১৯৯১ সালের কথা। ১৯৮৯ সালে নির্বাচিত বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ সরকার, ও তার পর চন্দ্রশেখর সরকারের পতনের পর আবার লোকসভা নির্বাচন। দু’বছরের মধ্যে। সেই নির্বাচনে কিছু ছোট দলের সমর্থন নিয়ে সংখ্যালঘু কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসে। নতুন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়ে এলেন মনমোহন সিংহকে।
ভারতের অর্থব্যবস্থা তখন চরম সঙ্কটে। দু’বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থব্যবস্থার কোমর প্রায় ভেঙে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার প্রায় শূন্য, সাকুল্যে দু’সপ্তাহের আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি চরমে, রাজস্ব ঘাটতিও অত্যন্ত বেশি। ভারতকে বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতেও অস্বীকার করে। অবস্থা এমনই যে, ভারতকে সোনা বন্ধক রেখে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার থেকে ঋণ নিতে হয়েছিল। এই চরম সঙ্কট থেকে অর্থব্যবস্থাকে বাঁচাতে কঠিন সিদ্ধান্ত করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রপুঞ্জ স্থাপনের সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, “নেভার লেট আ গুড ক্রাইসিস গো টু ওয়েস্ট।” একটা ভাল সঙ্কটকে কখনও অপচয় করতে নেই। নরসিংহ রাও ও মনমোহন সিংহও সেই সঙ্কটকে নষ্ট করেননি। ১৯৯১ সালের আর্থিক উদারীকরণ ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেই ইতিহাসের রূপকার তাঁরা দু’জন।
আর্থিক উদারীকরণের প্রয়োজন কি অর্থনীতিবিদরা আগে অনুভব করেননি? নিশ্চয়ই করেছেন, কিন্তু কোনও সরকার সাহস করে তা করতে পারেনি। কারণ, বিভিন্ন শিল্প ও শিল্পগোষ্ঠীর লবি, কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ক্ষুদ্র কায়েমি স্বার্থ এবং সর্বোপরি কিছু রাজনৈতিক দলের উদারীকরণ ও বিশ্বায়ন নিয়ে আদর্শগত, ও কল্পনাশক্তির সীমাবদ্ধতাজনিত স্থবিরতা একে বাধা দিয়ে এসেছে। সেই রাজনৈতিক দলগুলি সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে এসেছে যে, উদারীকরণের ফলে তোমাদের সমস্যা ও সর্বনাশ হবে, তাই রাস্তায় নামো, প্রতিবাদ করো— যেন তেন প্রকারেণ এই সংস্কারকে আটকাতেই হবে। কোনও সরকারও এই ঝামেলা ঘাড়ে নিতে চায়নি। কী দরকার ঝামেলায় জড়িয়ে, যেমন চলছে চলুক— এই মনোভাব আমাদের দেশে, এই রাজ্যেও, এক বহু পুরনো রোগ। কিন্তু যখন চরম সঙ্কট এসে উপস্থিত হয়, তখন আমাদের আর কোনও উপায় থাকে না, বাধ্য হয়ে সেই পদক্ষেপ করতে হয়। সঙ্কট এই সুযোগই তৈরি করে দেয়। নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহ জুটি যে ভাবে সঙ্কটটিকে কাজে লাগিয়েছিলেন, তা এখন ইতিহাস।
তিন দশকের পুরনো কাসুন্দি টানছি কেন? কারণ, সুযোগ বুঝে সংস্কারের এমন মোক্ষম উদাহরণ দেশের ইতিহাসেই থাকা সত্ত্বেও অনেকেই প্রশ্ন করছেন— এখন কেন কৃষি আইন সংস্কার করা হল? এই করোনা আবহে যখন সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারতীয় অর্থব্যবস্থাও বিপর্যস্ত, জাতীয় আয় কমার সম্ভাবনা, সাধারণ মানুষের সমস্যা যথেষ্ট, তখন হঠাৎই এই সংস্কার-সিদ্ধান্ত কেন? শুধু কৃষি আইন নয়, শ্রম আইনেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এই দু’টি আইন আসলে ১৯৯১ সালের উদারীকরণের বৃত্তকে সম্পূর্ণ করে। এবং এখনই সেই সময়, যখন এগুলি করে ফেলা উচিত— আর বেশি সময় আমাদের হাতে নেই। কৃষি উদারীকরণ ও আধুনিকীকরণের যে প্রয়োজন আছে, সে নিয়ে অর্থনীতিবিদ মহলে খুব একটা দ্বিমত নেই। শুধু যাতে সব পক্ষের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে এবং তার জন্য আইনের যদি কোনও পরিবর্তন বা পরিমার্জন দরকার হয়, করতে হবে। একই কথা শ্রম আইন সম্বন্ধেও খাটে। প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই, শুধু শ্রমিক যাতে অকারণ শোষণের শিকার না হন, তাঁদের স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেটা দেখতে হবে।
বেসরকারিকরণ-সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই করেছে। সেগুলি নিয়ে বিতর্কের ঝড়ও উঠেছে। সেই বিতর্কের মধ্যে যে বিন্দুমাত্র অন্তঃসার নেই, তেমন দাবি করব না। আবার, উল্টো দিকে এই সমালোচনাও আছে যে, আরও কিছু দুঃসাহসিক পদক্ষেপ সরকারের করা উচিত, যার সাহস হয়তো এখনও তারা সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। যেমন, ধনী কৃষকদের আয়করের আওতায় নিয়ে আসা।
ভারতে কৃষি থেকে আয় আয়করের আওতার বাইরে। কারণ হিসেবে বলা হয় যে, দেশের কৃষকরা আমাদের অন্নদাতা, তাঁরা কেন আয়কর দেবেন? কিন্তু, সেই যুক্তিতে আরও অনেককে ছাড় দিতে হয়। চিকিৎসকরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের প্রাণ রক্ষা করেন, এই অতিমারির সময় আমাদের অনেক চিকিৎসক বন্ধু প্রাণ হারিয়েছেন, ওঁরা তবে কেন আয়কর দেবেন? সেনারা বিদেশি আগ্রাসন থেকে তো বটেই, বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য সঙ্কটেও আমাদের রক্ষা করে থাকেন; শিক্ষকরা পরবর্তী প্রজন্ম গড়েন; সাংবাদিকরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে সমাজের খবর আমাদের সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। এঁরা সবাই কিন্তু আয়কর দেন। ধনী কৃষকরা দেন না। দেশের মাত্র চার শতাংশ মানুষ আয়কর দেন। সিনেমা জগতের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও নিজেদের আয়ের বেশ কিছুটা কৃষি থেকে আসছে বলে দেখিয়ে আয়কর দেন না। কিন্তু এই নিয়ে খুব বেশি কথা এখনও কেউ বলেননি, কারণ বলার সাহস হয়নি। এই লবির ক্ষমতা সুদূরপ্রসারী। এই সংস্কার হয়তো ভবিষ্যতের কোনও সঙ্কটের অপেক্ষায় থাকবে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে যে, একটি বিষয়ে সরকার বিপথে চালিত হচ্ছে— বাণিজ্য উদারীকরণ। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র সঙ্গে যে বাণিজ্য উদারীকরণের কোনও দ্বন্দ্ব নেই, তা বুঝতে হবে। আর স্থানীয় শিল্পের উন্নয়ন, দক্ষতা ও উৎকর্ষের জন্য বিদেশি প্রতিযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। না হলে কূপমণ্ডূক হয়ে থাকার সমূহ সম্ভাবনা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ পানাগড়িয়ার মতে, এই অন্তর্মুখী বাণিজ্যনীতি ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হারকে ২ শতাংশ-বিন্দু পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে, যা কোনও অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না।
সমস্ত আইনের কিছু ইতিবাচক ও কিছু নেতিবাচক দিক থাকে। ইতিবাচক দিক যদি তুলনায় বেশি হয়, তা হলে সেই আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই বুঝতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেতিবাচক দিকগুলিকে কমিয়ে আনাই হল পরবর্তী পদক্ষেপ। এবং নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই দিকেই আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত।
কিন্তু, তার মানে এই নয় যে, বর্তমানে যে পদক্ষেপগুলি করা হয়েছে— যার মধ্যে কৃষির উদারীকরণ ও শ্রম আইনের সংশোধন উল্লেখযোগ্য— তার কোনও মূল্য নেই।
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy