মীয় মৌলবাদ (সে যে ধর্মই হোক) প্রথম এবং শেষ আক্রমণ হানে নারীর বিরুদ্ধেই। নারীকে পুরুষের ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারা সেই সামন্ততান্ত্রিক দর্শনে নেই। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, দুচারটে অশ্লীল উক্তি করেই কি এই আক্রমণকারীরা ক্ষান্ত হবেন? নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নকে প্রতিহত করতে রাষ্ট্রনীতিও সেই ভাবে পরিবর্তিত হবে না তো?

অন্য বিষয়গুলি:

Feminism Religious Fundamentalism Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE