প্রতীকী ছবি
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘চৈতন্য হোক’। কিন্তু এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসেও একটা প্রশ্ন প্রায়ই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, সত্যিই চৈতন্য হয়েছে কি আমাদের? না হলে এখনও কেন অন্ধ মানসিকতা থেকে আমরা কেউই বেরোতে পারছি না?
কেন বার বার করে বোঝানোর দরকার হয়ে পড়ে যে, আমরা মানুষ, কোনও বন্য প্রাণী নই? পথের খোঁজ না পেয়ে শুধুই ভুল পথের সন্ধানে ছুটে চলেছি ঘোরগ্রস্তের মতো।
আসলে, সমাজের ভিতরে পচন ধরে গিয়েছে অনেকদিন। রোগ দানা বেঁধেছে মনের গভীরে। ফলে, খুব সহজেই আমরা বিচার করে ফেলছি মানুষকে নিজের ভাবনার মাপে। অন্ধকার অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বর্তমানের সময়কে বিচার করছি। মানুষের বিচারও করে ফেলছি খুব দ্রুত। ধর্মান্ধতার যূপকাষ্ঠে বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ধর্মের অফিমে বুঁদ হয়ে আছে সম্প্রদায়গত ভিন্নতা তথা হানাহানি আর তাতেই মৃতপ্রায় শাশ্বত ভারতের মাটি। এই স্বাধীনতার জন্যই কি এত মানুষ শহিদ হয়েছিলেন? উত্তর নেই জানা। এক অজানার পথে এগিয়ে চলছে আমার দেশ। শ্রীরামকৃষ্ণের সেই চিরন্তন বাণী ‘যত মত, তত পথ’ আমাদের সত্যিই কিছু শেখাতে পারেনি?
এ বড়ই কঠিন সময়। অন্ধকার চারিদিক। ধর্মের আফিম যদি আধুনিক ভারতকে বুঁদ করে রাখে, তা হলে মৌলবাদ সর্বক্ষেত্রেই প্রভাবিত হবে আর এটাই স্বাভাবিক। হিংসা আর প্রতিহিংসা প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দেবে আমাদের, আমরা নিজেরাই কতটা অসহায়! পরবর্তী প্রজন্মের হাতে রেখে যাব শুধুই একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজ? ধর্মের দিশা আমরা চিনিনি। বেছে নিয়েছি বিশৃঙ্খলা। খুব কাম্য ছিল? উত্তর কিন্তু দিতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই। দায় শুধু মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দায় এড়ালে হবে না। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল বা তথাকথিত সাম্প্রদায়িক দল কেউ দায় এড়াতে পারে না। কারণ, জনমন প্রভাবিত করার ক্ষমতা তাদের হাতেই।
রবীন্দ্রনাথও ধর্মকে অবলম্বন করেছিলেন মানবমুক্তির উৎস এবং আধার হিসেবে। তাঁর মতে, ধর্ম মানেই মানবধর্ম। মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্যে মানুষ নয়। ধর্ম মানেই মনুষ্যত্ব। যাঁরা এই ধর্মের এই মূল কথা মানেন না, তাঁরা আর যাই হোক মনুষত্বের বোধ নিয়ে এই পৃথিবীতে জন্মাননি। ধর্মের ধর্ম মানুষের অনিষ্ট করা নয়। কিন্তু এখন সময়টাই অন্য রকম। সহজ কথা যায় না বোঝা সহজে! বোঝার মানসিকতা নিয়ে সবাই এখন আর মানসিক ভাবেই প্রস্তুত নন। এটাই দুঃখের!
যে কোনও মৌলবাদ সমাজ এবং সংস্কৃতিকে ধর্মীয় মোড়কে সব সময় ব্যাখ্যা করতে চায়। তার ফলে সমস্যার গতিপ্রকৃতি সব সময় হয়ে ওঠে একমুখী। বিস্তার লাভ করে মতের বিভিন্নতা আর বিদ্বেষ। আমরা বুঝেও তা বুঝতে চাই না। ভারতের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি দেখে এটাই বোঝা যায়, মৌলবাদ এবং ফ্যাসিজিম গণতান্ত্রিক মোড়কে মিলেমিশে এমন এক বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে, যার থেকে মুক্তির উপায় সহজে পাওয়া কঠিন। সাধারণ জনগণ এই ধরনের মৌলবাদী আচরণে তিতিবিরক্ত। সব ধর্মের মৌলবাদ যেন চেপে বসেছে আমাদের এই দেশে। একুশ শতকে আমরা দাবি করি আধুনিক ভারতের, অথচ মানসিকতার বিচারে এখনও আমরা অন্ধকারবিলাসী।
‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’র দিশা আমাদের অভিভাবকই দিয়েছেন। আমরা গ্রহণ করলাম না! আমরা বিশ্বাস করলাম না যে, ‘একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’!
কথাগুলি এখন শুধু নিছকই কথার কথায় রূপান্তরিত। বিদ্বেষ আর দ্বেষের কারণে দেশ আজ দিশাহীন। রাষ্ট্রের মূল সমস্যাগুলো এড়িয়ে গিয়ে শুধুই দ্বেষের রাজনীতি মানুষকে আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, ইতিহাসের প্রতিটা পর্ব কী ভাবে ফিরে ফিরে আসে। এই রাজনীতি দেশভাগ করেছে। আবারও এই রাজনীতি ভাঙার রাস্তায় হাঁটছে। আর তা যদি হয়, তা হলে শুধু ধর্মকে দোষ দিয়ে লাভ হবে না, মানবধর্মের মূল কথা ভালবাসা। তাকে বাদ দিয়ে সভ্যতা বাঁচে না।
একটা পক্ষ নেওয়ার সময় এসেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। কী চাই, সেটা স্পষ্ট করে বলার সময়। শিক্ষিত মননকে অশিক্ষিতের হাতে তুলে দেওয়া কোনওমতেই সম্ভব নয়। কারণ, তাতে নিজের মেরুদণ্ড বিক্রি করে দিতে হয়। সুস্থ মানুষের পক্ষে যা আত্মহত্যারই শামিল!
(লেখক শিলিগুড়ির বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy