জর্জিয়া।
দুটো দূর দেশের গল্প বলি। বহু দূরের দেশ— গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ থেকে! খ্রিস্টের জন্মের ছ’শো বছর আগে, এখন যাকে জর্জিয়া নামে ডাকা হয়, সেই এলাকা আইবেরিয়া আর কোলচিস নামে দুটো সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল। আইবেরিয়ার অংশ ছিল দক্ষিণ অসেশিয়া অঞ্চল, আর কোলচিসের মধ্যে ছিল আবখাজ়িয়া। ককেশাস পর্বতের দক্ষিণে জর্জিয়া একেবারে পুঁচকে দেশ। কিন্তু তারও শান্তি নেই। ওই দুই অঞ্চল নিয়ে জেরবার।
হাজার বছর আগে আইবেরিয়ার অধীন দক্ষিণ অসেশিয়া অঞ্চল জর্জিয়ার রাজত্বে যুক্ত হয়। এর পর খারাপ শাসক এসে গা-জোয়ারি করেছেন, অপেক্ষাকৃত সহৃদয় শাসক এসে কিছুটা আরাম দিয়েছেন। বিশ শতকের আগে অবধি কখনও ভাল কখনও মন্দ থেকেছে দক্ষিণ অসেশিয়া। বলশেভিক বিপ্লবের পর স্বাধীন জর্জিয়ার অংশ হয়ে যায় ওই অঞ্চল। শুরু দ্বন্দ্ব। শিদা খার্থলি এলাকার ভূমিহীন অসেশিয়ান চাষিরা বলশেভিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মেনশেভিক সরকারের অনুগৃহীত জর্জিয়ার অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। বাহিনী নামায় টিফলিসের (জর্জিয়ার রাজধানী) কেন্দ্রীয় সরকার। অসেশিয়ানরা হার মানে। ১৯২১-এ লাল ফৌজ জর্জিয়া দখল করে, এবং দক্ষিণ অসেশিয়ানদের জন্য স্বশাসিত প্রদেশ বা ওব্লাস্ত তৈরি হয়। অতঃপর শান্তি পর্ব।
সোভিয়েত পতনের কালে জর্জিয়া স্বাধীন হয়, এবং সোভিয়েত জর্জিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয় দক্ষিণ অসেশিয়া। পাল্টা তাদের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করে সেনা পাঠায় জর্জিয়া। ১৯৯১-৯২ সালে যুদ্ধ লাগে। নিষ্পত্তি হয় না। সংবিধান রচনা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, পৃথক অর্থনীতি— নিজেদের মতো করে চলতে থাকে দক্ষিণ অসেশিয়া। ফের ২০০৪-এ যুদ্ধ। স্বাধীনতার দাবি প্রত্যাহারের শর্তে স্বায়ত্তশাসন দিতে চায় জর্জিয়া। কিন্তু দক্ষিণ অসেশিয়া গণভোট করে আলাদা হতে চায়। সেখানে সাময়িক প্রশাসন তৈরি করতে চেয়ে আইন পাশ করে জর্জিয়া। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বলে, মর্টার আর স্নাইপার রাইফেল দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। আলোচনার আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ভেস্তে যায়। ও দিকে, সার্বিয়া থেকে কসোভোর স্বাধীনতার ফলে অসেশিয়ানদের দাবি জোরদার হয়। ক্ষমতা ভাগ করে নিতে রাজি হয় না তারা। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে ৎস্কিনভালি (দক্ষিণ অসেশিয়ার রাজধানী) মুক্ত করার কথা বলে জর্জিয়ার সরকার। রাশিয়ার চক্রান্তের গন্ধ পায় তারা। ২০০৮-এর যুদ্ধে ঢুকে পড়ে রাশিয়া। মস্কোর সাহায্যে নিজের এলাকা দখল করে নেয় দক্ষিণ অসেশিয়া।
কী বলছেন? গল্পটা চেনা চেনা লাগছে? ধুস, যত সব উদ্ভট ভাবনা! এত মিল খোঁজার বদ অভ্যাস কেন? কল্পনাপ্রবণ হবেন না। আর অত ভাবা প্র্যাকটিস করবেন না। বাকিটা শুনুন। ইতিহাসের ধারায় যখন যে ক্ষমতায় এসেছে— রোমান, বাইজ়ান্টাইন, অটোমান— তাদের অধীনে চলে গিয়েছে আবখাজ়িয়া। আরবদের বিরুদ্ধে লড়ার পর আবার বাইজ়ান্টাইনদের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসনও দাবি করেছে আবখাজ়িয়ার রাজপুত্রেরা। অটোমানদের হাত থেকে নিস্তার পেতে রুশদের সঙ্গে চুক্তি করে তারা, কিন্তু তাদের হাতেই দখল হয়ে যায়। অটোমান আমলে ইসলামে ধর্মান্তর হয়, আবখাজ় মুসলমানদের অটোমান সাম্রাজ্যে পাঠিয়ে দেয় রুশরা। নিজেদের এলাকায় সংখ্যালঘু আবখাজ়দের ওপর রুশ ভাষা চাপিয়ে দেয় জ়ারের সরকার। আপত্তি করে আবখাজ় এবং জর্জিয়ানরা।
এর পর বলশেভিক বিপ্লব আমলের গল্পটা অবিকল দক্ষিণ অসেশিয়ার মতো। কেবল সোভিয়েত আবখাজ়িয়া বেশি দিন স্বশাসন পায়নি। রাজনীতির অঙ্কে স্তালিনের আমলে অত্যাচার, এবং পরের আমলে আবখাজ়দেরই শাসনকাজে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সোভিয়েত পতনের ইঙ্গিত এবং জর্জিয়ার স্বাধীনতার দাবিতে ভয় পায় তারা— নতুন দেশে স্বায়ত্তশাসন থাকবে তো? জর্জিয়ার স্বাধীনতার গণভোটে যোগ না দিয়ে সোভিয়েত টিকিয়ে রাখার পক্ষে রায় দেন ৯৮.৬ শতাংশ জনতা।
নব্বইয়ের দশকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ১৯৯২-৯৩ সালের যুদ্ধে আবখাজ়িয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায় জর্জিয়া। তারা কার্যত স্বাধীন হয়। এলাকা থেকে তাড়ানো হতে থাকে জর্জিয়ানদের। ১৯৯৪-এ অস্ত্রবিরতি চুক্তি, তবে মতবিরোধ মেটে না। একাধিক শান্তিরক্ষা বাহিনী ও পর্যবেক্ষক দল এলেও সংঘর্ষ থামে না। ২০০৮-এর অগস্টে ফের যুদ্ধ, এ বার সঙ্গে রাশিয়া। মস্কোর সহায়তায় পৃথক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
উত্তরের দুই এলাকাকেই রুশ-অধিকৃত ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করে জর্জিয়ার পার্লামেন্ট। রাষ্ট্রপুঞ্জের বেশির ভাগ সদস্যও সহমত। দক্ষিণ অসেশিয়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে তাকে শিদা খার্থলির অংশ করে রেখে দেওয়া হয়েছে।
আবখাজ়িয়া অবশ্য স্বশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দুইয়ের কোনওটির ওপরেই নিয়ন্ত্রণ নেই জর্জিয়ার। ও দিকে রাশিয়া, ভেনেজ়ুয়েলা, নিকারাগুয়া, নাউরু এবং সিরিয়া এদের পৃথক রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করে। রাশিয়ার সাহায্যও পায় দুই অঞ্চল।
কাশ্মীর-টাশ্মীরের সঙ্গে এ গল্পের কোনও যোগ নেই কিন্তু। সিনেমা দেখেন তো, শুরুতে ঘোষণা থাকে, এই লেখাও বিলকুল সে রকম, ‘এই গল্পের কোনও চরিত্র কাশ্মীরি নন। কাশ্মীরের— জীবিত অথবা মৃত— সঙ্গে মিল সম্পূর্ণ কাকতালীয়।’
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy