Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

চিন্তাভাবনা তো কাজ নয়!

প্রধানমন্ত্রী মাঝেই মাঝেই বলেন তিনি সারা ক্ষণ কাজ করেন। ভক্তরা বলেন, দিনে বাইশ ঘণ্টা। তা হলে উনি দিনে দু’ঘণ্টা ঘুমোন। মুশকিল। কেননা, মনোবিদরা বলেন, কম ঘুমোলে নাকি ফল ভাল হয় না। দিনে দু’ঘণ্টা ঘুমোনোর পরামর্শ বোধ হয় ডোনাল্ড সাহেবের ব্যক্তিগত মনোবিদও দেবেন না।

শুভ্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৫৫
Share: Save:

প্রধানমন্ত্রী মাঝেই মাঝেই বলেন তিনি সারা ক্ষণ কাজ করেন। ভক্তরা বলেন, দিনে বাইশ ঘণ্টা। তা হলে উনি দিনে দু’ঘণ্টা ঘুমোন। মুশকিল। কেননা, মনোবিদরা বলেন, কম ঘুমোলে নাকি ফল ভাল হয় না। দিনে দু’ঘণ্টা ঘুমোনোর পরামর্শ বোধ হয় ডোনাল্ড সাহেবের ব্যক্তিগত মনোবিদও দেবেন না।

আসলে, যত ক্ষণ না ঘুমোয় প্রায় সকলেই কাজ করে। দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী তাঁর একটি রচনায় মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, কাজ বিষয়ে ‘কায়মনোবাক্য’ কথাটা কয়েক দিন আগেও লোকে ব্যবহার করত। কাজ তিন প্রকার। কায়, মন আর বাক্য। কায়িক শ্রম যেমন কাজ, তেমনই কথা বলা আর চিন্তা করাও কাজ।

অর্থাৎ সেনা-পুলিশ-ম্যানেজার-সেলেব্রিটি-মন্ত্রী-আমলা তো বটেই, তাঁরা ছাড়া অন্যরাও আসলে কাজ করছে। কিন্তু দুটো লোক ঘোরতর কাজ-কাজ পরিবেশে চা খেতে খেতে গল্প জুড়লে অদূরে দণ্ডায়মান জওয়ান-ভাই মনে মনে ভাববে, পাবলিক আমোদ করবে আর আমরা কাজ করব! চিন্তা আর বাক্য যে কাজ, সেটারও যে কায়িক কাজের মতো মূল্য আছে, সেটা এনজিও প্রধান বা সেনাকর্তাদের বোঝানো খুব কঠিন। কথায় কথায় পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে উৎসাহী লোককেও।

কিন্তু দেখুন, জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের প্রচুর পরিমাণে বিজ্ঞানসম্মত কায়িক শ্রম করার পরেও কোচের ক্লাসে হাজির থাকতে হয়। শুনেছি, একটা চিন্তাপূর্ণ কলস অথবা থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ব্যবস্থাও আছে।

লোকে যখন বলে “কাজের খুব প্রেশার যাচ্ছে”, “এত কাজের চাপ, কখন কবিতা লিখব”: তখন তাঁরা ঠিক ‘কাজ’ বলতে কী বোঝান? মনে হয় তাঁরা পরিশ্রমের দিকটাই ইঙ্গিত করেন। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় যে, দেশে একটা অস্বাভাবিক ‘কর্ম’মুখরতার পরিবেশ কৃত্রিম ভাবে তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে কেবলই কাজ-কাজ ভাব থাকবে, ছুটির কথা তুললেই কটাক্ষ, এব‌ং চিন্তাভাবনার ইঙ্গিত দেখলেই ব্যঙ্গবিদ্রুপ। ‘কাজ’ হবে এমন যে, দেখে লোকে বলবে, হ্যাঁ! কাজের মতো কাজ হচ্ছে বটে! বাক্য বা শব্দের কাজ আর ‘কাজ’ বলে গণ্য হবে না। বাক্য বলতে কেবল কাজের পরিভাষা বোঝাবে, এবং নিতান্তই যদি চিন্তা করতে হয়, তবে হাঁটতে হাঁটতে ভাবনাচিন্তা করতে হবে, নইলে লোক বুঝবে কী ভাবে যে আপনি কাজের মতো চিন্তা করছেন! বিশ্রাম ছাড়া স্থির হয়ে বসার কোনও অধিকার নেই সেই ‘কর্মময়’ দেশে।

প্রধানমন্ত্রী দেশের জন্য সারা ক্ষণ কাজ করেন। তিনি নিজেই এ কথা বলেছেন। এ সব কথা তিনি জনসভাতেই বলেন, প্রায় সব জনসভাতেই। দলের হয়ে জনসভা করা নিশ্চয়ই দেশের কাজ, দলের কাজ। মনে করা যাক, দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর আপিস বা বাড়ি থেকে কলকাতায় সভা করে ফিরে যেতে সময় লাগে সাত ঘণ্টা। এই সাত ঘণ্টা পূরণ করার জন্য কি তিনি পরের সাড়ে তিন দিন না ঘুমিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব করেন?

একদা এক সভায় শুনেছিলাম, ভাবী ম্যানেজারদের উদ্দেশে বক্তা বলছেন, চব্বিশ ঘণ্টা কাজ নিয়ে ভাবতে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে গেলেও প্রোডাক্ট নিয়ে কথা বলতে হবে। মনে হয়, তিনি বাক্যে কিছু অতিরেকজাতীয় অলঙ্কার প্রয়োগ করেছিলেন। নইলে, এই ধরনের উপদেশ পালন করতে গেলে প্রত্যেকের বাঁধা মনোবিদ আবশ্যক।

চার পাশ দেখে মনে হয়, এই মুহূর্তে এ দেশের সমাজের সেরা দ্বন্দ্বগুলোর অন্যতম হল কায় আর মন-এর দ্বন্দ্ব। কায়বিদরা বলছেন, কাজ করো, চাপ নাও, মেডিক্লেম করো, ডায়াবেটিস বাধাও, সেন্ট পার্সেন্ট দাও, ঘুম কমাও, দারু খাও। মনোবিদরা বলছেন, চাপ কমান, নিজেকে সময় দিন, পরিবারকে সময় দিন ইত্যাদি।

একটা বিষয় ভুল বোঝা যাবে না। কায়িক শ্রম করলেই যে সাফল্য নিশ্চিত, কিংবা দারুণ রোজগার করছেন, এমন ভাবার দরকার নেই। কৃষক-শ্রমিকরা দৃষ্টান্ত। তবে হ্যাঁ, কৃষকরা যে ‘কাজ’ করেন, সেটা মন্ত্রীদের কথায় প্রায়ই শুনি। অনেক সময় এ বিষয়ে তাঁদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হয়, দেশের সবাই চব্বিশ ঘণ্টা কৃষক-শ্রমিকদের মতো কাজ করুক, এটাই তাঁদের কাম্য। তাঁদের শুধু খেয়াল রাখতে হবে যে কৃষক, শ্রমিক এবং অন্যরা যেন তেমন সুযোগ না পান যাতে চিন্তা করা যায়, প্রশ্ন তোলা যায় যে— আরে! মিল মালিকের কাছ থেকে আখের দাম তিন বছর পরেও মেলে না কেন?

সমাজে মনহীন, বাক্যহীন কাজের লোক কাতারে কাতারে সৃষ্টি হলে শাসন করা সব সময় নিরাপদ। দেশের জন্য চিন্তা করাটাও তখন হয়ে যাবে ‘আলস্য’। দেশের জন্য কিছু বলা হয়ে যাবে অপ্রয়োজনীয় বকবক। দেশের জন্য একমাত্র কাজ দাঁড়াবে, বন্দুক কাঁধে সীমান্ত পাহারা দেওয়া। একান্তই সেটা না পারলে অন্তত তেমন কিছু করতে হবে যার ভেতর থেকে ‘দেশ-দেশ’ ধ্বনি অতি উচ্চরবে ভেসে আসে।

যদি দলের কাজ নিয়ে মোট কাজের ঘণ্টা মাপা হয়, তবে আমি-আপনিও বাইশ ঘণ্টা দেশের জন্য কাজ করি। সব জন্তুই খাটতে পারে নাম হয় গাধার।

অন্য বিষয়গুলি:

Workaholic Environment India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy