২০১১-র হলিউডি সিনেমা ‘কন্টেজন’-এ পরিচালক স্টিভেন সোডারবার্গ দেখান, এক কল্পিত সংক্রামক ভাইরাসের আক্রমণে আমেরিকা এবং পৃথিবী তছনছ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। করোনাভাইরাস ও আজকের পৃথিবীর সঙ্গে সিনেমাটির অবিশ্বাস্য মিল।
‘কন্টেজন’ মুভিটিতে হংকং থেকে ফিরে মিনিয়াপোলিসের উপকণ্ঠে অজানা অসুখে মারা যায় গিনেথ প্যালট্রো অভিনীত চরিত্রটি। অজানা এক ভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে গোটা আমেরিকায়। সে দেশের হোম সিকিয়োরিটির অফিসারেরা ভাবতে শুরু করেন অসুখটি জৈব মারণাস্ত্র কি না, যা হয়তো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সন্ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়লে গোটা শিকাগো শহরটাকেই কোয়ারান্টাইন বা বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।
করোনা আতঙ্কে আজ বিশ্বজুড়েই এক অবিশ্বাস্য ত্রাসের আবহ। এ প্রবন্ধ লেখার সময় পৃথিবীময় ১১৫টি দেশে প্রায় সওয়া লক্ষ আক্রান্ত। মৃত্যু হয়েছে ৪,৩০০ জনের। দরজা-জানালা বন্ধ করে নানা দেশ কার্যত হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন, অবরুদ্ধ। বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক সফর ধাক্কা খেয়েছে অনেকটাই। বাতিল আনন্দ-উৎসব, নানা সম্মেলন, এমনকি শীর্ষ বৈঠকও। নরেন্দ্র মোদী বাতিল করেছেন তাঁর বেলজিয়াম যাত্রা, বাংলাদেশ সফর। দুনিয়া জুড়ে অজস্র ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দফারফা। এমনকি টোকিয়ো অলিম্পিক্সের উপরেও অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। তবু, এখনও পর্যন্ত যা খবর, এমন প্রভাবশালী করোনাভাইরাসও বোধ হয় মাথা নোয়াতে চলেছে টাকা-উপচে-পড়া আইপিএল-এর সামনে।
মহামারি বিস্তারের অন্তর্নিহিত পদ্ধতি নিয়ে বেশ কিছু গাণিতিক মডেল রয়েছে। সুস্থ মানুষের সংক্রমিত হওয়ার, পুনরায় সুস্থ হওয়ার, কিংবা মারা যাওয়ার হারের সাংখ্যমান এ সব ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার’ (বিআরএন) অর্থাৎ এক জন আক্রান্ত গড়ে সংক্রমিত করে কত জনকে, সেটা মহামারি ছড়াবার একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। ‘বিআরএন’ যত বেশি হবে, মহামারি ছড়াবে তত দ্রুত। আক্রান্তদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার মূল উদ্দেশ্য এই ‘বিআরএন’-কে কমানো।
‘কন্টেজন’ ছবির ভাইরাসটির ‘বিআরএন’ ছিল ৪। জানা যায়, সেই ভাইরাসের প্রকোপে আক্রান্ত হবে পৃথিবীর প্রতি ১২ জনের এক জন, এবং এই অসুখে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর হার ২৫-৩০%। যার অর্থ হল, পৃথিবীর প্রায় সওয়া দুই শতাংশ মানুষের মৃত্যু সম্ভব ছিল গল্পের এই অজানা অসুখে। আজকের পৃথিবীর মতোই সেখানে বাড়তে থাকে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর পরিধি। কমে আসে সামাজিক সংযোগের পরিমাণ। শেষে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয় চিনে একটি গাছ ভেঙে পড়লে উড়ে যায় কিছু বাদুড়, যাদের একটির মুখ থেকে পড়া এক টুকরো কলা খেয়ে ফেলে একটি শূকর। এই শূকরটিকে রান্না করে যে শেফ, তার সঙ্গে করমর্দনের ফলে অসুখটি প্রথম হয় গিনেথ প্যালট্রো অভিনীত চরিত্রটির। কল্পিত এমইভি-১ নামের ভাইরাসটি আসলে শূকর এবং বাদুড়ের জিনের সংমিশ্রণ। নিপা ভাইরাসের কথা মাথায় রেখেই হয়তো নির্মাণ হয়েছিল এ গল্পের।
এক শতাব্দী আগে হয়েছে মানব-ইতিহাসে ফ্লু ভাইরাসের ভয়ঙ্করতম মহামারি। ১৯১৮ সালের ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। পৃথিবীর জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ আক্রান্ত হয় সেই ফ্লু-তে, মারা যায় ৫ কোটি লোক। দুই মহাযুদ্ধে যত লোক মারা গিয়েছে, তার চেয়েও বেশি। স্প্যানিশ ফ্লু-র ‘বিআরএন’ ছিল ২-৩, আর করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে তা ২.২-৩.৯। স্প্যানিশ ফ্লু-এর মৃত্যুহারও (২.৫%) করোনার প্রায় সমান (২.৩%)। তবে কি করোনাভাইরাসের প্রকোপে ধ্বংসের ছবিটাও একই রকমের হবে? খুব সম্ভব, না। একশো বছরে পৃথিবী বদলেছে অনেকটাই।
গত দু’দশকেই দুনিয়া দেখেছে অনেকগুলি মহামারি। ২০১৪-র মার্স-এর ‘বিআরএন’ অনেক কম (০.৩-০.৮) হলেও, অন্য অনেক ক্ষেত্রেই ‘বিআরএন’-এর মান ছিল বেশ চড়া।
২০০২-০৩-এর সার্স মহামারির ‘বিআরএন’ ছিল ২-৪, ২০০৯-এর সোয়াইন ফ্লু-র ক্ষেত্রে তা ১.৩৩, ২০১৩-১৬’র ইবোলা-র ক্ষেত্রে ১.৫-২.৫, আর ২০১৮-র নিপা-র ‘বিআরএন’ ৪.৭। তাই করোনার সংক্রমণ-হার বাঁধন-ছাড়া নিশ্চয়ই নয়। আবার ‘আক্রান্তের মৃত্যুহার’ সোয়াইন ফ্লু-র ক্ষেত্রে বেশ কম (০.০১%-০.০৩%) থাকলেও, বেশির ভাগ সাম্প্রতিক মহামারির মৃত্যুহার ছিল অনেকটাই বেশি। সার্সে মৃত্যুহার ১০%, মার্সে তা ৩৯%, এবোলায় ৫০%, নিপায় ৫০%-৭৫%। বিশ্বজুড়ে সার্সে আক্রান্ত হয়েছিল ৮,০৯৮ জন, মৃত্যু হয় ৭৭৪ জনের; সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হয় দুনিয়ার ১১%-২১%, মৃত্যু হয় পৌনে ছয় লক্ষ মানুষের; আর এবোলায় ২৮ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১১ হাজারের বেশি। এই তুলনামূলক চালচিত্র থেকে করোনাভাইরাস মহামারির সম্ভাব্য অভিঘাত সাম্প্রতিক অন্য মহামারিগুলোর থেকে অন্তত বেশি হবে বলে মনে হয় না।
তবু এক নজিরবিহীন আতঙ্কের করাল গ্রাসে আটকে পড়েছে বিশ্বজনতা। সেই সঙ্গে মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ারের আকাল দেখা দিয়েছে দেশে দেশে। কম পড়েছে মেডিক্যাল স্টাফ, কোয়ারান্টাইন করার জায়গা। আমেরিকার মতো দেশে পর্যন্ত টেস্ট কিট অপ্রতুল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই বিদেশ থেকে আসা লোকদের মেডিক্যাল পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা সার্বিক ভাবে প্রয়োগ করতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছে বেশ খানিক। তার মধ্যেই হয়ে গিয়েছে অনেকখানি সংক্রমণ। এই সঙ্কটকালে বিভিন্ন উন্নত দেশকেও মনে হয়েছে অপ্রস্তুত, হতভম্ব। ব্যতিক্রমও আছে, সিঙ্গাপুর। সার্সে ৩৩ জন মারা গিয়েছিল সে দেশে, সোয়াইন ফ্লু-তে আক্রান্ত হয়েছিল ৪ লক্ষ। এ বার কিন্তু কড়া পদক্ষেপ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যাটাকে এখনও পর্যন্ত দু’শোর নীচে রাখতে পেরেছে তারা।
‘কন্টেজন’ মুভিটিতে অসুখের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয় তাড়াতাড়ি। আমেরিকার ‘সেন্টার্স ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ জন্মতারিখের ভিত্তিতে লটারি করে দেওয়া শুরু করে এই প্রতিষেধক। যদিও পৃথিবী জুড়ে অজানা অসুখে তখন মারা গিয়েছে ২ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ, যার মধ্যে আমেরিকাতেই ২৫ লক্ষ। এমনটা কিন্তু সচরাচর হবে না। প্রতিষেধক চটজলদি বার না হওয়াটাই বাস্তব। ধরে নেওয়া যেতে পারে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি হতে বছরখানেক লাগবে।
করোনাভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা কী ভয়ানক রকমের অপ্রস্তুত এমন হঠাৎ অনিবার্য পরিস্থিতির সামনে। করোনাভাইরাস কতটা ক্ষতি করবে, তা বলা এখনও কঠিন। ভারতের জিডিপি-ই নাকি এর ফলে কমে যাবে ১%। কিন্তু সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো উন্নত করে না তুললে, এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হবে বারবার। করোনাভাইরাস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আসবে এক সময়। তবে তা অন্তত দিয়ে যাক অতি গুরুত্বপূর্ণ এক শিক্ষা, অনিবার্য সঙ্কটের জন্যে সব সময়েই প্রস্তুত থাকাই সভ্যতা।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা। মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy