সমসময়ের ঘটনা পরম্পরায় নজর রাখলে সহজেই চোখে পড়ছে হিংসা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বাহুল্য। এ সব খবর উপচে পড়ছে গণমাধ্যমে। লক্ষণীয়, বহু ক্ষেত্রেই অপরাধীরা দাগী নন, বরং নতুনই। আরও আক্ষেপের কথা, কৈশোর ও সদ্য যৌবনে পা দেওয়া অনেক জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধের সঙ্গে। একই
সঙ্গে চোখে পড়ছে ক্রমবর্ধমান নারীনিগ্রহের ঘটনাও।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতবর্ষে ২০১০ থেকে ২০১৫— এই পাঁচ বছরে নাবালক-কৃত (১৮ বছর বয়সের নীচে) অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে শতকরা প্রায় ৪৭ ভাগ। ৪০টি উন্নয়নশীল দেশে, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, যথাক্রমে শতকরা ৪২ ভাগ ছেলে এবং ৩৭ ভাগ মেয়ে সহপাঠীদের কাছে পীড়ন বা বুলিং-এর শিকার হয়। আর ভারতবর্ষে সব অপরাধের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে নারীর প্রতি হিংসার ঘটনা। ২০১৭ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে তা বেড়েছে শতকরা ৩.৬ ভাগ। এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রতি তিন মিনিটে কোনও না কোনও নারীর উপরে অত্যাচার সংগঠিত হচ্ছে, প্রতি
২৯ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা এবং প্রতি ৭৭ মিনিটে ঘটছে একটি বধূহত্যার মতো ঘটনা।
অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে কী কী উপাদান কাজ করে? তা কি নিছক মনোবিকারের ফসল? নাকি বংশগতি বা জিনগত বিন্যাস ঠিক করে দেয় অপরাধমূলক কাজের প্রতি ঝোঁকটি? নাকি সামাজিক বা পারিবারিক পরিবেশগত উপাদান দায়ী এর জন্য? এই নিয়ে মনোবৈজ্ঞানিকদের গবেষণার অন্ত নেই। তবে দেখা যাচ্ছে এই সবকটি উপাদানেরই কমবেশি ভূমিকা রয়েছে অপরাধমূলক কাজের পিছনে।
বৈজ্ঞানিক লোমবোরসো ১৮১০ সালেই অস্বাভাবিক মানসিক গঠনকে অপরাধ প্রবণতার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন। জার্মানিজাত ব্রিটিশ মনোবিদ হানস আইসেঙ্ক তাঁর ‘থিওরি অব ক্রিমিনালিটি’-তে ব্যক্তিত্বের তিনটি বৈশিষ্ট্যকে এর জন্য দায়ী করেছেন। তারা হল— বহির্মুখীনতা, নিউরোটিক বৈশিষ্ট্য (যাতে থাকে খামখেয়ালিপনা, উদ্বেগ বা হতাশা প্রবণতা, নিজের প্রতি আস্থার অভাব ইত্যাদি) ও সাইকোটিক বৈশিষ্ট্য (যাতে থাকে
আগ্রাসন, আবেগতাড়িত মনোভাব, বৈরীমুখীনতা ইত্যাদি)।
১৯৭৫ সালে বৈজ্ঞানিক ডেভিড রোসেনথাল অপরাধ নিয়ে গবেষণায় পরিবেশের ভূমিকা ছাড়াও অঙ্গুলি নির্দেশ করেন বংশগতির দিকে। যদিও কোনও নির্দিষ্ট জিন বা ‘জেনোটাইপ’-কে এ ব্যাপারে দায়ী করা যায়নি। ১৯৭৭ সালে মনোবৈজ্ঞানিক ক্রিশ্চিয়ানসন একটি গবেষণা করেছিলেন একই রকম পরিবেশে বড় হয়ে মনোজাইগোটিক (যেখানে একটি ডিম্বাণু একটি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে পরে বিভাজিত হয়, তাই জিনগত ভাবে এক রকম) যমজদের অপরাধমূলক কাজে জড়িত হওয়ার ব্যাপারে পরস্পরের প্রতি সামঞ্জস্য শতকরা ৫০ ভাগ, সেখানে ডাইজাইগোটিক (যেখানে দু’টি ডিম্বাণু দু’টি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়, জিনগত সাদৃশ্য থাকলেও এক নয়) যমজদের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য শতকরা একুশ ভাগ। লক্ষণীয়, মনোজাইগোটিক যমজদের আলোচিত ব্যাপারে সামঞ্জস্য অনেকখানি থাকলেও তা কিন্তু শতকরা ১০০ ভাগ হয়নি যা ইঙ্গিত দেয় যে অপরাধগত স্বভাব গঠনের ব্যাপারে শুধু জিন নয়, পরিবেশের প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ।
আবার ১৯৮৪ সালে মনোবৈজ্ঞানিক মেডনিক-সহ কয়েক জন মনোজাইগোটিক যমজদের নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁরা এক এক জনকে সংযোগহীন ভাবে আলাদা আলাদা পরিবারে পালন করার ব্যবস্থা করেন। তাতে দেখা গেল, তাঁরা তাদের আগ্রাসী মনোভাবটি অর্জন করেছে পালক পিতামাতার অনুযায়ী, জৈবিক পিতামাতার অনুযায়ী নয়। এটিও পরিবেশের প্রভাবের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। মনোবৈজ্ঞানিক আপটন ২০১৩ সালে তাঁর ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব বিহেভিয়ারাল মেডিসিন’-এ উল্লেখ করেছেন অপরাধগত স্বভাবের
পিছনে বিভিন্ন সামাজিক পরিবেশের প্রভাবের কথা।
ভারতে গত প্রায় ৭৫ বছরে সামাজিক অবস্থানের পট পরিবর্তন ঘটেছে, প্রথম পর্বে মন্থর ভাবে, পরের পর্বে দ্রুত। এই সময়ের ইতিহাসে লগ্ন হয়ে আছে স্বাধীনতোত্তর সময়ে শিল্পায়নে বিকাশশীল ভারত, নব্বইয়ের দশকের অর্থনৈতিক উদারীকরণের ভারত আর শেষ পর্বে আগ্রাসী বিশ্বায়নে সমর্পিত ভারত। এই পরিবর্তনের ছবি কি ফুটে উঠছে এই সময়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের চরিত্রে? দেখা যাক, সম-সময়ের কিছু পরিসংখ্যান।
এনআরসিবি থেকে পাওয়া যাচ্ছে কিছু কৌতুহলোদ্দীপক পরিসংখ্যান। দেখা যাচ্ছে ১৯৫৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যেখানে চুরির ঘটনা কমেছে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ, ডাকাতির ঘটনা কমেছে শতকরা প্রায় ২৯ ভাগ, সেখানে খুন এবং অপহরণের ঘটনা
বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ৭.৩৯ এবং ৪৭.৮ ভাগ।
এটি প্রতিষ্ঠিত যে, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ অবশ্যই দারিদ্র ও দারিদ্রগত পরিবেশ, অশিক্ষা এবং অভিভাবকহীন ভাবে বেড়ে ওঠা। কিন্তু এনআরসিবি-র সাম্প্রতিক তথ্য, পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে একটু অন্য রকম ছবি। ২০১৬ থেকে ২০১৭ এই এক বছরে ‘শিক্ষিত’ (১০ বা ১২ ক্লাস পর্যন্ত পড়া) নাবালক অপরাধীর সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ৩২ ভাগ। অন্য দিকে, ‘অশিক্ষিত’ নাবালক অপরাধীদের সংখ্যা কমেছে শতকরা ২০ ভাগ। আবার, যেখানে অপরাধীদের শতকরা ৮৬ ভাগ বাস করেন বাবা-মায়ের সঙ্গে, শতকরা ১০.৩ ভাগ অভিভাবকের সঙ্গে, সেখানে শতকরা মাত্র ৩.৫ ভাগ গৃহহীন।
এই পরিসংখ্যানের কারণ হিসেবে অনেকে সরাসরি অঙ্গুলিনির্দেশ করেন পরিবর্তিত সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানের দিকে। সভ্যতার হাত ধরে আসা শিল্পায়ন, নগরায়ন ইত্যাদির প্রভাব সঙ্কীর্ণ করেছে যৌথযাপনের আকাশকে, কৌমযাপনের অবকাশকে। যৌথ পরিবার ভেঙে হয়েছে অণু পরিবার। জীবনযাপনের ক্লেশ, চাপ, উদ্বেগগুলি বন্টিত হয়ে ছড়িয়ে যাওয়ার পরিসর হয়েছে খণ্ডিত। আগ্রাসী পণ্যসংস্কৃতির চাপে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছে ‘সরল যাপন ও উচ্চচিন্তা’-এর জীবনদর্শন। মান্যতা পাচ্ছে পণ্যশোভিত জীবনযাত্রা। সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদে নিঃশব্দে ঋণাত্মক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে মূল্যবোধের। মনস্তত্ত্ববিদরা ‘স্ট্রেন থিওরি’ জানান, কারও লক্ষ্য এবং তা পূরণের জন্য যে উপায় তিনি ব্যবহার
করবেন, তাদের সংঘর্ষের মধ্যেই পথ খুঁজে নেয় অপরাধ।
নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারে সন্তানেরা বড় হচ্ছে প্রত্যাশার চাপ নিয়ে। আত্মকেন্দ্রিকতাকে সঙ্গী করে তারা সামিল হচ্ছে ইঁদুর দৌড়ে। আবার স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা না চাইতেই পেয়ে যাওয়ার অযাচিত প্রশ্রয় পাচ্ছে। ব্যস্ত পিতামাতা সন্তানদের ঠিকমতো সময় দিতে অপারগ। বিভিন্ন রকম পরিস্থিতিতে সন্তানেরা অভিভাবকদের পাচ্ছে না ভাবাবেগের ভাগীদার বা পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়। বয়ঃসন্ধিতে জেদ ও আগ্রাসী মনোভাব আনছে আচরণগত ব্যাধি। ভুলভাল সঙ্গী নির্বাচন বাড়াচ্ছে বিপদ। অনেকে পড়ে যাচ্ছে নেশার কবলে। মনোবৈজ্ঞানিক ট্রাভিস হিরোসকি-র মতে সামাজিক সম্পর্কের দূরত্ব সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে বাড়িয়ে দেয় অপরাধপ্রবণতা। আর অপরাধমূলক কাজের প্ররোচনা যেন ছড়িয়ে থাকছে সর্বত্রই। চলচ্চিত্রে, গণমাধ্যমে হিংসা, যৌনতার ছড়াছড়ি। বিজ্ঞাপনে ও বিভিন্ন স্তরে নারী শুধু যৌনতার প্রতীক। অভিভাবক বা ঠিকমতো সূত্র থেকে যৌনশিক্ষা অমিল থেকে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে। প্রশস্ত হচ্ছে নারীঘটিত অপরাধের পথ। এ ভাবেই আজ সামাজিক পারিবারিক পরিবেশের প্ররোচনামূলক উপাদানগুলি অন্য উপাদানের সঙ্গে আন্তঃবিক্রিয়ায় প্রস্তুত করে দিচ্ছে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্র। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সর্বস্তরে সচেতনতা আজ বড় জরুরি।
আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy