আবার একটা নারী দিবস এসে গেল। আমি ও আপনি আবারও দাঁত মাজা, খাওয়া, ঘুমোনোর প্রাত্যহিকতার ফাঁকে ফাঁকে কিছু অলস ভাবনাচিন্তা করব। লক্ষ্মীর পক্ষে অবশ্য সেটুকুও সম্ভব নয়। লক্ষ্মী আগরওয়াল। হ্যাঁ, ‘ছপক’-এ যাঁর ভূমিকায় দীপিকা পাড়ুকোন অভিনয় করলেন। সিনেমা তো হল লক্ষ্মীর জীবন নিয়ে। কিন্তু লক্ষ্মীর জীবনের অন্ধকার একটুও কমল কি?
দীপিকার অবশ্য একটা কুর্নিশ প্রাপ্য, নায়িকা জীবনের মধ্যগগনে এক জন অ্যাসিড আক্রান্তের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বলে। কিন্তু তার পরেই একটি ইন্টারভিউতে তিনি বলে বসলেন যে, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় তিনটে মেক-আপের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ছপক’-এর মেক-আপ। কথাটার মধ্যে একটা ভয়ানক অসংবেদনশীলতার ছাপ দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। এক জন মেয়ের কাছে যে মুখ শুধু একটা যন্ত্রণা নয়, একটা পুড়ে যাওয়া ভয়ঙ্করতার সাক্ষী, সেটাই অন্য কোনও মেয়ের কাছে আবার প্রিয় মেক-আপও বটে!
মনে পড়ে, কাজের সূত্রে একটি ডাক্তারি ক্যাম্পে যেতে হয়েছিল এমন একটা জায়গায় যেখানে মনীষা পৈলানের বাড়ি। মনীষাও অ্যাসিড আক্রান্ত। অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের হয়ে তিনি লড়াই করছেন। অবাক হয়েছিলাম দেখে, ওই অঞ্চলের কিছু মানুষ মনীষার ‘স্বভাবচরিত্র’ নিয়ে কথা তুলছিলেন। এখনও কথায় কথায় কোনও ছেলে কোনও মেয়েকে মুখে অ্যাসিড মারার হুমকি দেয়। গোটা উপমহাদেশ জুড়েই এই চিত্র। ক’দিন আগেই পুড়ে মারা গেলেন মা ও মেয়ে। মায়ের নাম রমা না অন্য কিছু, মেয়ের নাম রিয়া না আয়েশা, তা নিয়ে প্রচুর তোলপাড় হল। খবরের কাগজে ওই দুই নারীর চরিত্র বিশ্লেষণ হল কয়েক দিন। জানাই আছে, কোনও মেয়ের বীভৎস মৃত্যুর থেকেও বেশি গুরুতর তার সমাজ-নির্ধারিত চরিত্র।
এমন হাজারো খুঁটিনাটি ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে নারী-স্বাধীনতা বস্তুটা এখনও আসলে কেতাবি। পুরুষেরা নারী-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না, এই কথা বলা যথেষ্ট নয়। নারীরাই এতে বিশ্বাস করেন না। ফেসবুকে সে দিন একটি আলোচনা দেখছিলাম যেখানে কয়েক জন নারীর মধ্যে আলোচনা চলছে, তাঁদের বাড়ির কাজের মাসিরা কে কী রকম ভাবে তাঁদের ঠকিয়ে থাকেন। যাঁরা ভোর পাঁচটার সময় আসেন, আর বাড়ি ফিরতে বিকেল চারটে হয়ে যায়, তার পর রান্না বসান, সেই মেয়েরা কার পার্স থেকে একশো টাকা কবে চুরি করেছিলেন, কোন কাজে ফাঁকি দিয়েছিলেন কিংবা কে নিয়ত মাইনে বাড়ানোর জন্য আবদার করেন, তাই নিয়ে ফেসবুকের ওপেন পোস্টে আলোচনা চলছে।
স্বাভাবিক ভাবেই, কলকাতা শহরে এত বছরের বাম শাসনের পরেও বাড়ির কাজের মহিলাদের কোনও ইউনিয়ন নেই। তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে কোনও দিন কেউ বিক্ষোভ করেননি। তাঁদের ছুটি দিতে হবে, নির্দিষ্ট মাইনে দিতে হবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, কেউ এমন বলেননি। ওঁদের যন্ত্রণার ভাগ নিতে গেলে যে নিজেদের আরামের একটুখানি বিসর্জন দিতে হয়। আমরা তো আরামে থাকতে চাই!
এই আরামে থাকতে গিয়েই আমরা পুরুষ-নারী নির্বিশেষে হয়ে উঠছি এক অদ্ভুত আমোদগেঁড়ে জীব যাঁদের কাছে ওই আরামটাই সব। সোশ্যাল মিডিয়ার আরাম চাই, টিভির আরাম চাই, মাল্টিপ্লেক্সের আরাম চাই, পপকর্নের আরাম চাই।
আর অবশ্যই এত আরামের মধ্যে ভুলে যাওয়ার আরামটাও চাই যে, এই দেশে, শহরে কিংবা গ্রামে অসংখ্য নারী প্রতি দিন মাথায় একটা কলসি নিয়ে তিন কিলোমিটার হেঁটে যাচ্ছেন একটু পানীয় জলের জন্য। নিজেদের আরামের জন্যই ভুলে যাওয়া চাই যে, গ্রামে গ্রামে মেয়েদের বিয়ের প্রাথমিক শর্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাড়ির কাছে একটা টিউবওয়েল আছে কি না, সেই টিউবওয়েলে জল ওঠে কি না। যখন এক দল মেয়ে জলের খোঁজে রাত থাকতে মাথায় আর কাঁখে কলসি নিয়ে অনন্ত যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন, তখন আর এক দল নারী এসি ঘরে শুয়ে ভাবছেন, শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে কখন আরাম পাব।
সত্যি কথাটা আসলে কাঁটার মতো খচখচে— আজও ভারতের অসংখ্য মেয়ের শৌচের ব্যবস্থা নেই, স্নানের ব্যবস্থা নেই, পিরিয়ডসের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা নেই, নিজের শরীরের ওপর নিজের অধিকারের ব্যবস্থা নেই, সন্তান ধারণে ‘না’ বলার অধিকারটুকু নেই। এই বারের নারীদিবস কি আরামে থাকা নারীদের একটুও কিছু ভাবাল?
মাঝে মাঝে মনে হয়, ‘না’ বলার অধিকারটুকু প্রতিষ্ঠা হলেই অনেকখানি বদল সম্ভব। কেবল পুরুষকে নয়, নারীকেও ‘না’ বলতে হবে, যদি সেই নারী শোষকের প্রতিভূ হয়ে আসেন। নারী ‘না’ বলতে শিখুক, নারী নিজের জীবন নিজের শর্তে বাঁচতে শিখুক। নারী শিখুক যে মাটি কোন শস্য ফলাবে তা ঠিক করার অধিকার মাটিরই। মেয়েরা কী ভাবে তাঁদের জীবন কাটাবেন, অন্যরা তা ঠিক করে দেবেন না, এইটুকু নিশ্চিত করতে হবে। কেবল আমাদের মতো মেয়েরা নয়, সব রকমের মেয়েরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy