আধুনিক নবকুমারদের মধ্যে স্ত্রীর প্রাণ বাঁচানোর থেকে প্রাণ কেড়ে নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘কপালকুণ্ডলা ... অন্তঃকরণ মধ্যে দৃষ্টি করিয়া দেখিলেন- তথায় ত নবকুমারকে দেখিতে পাইলেন না।’ অর্থাৎ সে যুগেও তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, সকল মেয়ে আপন অন্তরের মধ্যে স্বামীকে দেখতে পায় না। কিন্তু কপালকুণ্ডলা স্বামীর কোনও ক্ষতি করতে চায়নি। নিজের মৃত্যুর মাধ্যমে সে নিজের বিড়ম্বিত জীবনের ইতি টানতে চেয়েছিল। বর্তমানের মৃন্ময়ীরা অপছন্দের স্বামী হননেও পিছপা হচ্ছে না। অন্য দিকে, আধুনিক নবকুমারদের মধ্যে স্ত্রীর প্রাণ বাঁচানোর থেকে প্রাণ কেড়ে নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
কাগজ খুললেই এখন পরকীয়ার কারণে ঘটিত অপরাধের খবর চোখে পড়ে। নাগরিক সমাজে পরকীয়া এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এমন নয় যে এ নিয়ে আলাপ আলোচনা আড়ালে-আবডালে চলে না। কিন্তু সামনে অনেকেই ‘কিছুই জানি না’ গোছের ভান করে। নানা সমীক্ষায় প্রকাশ, ভারতের বিভিন্ন শহরের একটি বড় অংশের মানুষ পরকীয়ায় আসক্ত।
দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যখন কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তখন সেটা নিয়ে আলোচনা রুচিসম্মত নয়। কিন্তু পরকীয়া যখন হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের কারণ হয়ে ওঠে তখন সেটা নিয়ে বিচার, বিশ্লেষণ করা জরুরি হয়ে পড়ে বইকি। পরকীয়া প্রেমের কারণে ঘটিত অপরাধ কখনও মুহূর্তের উত্তেজনায় ঘটে। কখনও বা দীর্ঘ দিন ধরে পরিকল্পনা করে ঘটানো হয়। তার পরে মৃতদেহ গায়েব করে দিয়ে সুচতুর অভিনয়ের মাধ্যমে চলে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা।
ইউরোপ- আমেরিকাবাসীরা বিয়েকে একটি বিশেষ ধরনের চুক্তি বলে মনে করে। যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও পক্ষ সেই চুক্তিভঙ্গ করতে পারে, এটা মাথায় রেখেই তারা ঘর বাঁধে। তার মানে এই নয় যে, তারা ভালবাসে না। এ-ও নয় যে, সঙ্গী বা সঙ্গিনীর বিশ্বাসভঙ্গে তারা কষ্ট পায় না। কিন্তু ছোট থেকে তারা অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করতে শেখে। তাই কষ্ট হলেও সর্ম্পকের বিদায়কে তারা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মেনে নেয়। পাশ্চাত্য সমাজ ছোট থেকেই মানুষকে নিজের উপর নির্ভর করতে শেখায়। আত্মনির্ভরতার পাঠ পায় বলেই তারা জীবনের যে কোনও ওঠাপড়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।
বিশ্বায়নের যুগে পশ্চিমী সমাজের প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ছে। কিন্তু আমাদের সাবেক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা সন্তানদের স্বনির্ভর হতে শেখাই না। বরং সন্তানদের ছোট-বড় সব সমস্যা থেকে আগলে রাখতে চাই। এখনও বহু বাবা-মা সন্তানের কেরিয়ার, বিয়ে ইত্যাদি বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করেন।
অত্যধিক আদর যত্ন ও ঘেরাটোপের মাঝে থাকার ফলে বহু মানুষই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে অক্ষম। তাই জীবনে যখন সত্যিকারের সঙ্কট এসে উপস্থিত হয় তখন তারা দিশেহারা হয়ে হঠকারি হয়ে ওঠে।
ইউরোপীয়-আমেরিকান সমাজের কাউকে লোকলজ্জা বিষয়টি বোধহয় ঠিকঠাক বুঝিয়ে ওঠা যাবে না। কিন্তু ভারতীয় ছেলেমেয়েরা লোকের চোখে ভাল থাকার শিক্ষা পায় একদম ছোট থেকে। তাই ডিভোর্সের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে লোকের চোখে তারা হেয় হতে চায় না। অপরাধ বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, প্রত্যেক অপরাধী নিজেকে ভীষণ বুদ্ধিমান বলে মনে করে। ‘কেউ আমাকে ধরতে পারবে না’— এই বিশ্বাস থেকে সে অপরাধ করে। ‘কেউ বুঝতে পারবে না, সামাজিক অবস্থান সুরক্ষিত থাকবে’— এই ভাবনা থেকেও আসে অপরাধের ইচ্ছে। শুধু তাই নয়, সঙ্গী বা সঙ্গিনী ডিভোর্স নাও দিতে পারে এই ভাবনা থেকেও জাগে হত্যার সাধ।
ভারতীয় সমাজ রক্ষণশীল। একটা শিশুর মনে বিয়ের পবিত্রতা, দাম্পত্য সম্পর্কের বিশ্বাসরক্ষা, পারিবারিক দায়বদ্ধতা এ সব বিষয়গুলি অনেক ছোট থেকেই মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়। তাই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক তার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধের সৃষ্টি করে। বিদেশিরা একে অন্যায় বা পাপ মনে করে না। কিন্তু শৈশব থেকে যে শিশু একে পাপ বলে ভাবতে শিখেছে সে সহজে এর থেকে মুক্ত হতে পারে না। আর নিজের পাপবোধ থেকে বাঁচতে সে সব দায় চাপিয়ে দেয় সঙ্গী বা সঙ্গিনীর উপর। ‘এই মানুষটি না থাকলে আমার জীবনে এত ভয়ানক সমস্যা আসত না’— এই ভাবনা থেকে এক ধরণের অন্ধ ঘৃণা জন্ম নেয়। এক সময়ের ভালবাসা তখন বিদ্বেষে পরিণত হয়। রাগে, ঘৃণায় উন্মত্ত মানুষ তার অতি প্রিয়জনকে শুধু খুন করে না, বহুক্ষেত্রে বড় নৃশংস ভাবে খুন করে।
নাকি এর শিকড় আরও গভীরে? ছোট থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের চাপ, অভিভাবকদের প্রত্যাশার চাপ, যা নয় তা হওয়ার ভান করার চাপ, সর্বোপরি জীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বৃদ্ধির চাপ নিতে অক্ষম মানুষ মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছোট থেকে কেবল নিজেকে ভালবাসায় অভ্যস্ত মানুষও অন্যের অনুভূতি ও জীবনের মর্যাদা দিতে শেখে না। তাই জৈবিক চাহিদা পূরণ করা আর নিজের ইচ্ছে মতো বাঁচার তাগিদ তাকে নিষ্ঠুর হত্যাকারীতে পরিণত করে।
কারণ যাই হোক না কেন, এটা ঠিক যে, আমাদের সমাজ এখন এক সঙ্কটময় সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। সর্বক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। সামান্য কারণে গণপ্রহার ও গণপিটুনিতে মৃত্যুমিছিল চলছে। ত্যাগের আদর্শে বিশ্বাসী ভারতীয় সমাজের চারদিকে এখন মূল্যবোধের অবক্ষয়। ভোগবাদী মানুষ আর আত্মসংযমে রাজি নয়। জীবন সংগ্রাম যত তীব্র হচ্ছে, সমাজের প্রতি, অন্য মানুষের প্রতি রাগ, ঘৃণা, অবিশ্বাস ততই বাড়ছে।
জীবনসঙ্গী মুহূর্তে জঘন্য হননকারীতে পরিণত হচ্ছে। আর এ সব ঘটনা একটা, দুটো নয়, প্রায়শই ঘটছে। আর তাই জরুরি হয়ে পড়েছে একটি শিশুকে ছোট থেকেই নৈতিকতার শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া। প্রতিনিয়ত একটা শিশুকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। তাকে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বড় করতে হবে। তাকে সত্য থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, সত্যকে সহজ ভাবে স্বীকারের যোগ্য করে তুলতে হবে। অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করতে শেখাতে হবে। ‘সর্বোপরি জীবন যে মহা মূল্যবান, কোনও কিছুর জন্য নিজের বা অন্যের জীবন কেড়ে নিতে নেই’— এই বোধের বিকাশ সব স্তরের মানুষের মধ্যে ঘটাতে হবে। বিয়ে সংক্রান্ত নানা সমস্যা ও তার সমাধানের যথার্থ পদ্ধতিগুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে। তবেই সমাজ জীবনের এই সঙ্কট আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব।
প্রধান শিক্ষিকা, ডোমকল বালিকা বিদ্যাপীঠ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy