ছবি: সংগৃহীত
বাংলার লোক আঙ্গিকে এবং ধর্মীয় অনুষঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে আলপনা। কখনও ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করতে আবার কখনও বা শুধুই অলংকরণের উদ্দেশ্যেই আলপনা এঁকে চলেছেন গ্রাম বাংলার নারী এবং স্থান বিশেষে পুরুষরাও। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই কালস্রোতে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার এই প্রাচীন লোকশিল্প। চর্চার অভাবে কিংবা প্রয়োজনের অভাবে অথবা নগরায়নের করাল থাবা গ্রাস করছে এই লোকজ শিল্পমাধ্যমকে।
ধীরে ধীরে আলপনার স্থান দখল করে নিচ্ছে বাজার চলতি রেডিমেড স্টিকার। কিন্তু শিল্প কখনও এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। শিল্পী যতদিন আছেন শিল্প ততদিন তার হাত ধরেই বেঁচে থাকবে। বর্তমানে শান্তিনিকেতনে আলপনা শিল্পের কথা বললে সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়েপ মুখ ভাসে। শান্তিনিকেতনের বার্ষিক অনুষ্ঠান হোক বা সমাবর্তন, সুধীরঞ্জনবাবুর আলপনা ছাড়া কোন কিছুই সম্পূর্ণতা পায় না। সেই মানুষটিই শোনালেন শান্তিনিকেতনে আলপনার সূত্রপাত এবং ক্রমবিকাশের ইতিহাস।
১৯০০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে যখন ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হল তখন রবীন্দ্রনাথ যেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে, গাছপালার মাঝে শিক্ষাগ্রহণের সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন, ঠিক তেমনই এই আশ্রম বিদ্যালয়টির একটি চাক্ষুষ রূপের ধারণাও তৈরি করেছিলেন। কয়েকটি মাটির বাড়ি, প্রত্যেকটি বাড়ি সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে নিকানো এবং তার মাঝে সুদৃশ্য আলপনা- এমন একটি পরিবেশ যে তার আশ্রম বিদ্যালয়ের জন্য উৎকৃষ্ট, সে ধারণা গুরুদেবের ছিল। কিন্তু আলপনা আঁকার জন্য চাই উৎসব। ব্রাহ্ম মতের আদর্শে গড়ে তোলা বিদ্যালয়ে কোনও রকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তো হতে পারে না, তাই উৎসব হিসেবে উঠে এল প্রকৃতির উদযাপন। বর্ষামঙ্গল, হলকর্ষণ, বৃক্ষরোপন, শারদোৎসব, পৌষ উৎসব, বসন্ত উৎসবের মতো ঋতুকেন্দ্রিক উৎসবগুলিকে উদ্দেশ্য করেই শান্তিনিকেতনে উৎকর্ষতা পেল শিল্পের চর্চা। প্রতিটি উৎসবেই শান্তিনিকেতনে আলপনা দেওয়ার কাজ চলত। এছাড়া অতিথিদের অভ্যর্থনা এবং সাপ্তাহিক উপাসনার উদ্দেশ্যেও আলপনা দেওয়ার চল ছিল শান্তিনিকেতনে। ব্রহ্মবিদ্যালয়ে তখন অঙ্কনের শিক্ষক ছিলেন সন্তোষকুমার মিত্র। তিনিই প্রথম পড়ুয়াদের নিয়ে আশ্রম চত্বরে আলপনা দেওয়া শুরু করেন। এরপর ১৯১১ সালে শান্তিনিকেতনে শিল্পের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন প্রখ্যাত চিত্রকর অসিত হালদার। তবে এই সময়ের আলপনার ধরন বর্তমানের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। তৎকালীন আশ্রম বিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বৈদিক যজ্ঞ এবং আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে প্রগাঢ় পন্ডিত। তিনি এবং তার স্ত্রী কিরণবালাদেবী বৈদিক আলপনার অনুসরণেই আশ্রম বিদ্যালয়ে আলপনার ধরন নির্মাণ করেন।
এখন বিভিন্ন পূজার ক্ষেত্রে যে পঞ্চগুড়ির আলপনা তৈরি করা হয়, তেমনই পঞ্চগুড়ির আলপনা দেওয়া হত তৎকালীন আশ্রমে। এখনও বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানে এই পঞ্চগুড়ির আলপনা দেওয়ার চল রয়েছে শান্তিনিকেতনে। এরপর ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনে এলেন প্রখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু, তৈরি হল কলাভবন। তখনও এই প্রাচীন বৈদিক পদ্ধতিতে আলপনা দেওয়ার রীতি চালু রয়েছে। নন্দলাল আসার পরে পরেই এর বিশেষ পরিবর্তন হয়নি বরং তিনিও এই প্রচলিত পদ্ধতিতেই মেতে উঠলেন রঙের খেলায়। শান্তিনিকেতনের আগ্রহী পড়ুয়াদের আলপনা শেখানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ থেকে কালীমোহন ঘোষের এক বাল্যবিধবা আত্মীয়া সুকুমারীদেবীকে নিয়ে এলেন আশ্রমে। এই সময় সুকুমারীদেবী, চিত্রনিভা চৌধুরী, ইন্দুলেখা ঘোষ প্রমুখদের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে আলপনার চর্চা পুরোমাত্রায় চলতে থাকে। প্রাচীন ধর্মীয় ব্রত অনুষ্ঠানের যে আলপনার ধরন তাকেই শান্তিনিকেতনের আলপনা চর্চায় সংযুক্ত করলেন সুকুমারীদেবী। শুধু বাদ গেল লক্ষ্মীর পায়ের মতো প্রত্যক্ষ ধর্মীয় অনুষঙ্গগুলি। ছোট ছোট গ্রামীন আলপনাগুলিকেই শান্তিনিকেতনের বৃহৎ পরিসরে ব্যবহার করতে শুরু করলেন সুকুমারীদেবী। এই আলপনার সঙ্গেই এরপর যুক্ত হল নন্দলাল বসুর ব্যক্তিগত শিল্পবোধ। তার হাত ধরেই শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি, গাছপালা, ডাল, পাতা ইত্যাদি স্থান করে নিল অলঙ্করণমূলক আলপনায়। এতদিন পর্যন্ত পঞ্চগুড়ির ক্ষেত্রে রঙের ব্যবহার হলেও পরবর্তীতে শুধু সাদা রঙের উপরেই আলপনা আঁকা হচ্ছিল শান্তিনিকেতনে। সুকুমারীদেবী প্রাচীন পন্থা মেনে চালগুড়ির সাদা রঙ দিয়েই আলপনা আঁকতেন। কিন্তু শান্তিনিকেতনের আলপনায় প্রথম রঙের ব্যবহার করলেন নন্দলাল বসুর দুই কন্যা গৌরী ভঞ্জ এবং যমুনা সেন। সাদা রঙের জন্য তাঁরা ব্যবহার করলেন খড়ি মাটি, হলুদ রঙের জন্য এলা মাটি, লাল রঙের জন্য গিরি মাটি আর সবুজ রঙের জন্য টেরাভার্ট গ্রীন। তুলির ব্যবহার তখনও শুরু হয়নি। গৌরীদেবী ও যমুনাদেবীদের শান্তিনিকেতনের শেষদিকে ননী গোপাল ঘোষের সময়ে প্রথম ব্যবহার হল তুলি। বদলে গেল আলপনার প্রাচীন পদ্ধতি।
নন্দলাল বসু আলপনার যে নতুন আঙ্গিক শান্তিনিকেতনকে দিয়ে গিয়েছিলেন আজও শিল্পীরা তাকেই বহন করে চলেছেন। ১৯৭৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্পকলায় স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে জাতীয় বৃত্তি নিয়ে দু’বছরের জন্য প্রথমবার শান্তিনিকেতনে আসেন সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। এরপর ১৯৮৩ সালে উত্তরশিক্ষা সদনে শিল্পের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। তখন পাঠভবনের শিল্পের শিক্ষক ছিলেন নন্দলাল বসুর প্রত্যক্ষ ছাত্রী ক্ষমা ঘোষ। তাঁর সান্নিধ্যেই অঙ্কনের শিক্ষক সুধীরঞ্জনবাবু ভালবেসে ফেললেন শান্তিনিকেতনের আলপনার ঐতিহ্যকে। বিশেষ অনুষ্ঠান বা সমাবর্তন ছাড়াও বছরে চারটি দিনে শান্তিনিকেতনের উপাসনা মন্দিরে আলপনা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে এখনও। প্রথমটি চৈত্র মাসের শেষদিনে বর্ষশেষের আলপনা, দ্বিতীয়টি পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের আলপনা, তৃতীয়টি ২২ শ্রাবণের আলপনা এবং চতুর্থ ২৫ ডিসেম্বরের খৃষ্টোৎসবের আলপনা। এছাড়াও প্রতিবছরই পৌষ উৎসব উপলক্ষে আম্রকুঞ্জের জহর বেদি থেকে সামনের পুরো রাস্তাটিকেও আলপনায় ভরিয়ে তোলা হয়।
একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এক্ষেত্রে না দিলেই নয়, বর্ষশেষের আলপনা হয় সাদা রঙের। সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ওই রাতের মধ্যেই সেই সাদা আলপনা ভরিয়ে দেওয়া হয় রঙে, তাতেই সূচিত হয় বর্ষবরণের রঙিন অভ্যর্থনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নন্দলাল বসুর প্রকৃতি সম্পর্কিত নান্দনিকতাকে মূলধন করেই শান্তিনিকেতনের আলপনা এখনও বেঁচে রয়েছে তার নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব রূপে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে নানা পরিবর্তন এসেছে শান্তিনিকেতনের আলপনার রূপে, রঙে, আঙ্গিকে, প্রকাশে। কিন্তু কখনই তা মূল থেকে দূরগামী হয়নি।
বিশ্বভারতীর কলাভবন এবং সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা শান্তিনিকেতনের আলপনার অনন্যতাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন নিজস্ব ঢঙে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy