করোনার দুর্ভোগ চলছিল। তার মধ্যে আমপানের দুর্যোগ রাজ্যটাকে প্রায় দুরমুশ করে দিয়ে গেল। ক্ষত যত গভীর হয়, সারতেও তত বেশি সময় লাগে। এ নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই। তবে চেষ্টায় গাফিলতি এবং পরিকল্পনায় ফাঁক থাকলে ক্ষত দ্রুত বিষিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্য বিবিধ দুর্বলতা তখন দেহযন্ত্রকে পীড়া দেয়। বলা চলে, ‘বহিঃশত্রুরা’ শরীরে মাথা তোলার সুযোগ খোঁজে।
করোনা ভাইরাস বিশ্বে নবাগত। আর ইতিহাস ঘেঁটে জানা গিয়েছে, আমপান-তুল্য ঝঞ্ঝা রাজ্যে তিনশো বছরের মধ্যে হয় নি। ফলে দুটিরই মোকাবিলায় একটা বড় চ্যালেঞ্জের দিক ছিল এবং আছে।
আমপানের বেলায় জরুরি ছিল আগাম তৈরি থাকা। সন্দেহ নেই, রাজ্য সরকার কয়েক লক্ষ মানুষকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে না নিলে বিশেষত গ্রাম বাংলায় জীবনহানি কয়েক গুণ বেশি হতে পারত। পাশাপাশি এটাও বলতে হবে, শহর কলকাতায় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস জানার পরে পরিস্থিতি আঁচ করে কোমর বাঁধার কিছু খামতি নিশ্চয় ছিল। সেই ফাঁকই নাগরিক-সমস্যা খানিক বাড়িয়ে দেয়।
তবে এর সব দায় একা সরকারের উপর চাপালে তা খণ্ডবিচার হবে। পুরসভা এবং কলকাতাবাসীদের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহকারী একমাত্র সংস্থা সিইএসসি-র বিবেচনাবোধও সঠিক সময়ে জাগ্রত হয়নি। নিজেদের কোমরের জোর সময় থাকতে তারা ঠিকমতো পরখ করে নেয়নি। সম্ভাব্য বিপদের সবরকম আশঙ্কা পর্যালোচনা করে তারা কেউ বুঝে নেয়নি, নিজেদের ক্ষমতায় কতটা করা যাবে বা ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আরও কী প্রস্তুতি চাই।
করলে হয়তো ভেঙে পড়া গাছ কেটে সরানো থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ ফেরানো সব কিছুই আর একটু সংহত ভাবে করা যেত। তাতে হয়তো সময়ও একটু কম লাগত। বিপর্যয়ের দু’দিন বাদে সেনাবাহিনীকে নামাতে হত না। সর্বোপরি, মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ নিয়ে এত জলঘোলার সুযোগ কমত!
এখন যদি এ সব কথাকে কেউ শাসকবর্গের নিন্দা বা লোক খেপানোর অপচেষ্টা বলে দাগিয়ে দিতে চান, সেটা দুর্ভাগ্যের হবে। কারণ এটা কোনও সমালোচনা বা দোষ চাপানোর বিষয় নয়। আবার বলছি, অভূতপূর্ব ওই সাইক্লোনের কবল থেকে মানুষকে যথাসম্ভব রক্ষা করার ব্যাপারে রাজ্যে শাসকের সদিচ্ছা ও সংবেদনশীলতা ছিল যথেষ্ট। তার ফল বোঝা গিয়েছে। নইলে পরিণতি আরও অনেক মর্মান্তিক হত।
কথা শুধু একটিই। যে কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে গেলে প্রস্তুতির বিভিন্ন পর্যায়ে সুবিবেচনা দরকার। চরম খারাপের কথা মাথায় রেখে কর্তব্য সাজানো তার অন্যতম। আমপান থেকে যদি সেই শিক্ষা নেওয়া হয়, তাতে ভবিষ্যতে কাজ আরও সহজ হবে। দক্ষতার মাত্রাও নিশ্চয় বাড়বে।
বিবেচনাবোধের অন্য এক পাঠ শেখাতে পারে করোনা-যুদ্ধ। তবে সেই শিক্ষা সবচেয়ে বেশি দরকার সাধারণ মানুষের। সেই সঙ্গে রাজনীতির কারবারিদেরও। আমাদের সকলের নিরাপদে বেঁচে থাকার জন্য যা জীবনদায়ী ওষুধের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
লকডাউন কাটিয়ে এবার খোলার পালা শুরু হয়েছে। আমাদের রাজ্য ইতিমধ্যেই সেই পথে পদক্ষেপ করেছে। লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি জনজীবন স্বাভাবিক করার এই প্রক্রিয়া স্ববিরোধী কিনা, তা নিয়ে নানা মত আছে। এটা ঠিক, রাজ্যে করোনা-পরিস্থিতি এখনও যেখানে দাঁড়িয়ে, তাতে আগল খুলে দেওয়ার কিছু ঝুঁকি অবশ্যই আছে। পথেঘাটে, বাসে-অটোয়, অফিস-কাছারিতে লোক সমাগম বাড়তে থাকলে রোগ সংক্রমণের কিছুটা আশঙ্কা থাকবে। পরিযায়ীদের নিয়ে ট্রেনগুলি ঢোকার পিছন পিছন কলকাতা-সহ জেলাগুলিতে সংক্রমণ বাড়ছে, সেটাও পরিষ্কার।
কিন্তু মাসের পর মাস সব কিছু স্তব্ধ হয়ে থাকার ফলে অর্থনীতিতে যে চাপ পড়ছে এবং সমাজজীবনে যে ভাবে বিষয়টি ছায়া ফেলছে, সেই দিকটিও আর উপেক্ষা করার নয়। সত্যি বলতে, রোগের শঙ্কার চেয়েও খেয়ে-পরে থাকার ন্যূনতম চাহিদাটুকু আজ অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে দেখা না হলে অন্য জটিলতা তৈরি হতে বাধ্য। তার মাশুলও কঠিন। শাসকের বিবেচনাবোধ এক্ষেত্রে সঠিক।
জানি, চিকিৎসা-বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই অভিমত হল, করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দু-চারমাসের গৃহবন্দিত্ব একটি কার্যকর উপায় ঠিকই। তবে শেষ কথা নয়। বরং নিজস্ব প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলে রোগ এবং আমরা ক্রমশ সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে উঠব। এটাই ভবিতব্য।
কিন্তু গৃহবন্দিত্বের মেয়াদ আরও দীর্ঘ করার অর্থ বেঁচে থাকাকে কার্যত মৃত্যুমুখী করে তোলা! কারণ রোজগার ছাড়া বাঁচার পথ নেই। তাই সংক্রমণের নিরিখে ‘খুব খারাপ’ বলে চিহ্নিত জায়গাগুলি ছাড়া অন্যত্র জীবন-জীবিকার পথ খুলে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী উচিত কাজই করেছেন বলে মনে করি।
তবে স্বাভাবিক জীবনছন্দে ফেরার ক্ষেত্রে আবশ্যক স্বাস্থ্যবিধিগুলি মানার অনেকটা দায়িত্ব আমাদেরও। এখানেই আসে বিবেচনাবোধের প্রশ্ন। যা খুব গুরুতর এবং যার দায়ভাগ আমার, আপনার, সবারই।
এমনিতেই শহরে জনস্বাস্থ্যের সাধারণ নিয়ম পালনে আমাদের অনীহা প্রকট। রাস্তাঘাটে থুথু-কফ ফেলা, গুটখার পিক দিয়ে চারপাশ ভরিয়ে দেওয়া, প্রকাশ্যে ধূমপান করে সেই ধোঁয়া অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি নানা অভ্যাসে আমরা রপ্ত। এগুলি দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও পুলিশ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই এ সব কাজ যে আইন ভাঙা, সেই চেতনাও অধিকাংশের মধ্যে গড়ে ওঠেনি।
এখন করোনা-পরিস্থিতির বেলাতেও করণীয়গুলি ভুলে গিয়ে বা পরোয়া না করে আমরা নিজেরাই যদি ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে ফেলি, তাহলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। সেই প্রবণতা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রাখা এ ক্ষেত্রে মানবিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। এবং অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ঘুরে-ফিরে সেই দায়ও সরকার বা প্রশাসনের উপরেই এসে পড়বে। যেমন, সরকার আমাকে মাস্ক না-পরে বেরোতে বলেছে, বা রাস্তায় কাশ-কফ ফেলতে বলেছে ইত্যাদি। এর পিছনে অবশ্যই আছে রাজনীতিও!
রাজ্যের বিজেপি ইতিমধ্যেই ভোটের অঙ্ক কষে সেই জমি তৈরির কাজটি শুরু করে দিয়েছে। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ যেমন কবুল করে থাকেন, ‘সেবা’র চেয়ে রাজনীতি করা তাঁদের এখন বেশি প্রয়োজন। তাই কেন্দ্রের পথে রাজ্য লকডাউন শিথিলের প্রক্রিয়া চালুর কথা বলতেই বাংলায় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা সামনে এনেছে তারা। জনসাধারণকে সতর্কতা-বিধি মানার জন্য সচেতন করার প্রশ্ন সেখানে গৌণ। আসলে এই সময়ে তাদের কৌশল— দু’দিকই খোলা রাখা। সংক্রমণ বাড়লে বলা যাবে রাজ্য সরকারের দায়। আবার লোকের রোজগারের পথ রুদ্ধ হয়ে থাকলেও দায়ী হবে সরকার!
ঠিক উল্টোমুখী রাজনীতি চলছে পরিযায়ী ট্রেন নিয়ে। বিজেপি-শাসিত কর্নাটক করোনা-জর্জরিত রাজ্যগুলি থেকে পরিযায়ী-ট্রেন ঢুকতে না দেওয়ার শর্ত আরোপ করেছে। কিন্তু বঙ্গ বিজেপি-র ভূমিকা এখানে ঠিক বিপরীত। হুড়হুড় করে ট্রেনগুলি না-পাঠানোর যে প্রস্তাব এই রাজ্য দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দিলীপ ঘোষেরা সরব হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সিপিএম, কংগ্রেসের মনোভাবও প্রায় একই।
তবে আশঙ্কার ছবি তো কারও হুকুমে বদলাবে না! ঘটনা হল, করোনা-অধ্যুষিত অন্যান্য রাজ্য থেকে ট্রেনে পরিযায়ীদের বিপুল স্রোত ক্রমাগত যে ভাবে বাংলায় ঢুকছে, সেটা আতঙ্কজনক।
বর্তমান কঠিন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এগুলি উদাহরণ মাত্র। আসল কথা হল, নেতা-কর্তা-সরকার-জনতা সকলেই যেন কোথাও একসূত্রে বাঁধা হয়ে গিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে বিবেচনাবোধ হারিয়ে যায় সবারই।
সেই বিবেচনাবোধের কাছে শুভবুদ্ধি শুধু একটা কামনাই জানাতে পারে, ‘তাড়াতাড়ি ফিরে এসো!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy