এটা ঠিক যে, ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটা বা ‘নাগরিক সমাজ’ তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অধঃপতনের ইতিহাস বেশ লম্বা। তার বহু কারণও আছে। জনগণের রাগ বা বিদ্বেষ সঙ্গত।
রাজনীতি বহুদিন আগে নীতি ছেড়ে শুরু করেছে ধারণা তৈরির প্রতিযোগিতা।
বুদ্ধিজীবীরা কোথায়? দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো। এই উক্তি ঘুরে-ফিরে উঠে এসেছে ২০০৭ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঘটে-যাওয়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে।
তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়। সারা পৃথিবী জুড়ে বহুবার নানা সময়ে সমাজে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা বুঝতে অসুবিধা হয়েছে কমবেশি সমস্ত শাসকের। তাই স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ হোক বা হিটলার অধিকৃত জার্মানি, মাওয়ের চিন বা সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর ভারতবর্ষে লেখক-কবি-সাংবাদিকদের গ্রেফতার বা হত্যা— বুদ্ধিজীবীরা বরাবর শিকার হয়েছেন যে কোনও শাসকের ক্ষমতার বীভৎসতার।
তবে এটা ঠিক যে, ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটা বা ‘নাগরিক সমাজ’ তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অধঃপতনের ইতিহাস বেশ লম্বা। তার বহু কারণও আছে। জনগণের রাগ বা বিদ্বেষ সঙ্গত। যদিও আমরা ‘জনগণ’ শব্দটি যে যার নিজের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করে নিতে অভ্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ১০ কোটি আর ভারতবর্ষের জনসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। কিন্তু আমরা কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে নেটমাধ্যমে ভেসে-আসা হাজার বা দু’হাজার ‘কমেন্ট’-কে ‘জনগণের ভাষা’ বলে আখ্যা দিয়ে দিই। ১৪০ কোটির দেশে বা ১০ কোটি মানুষের রাজ্যে চার হাজার ‘কমেন্ট’ বা কুড়ি হাজার ‘সারকাস্টিক’ বা রাগী ‘ইমোজি’ দিয়ে আমরা বিচার করার চেষ্টা করি জনমত। চেষ্টা করি বললে ভুল হবে, চেষ্টা করানো হয়।
রাজনীতি বহুদিন আগে নীতি ছেড়ে শুরু করেছে ধারণা তৈরির প্রতিযোগিতা। ইতিহাস, ভিন্ন মতাদর্শ, বিরোধিতা— সব মিথ্যে। সত্যি শুধু তাদের নিজেদের তৈরি করা ধারণাগুলো। যার বাইরের সত্যিটা তারা চিনতে শেখেনি। এই ধারণা তৈরির কাজকে ব্যবসায় পরিণত করেছে কিছু মিডিয়া হাউস, বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানির সাহায্যে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আবিষ্কারের পর সম্পূর্ণ বদলে গেল সেই ধারণা তৈরি করার জগৎ। ফ্যাশন ব্র্যান্ড থেকে ভোট— সবই এখন সোশ্যাল মিডিয়া বা নেটমাধ্যমের শরণাপন্ন। এখনকার পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিরে বা তেল নয়, যার হাতে সব পাবলিক ডাটা, সে-ই সিদ্ধমনোরথ। তাই এখন আমাদের মস্তিষ্ক-ধৈর্য-হাসি-কান্না-রাগের মার্কেট ভ্যালু নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা। এখন রাজনীতিবিদ আর সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে যোগসূত্র একটাই— তাদের ব্যবসার প্রধান পণ্য হিসেবে আমাদের দুর্বলতা। তাই সত্যটাকে আড়াল করে চালু হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আইটি সেল, যারা নিরপেক্ষতার চোখে ঠুলি পরিয়ে, ঘৃণা আর ভয় দিয়ে চালাচ্ছে তাদের ধারণা তৈরির চাকরি।
এই প্রেক্ষিতে একটা ঘটনা এই লেখায় বলতে চাই। কিছুদিন আগে আমরা কিছু মানুষ মিলে মুখ্যমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি চিঠি পাঠাই। বাংলায় ঘটে-যাওয়া সাম্প্রতিক কিছু হিংসার ঘটনার প্রসঙ্গে। সেই চিঠি পড়ে বিরোধীপক্ষের মুখ এবং অনুগামীরা ‘জনগণ’ সেজে বলার চেষ্টা করে গেলেন যে, এই চিঠির বয়ান অত্যন্ত সরল এবং সুকৌশলে আসলে মুখ্যমন্ত্রীকে তুষ্ট করার জন্য লেখা হয়েছে চিঠিটি। আবার শাসকদলের মদতপুষ্টরা বলতে শুরু করেছেন, এই চিঠির লেখকরা সিপিএম-বিজেপি’র নির্দেশে চিঠিটি লিখেছেন।
এটাই হল ক্ষমতা বা রাজনীতির আসল চেহারা। মতে মিললে চিরসখা অন্যথায় ফাঁসি! ভিন্ন আদর্শ থাকলেও এই একটি জায়গায় সব শাসকের চেহারা এক। কারণ, মানবসভ্যতা প্রগতিশীল হলেও এখনও বৈজ্ঞানিক কারণে মানুষ তাদের মৌলিক প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাই বদলায় না যুদ্ধের চেহারা। বদলায় না ভিন্ন মতকে স্থান না দেওয়ার মনন। এই স্বভাব কবে বদলাবে জানি না। তবে এটা জানি যে, চলতে থাকবে স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে ধ্বংস করার চেষ্টা।
মূল বক্তব্যে ফেরা যাক। জনগণ না হলেও আমাদের সমাজের এক অংশের মানুষের কাছে বুদ্ধিজীবীদের ওপর আস্থা হারানোর যথেষ্ট কারণ আছে। লেখার শুরুতে যেমন বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতার কাছে আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেছি, তেমনই উল্টো উদাহরণেরও অভাব নেই। বিশ্বজুড়ে তো বটেই, আমাদের দেশে আর বিশেষত আমাদের রাজ্যে এই বিপরীত উদাহরণ সাংঘাতিক ভাবে বিরাজমান। বহু লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালক ক্ষমতার কাছাকাছি থাকবেন বলে বছরের পর বছর চোখে ঠুলি পরে তাঁদের কাজের মাধ্যমে আউড়ে যান শাসকের বুলি। জোসেফ গোয়েবলসের দর্শনে পুষ্ট চলচ্চিত্র কমিটি বা কিম জং ইলের জমানার ‘প্রোপাগান্ডা সিনেমা’ বা হলিউডের র্যাম্বো বা এখন ভারতে দাঁড়িয়ে অতি জাতীয়দাবাদী কিছু সিনেমা বানিয়ে ১০০ কোটির ক্লাবে ঢোকা কিছু পরিচালক, যাঁদের দায়িত্ব হল এই মুহূর্তে তেলের দাম লিটারপ্রতি প্রায় ১২০ টাকা বা এই বছরের বাজেটের পৈশাচিক থাবা থেকে জনসাধারণের নজর ঘুরিয়ে এনে তাদের উদ্বুদ্ধ করে জিজ্ঞাসা করা ‘হাউ ইজ দ্য জোশ?’
আর আমাদের রাজ্যে ২০১১ সাল থেকে শিল্পীমহলে চলতে থাকা অন্তহীন রংবদল। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় বহু বুদ্ধিজীবী বা শিল্পী, যাঁরা নিজেদের ‘আমরা নিরপেক্ষ’ বলে নাগরিক সমাজের মুখ হয়ে ওঠার ভান করেছিলেন, তাঁরা রাজ্যে পতাকা বদলাতে না বদলাতেই শামিল হয়ে পড়লেন ক্ষমতা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার লড়াইয়ে। এখন বহু স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী বা শিল্পী বর্তমান সরকারের বিরাট বিরাট পদে নিযুক্ত এবং এই বদল ঘটেছে বিদ্যুৎগতিতে! কবিতা লিখে, নাটক করে, সিনেমা করে তাঁরা শুধু জনগণের কাছে পৌঁছতে চান না। বা তাঁরা আদৌ জনগণের কাছে পৌঁছতেই চান না।
ক্ষমতার কাছে থাকা এক অদ্ভুত নেশার মতো। লালবাতি লাগানো গাড়িতে বসে নিজেকে রুপোলি পর্দার জাদুকরের মতো মনে হওয়া। তার পর বিভিন্ন কমিটিতে কারা থাকবে কারা থাকবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। একদিকে সিগন্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর অন্য দিকে হলুদ পাঞ্জাবি আর নীল সানগ্লাসে মজে ‘ওহ্ লাভলি’। এছাড়া নাট্যজগতে যাঁরা সরকার-ঘনিষ্ঠ তাঁদের সরকারি মঞ্চে অভিনয়ের জন্য আগে ‘ডেট’ দেওয়া বা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের কমিটিতে যোগ দেওয়া। চলচ্চিত্র সম্পর্কে শিক্ষা না থাকলেও থাকতে হবে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা বা কোন মন্ত্রীর ‘পয়েন্ট অফ ভিউ শট’-এ থাকা। তা হলে হাতে উঠে আসতে পারে পরের বার সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রী বা সব থেকে পছন্দের ‘অসহায় বাবা’ বা ‘বউকে জব্দ করার জন্য রান্নায় ইচ্ছাকৃত ভাবে বেশি নুন মিশিয়ে দেওয়া’ সেরা পিসিমার পুরস্কার। অথবা শিল্পী হয়েও নিজের কাজ না করে শিল্পপতিদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা।
সব দিব্যি চলছিল। ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে যখন গেরুয়া পতাকার রং হঠাৎ বাড়তে শুরু করল বাংলায়, তখন শিল্পীসমাজের এক বিরাট অংশ আবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করল। আর বাংলায় শুরু হল এক নতুন সার্কাস। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল অবধি রোজ বাংলায় চলল রংবদলের দোল উৎসব। শুরু হল সদস্য কেনাবেচার চৈত্র সেল। কারও জন্য ৫০ শতাংশ ছাড়। কারও জন্য ৭৫ শতাংশ আবার কেউ কেউ প্রায় বিনামূল্যে! কারণ সর্বভারতীয় ক্ষমতার কাছে থাকতে পারাটাই যথেষ্ট।
তাই ভোটের ঠিক আগে আগেই গুরুগম্ভীর মুখ করে চ্যানেলের পর্দায় কিছু বিশিষ্টজনের হঠাৎ মনে পড়তে থাকল বর্তমান রাজ্য সরকারের ‘কুকীর্তির কথা’। যা বিগত দশ বছরে তাঁদের চোখে পড়েনি। কারণ, তখন তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে গলা মেলাতে। কিন্তু হঠাৎ তাঁদের খেয়াল হল, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ বলার থেকে ‘টেগোর’ বললে অনেক বেশি লাভ এবং হিন্দি টানে বাংলা ভাষা অনেক বেশি বিক্রয়যোগ্য।
তাই কেউ কেউ সপরিবারে যোগ দিলেন গেরুয়া শিবিরে। কেউ সিবিআই থেকে বাঁচার জন্য। কারও আবার একই পরিবারের এক সদস্য গেলেন গেরুয়া ছাতার নিচে আর অন্যজন গেলেন সবুজ টিকিট কুড়োতে। অন্যদিকে ২০১৬ থেকে এক রাজনৈতিক দল তাদের এক সময়ের সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে হাত মেলাল। যারা এক সময় একে অপরকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে! যারা নাকি ছিল শ্রেণিশত্রু!
২০২১-এর নির্বাচনী ফলাফলের পর সবুজ থেকে গেরুয়া শিবিরে যাওয়া বহু সদস্য নির্লজ্জের মতো আবার ফিরে এলেন সবুজ ছাতার তলায়। তার থেকেও লজ্জাজনক ভাবে তাঁদের আবার স্বমহিমায় গ্রহণ করে নেওয়া হল পার্টিতে। এই সব কিছুই ঘটল প্রকাশ্যে। শিরোনামে। দিনের আলোয়।
তাতে একটি জিনিস প্রমাণ হল— প্রতিটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকা বা আসার জন্যে নির্ভর করে থাকে আদর্শ ছাড়া বাকি সব কিছুর উপর।
কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যে একটা অংশ, যেটা খুব ছোট হলেও চেষ্টা করছে নিজেদের ভাষায় প্রতিবাদ করার। কোনও রাজনৈতিক রং ছাড়াই। কিন্তু মানবস্বভাব আমাদের ছোটবেলা থেকে ব্যক্তিসত্তা চিনতে শেখায়নি। শিখিয়েছে শুধু পাশের জনকে অনুকরণ করতে। তাই আমাদের সমাজ এখনও মানসিক স্বাস্থ্যের বিজ্ঞানকে মর্যাদা দিতে পারেনি। মগজেরও যে জ্বর বা সর্দি হতে পারে এবং শারীরিক সুস্থতার প্রায় সবটাই যে মগজের ঠিক বা বেঠিক থাকার ওপর নির্ভরশীল, সেটা বুঝতে আমরা এখনও বহু দশক পিছিয়ে। তাই একজন মানুষ যে আরেকজনের থেকে বহু অংশে পৃথক, সেটা আমরা চিহ্নিত করতে শিখিনি। তাই স্বতন্ত্র প্রতিবাদের ভাবনাটি বহু শিক্ষিত মানুষের কাছেও বোধগম্য হয় না।
এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মুখেরাও কেউই ‘হিউম্যান নেচারের’ বাইরে নন। তাই যে-ই প্রতিবাদের ভাষা কোনও রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় না বেজে স্বতন্ত্র সুরে বাজছে, তখনই তাকে ‘প্রতিবাদ’-এর আখ্যা দিতে নারাজ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলি।
আমরা এক ভয়ানক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যখন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধান্দাবাজি বলে। এটি একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা। ধারণা-ব্যবসার সাহায্যে যদি একবার প্রমাণ করে দেওয়া যায় যে, স্বতন্ত্রতার থেকে ক্ষতিকারক আর কিছু নেই, তা হলে রাজনৈতিক দলগুলির পৌষমাস। জনগণকে যদি নিজেদের রক্তাক্ত ইতিহাস ভোলাতে হয়, তা হলে তাদের দরকার একটি ওষুধ। মানুষকে ভুলিয়ে রাখার ওষুধ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন রকমের ওষুধ। কারও ওষুধ অর্থ, কারও ধর্ম, কারও উৎসব, কারও লন্ডনের উদাহরণ দিয়ে উন্নয়নের ভাবনা। আবার কারও ‘বুদ্ধিজীবী কোথায়’ অভিযান।
মূল সমস্যাগুলো থেকে মানুষের মুখ ঘুরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার কিছু উদাহরণ এগুলি। কে কী ভাষায় প্রতিবাদ করবেন বা সেই প্রতিবাদের ভাষা মিছিলের মাধ্যমে হবে, না গানের মাধ্যমে, নাকি হাতে মোমবাতি থাকবে না কলম— তা নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলির চোখরাঙানি নিতান্তই হাস্যকর। নিজেদের মতে এবং নিজেদের ভাষায় প্রতিবাদ করার অধিকার সকলের আছে এবং সেটা কোনও অপরাধ নয়।
বেশ মজাই লাগে, যখন দেখি প্রায় সব রাজনৈতিক দল এবং তাদের অনুগামীরা পশ্চিমবঙ্গের ১৫ থেকে ২০ জন ব্যক্তিকে বলেন সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে।
এই কথাটি যুক্তিহীন হওয়ার তিনটি কারণ আছে। ১) গণতান্ত্রিক দেশে কে কী ভাবে প্রতিবাদ জানাবেন বা কোন কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে জানাবেন, সেটা একান্তই মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। ২) রাজনৈতিক দলগুলির দাবি, যে মাত্র ১৫ থেকে ২০ জনের কথায় বাংলার মানুষ সম্মোহিত হয়েছেন বারংবার। এখানেই আসে ‘জনগণ’ শব্দটি সম্পর্কে ভুল ধারণা। ১০ কোটির রাজ্যে শুধু কলকাতাবাসী ১৫-২০ জনের বলা কিছু কথা শুনে যদি গোটা রাজ্যবাসী একবারে মত পাল্টে ভোট দিতে যান, তা হলে বলতে হয় যে সব রাজনৈতিক দলগুলি ব্যর্থ! সেক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয়ই ভিনগ্রহ থেকে আসা অতিমানব। ৩) সব থেকে বড় প্রশ্ন হল— রাজনৈতিক দলগুলি জনসাধারণের কাছে কতবার ক্ষমা চেয়েছে? আজ অবধি নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, লালগড়, নেতাইয়ে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনাগুলির জন্যে দায়ী রাজনৈতিক দলটি ক্ষমা চেয়েছে? সারদা বা নারদার জন্য বা অগণিত ভোটের প্রচারের সময়ে বা ভোট পরবর্তীকালীন হিংসা ও হত্যার জন্যে বা সীমাহীন দুর্নীতির জন্যে দায়ী রাজনৈতিক দলটি ক্ষমা চেয়েছে? বাবরি মসজিদ ধ্বংস বা গুজরাটের দাঙ্গা বা নৃশংস ‘মব লিঞ্চিং’ হাথরস বা লখিমপুর খেড়ির জন্য দায়ী রাজনৈতিক দলটি ক্ষমা চেয়েছে? না! তারা শুধু ব্যস্ত ভোটের প্রচারে, টেলিভিশন চ্যানেলে বা আইটি সেলের মাধ্যমে একে অপরের উপর দায় চাপিয়ে হত্যা এবং মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করতে। আমার আমলে মরেছে ৬০০ কিন্তু অমুকের আমলে মরেছে ১০০০। এই ‘কিন্তু’-র ভিড়ে হারিয়ে যায় ক্ষমা চাওয়াটা। একটা সহজ ক্ষমা চাওয়া, যা আমাদের বাকি জীবজগৎ থেকে আলাদা করে।
তাই বুদ্ধিজীবী কোথায় খোঁজার আগে খোঁজা দরকার রাজনৈতিক দলগুলির মানবিকতা। রাজনৈতিক দলগুলির স্বতন্ত্র স্বরকে হত্যা করার অভিযান সহজ করে দেন কিছু স্বার্থপ্রেমী এবং ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকতে চাওয়া মেরুদন্ডহীন নাগরিক, যাঁরা কখনও নিজেদের ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটির সাজে ঢেকে লুকিয়ে বসেছিলেন গিরগিটি হয়ে। কিন্তু তাঁরা কেউই কোনও রাজনৈতিক দলের একচেটিয়া হতে পারবেন না। কারণ, তাঁদের লক্ষ কোনও রাজনৈতিক দর্শন নয়। তাঁদের লক্ষ ভাল থাকা। তাই বিভিন্ন ‘সময়ের’ ক্যানভাসে তাঁদের রংমিলন্তি চলতেই থাকবে।
এই লেখাটি কোনও ব্যাখ্যা বা অজুহাত নয়। এই লেখাটি শুধু নিছক মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যে, এই ধারণা তৈরি করার ব্যবসার ভিড়ে সত্যিটা চিহ্নিত করা খুব কঠিন। তাই এই কোলাহল আর প্রাচুর্যের সমাজে কখনও একা হওয়াটা জরুরি। একা হওয়াটা কখনও দুর্বলতা নয়। বরং কখনও কখনও সবচেয়ে জোরের জায়গা। রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ে যায়— ‘সারাদিন শুধু বাহিরে ঘুরে ঘুরে কারে চাহি রে, সন্ধ্যাবেলার আরতি হয়নি আমার শেখা। নিভৃত প্রাণের দেবতা, যেখানে জাগেন একা। ভক্ত সেথায় খোলো দ্বার— আজ লব তাঁর দেখা।’
(লেখক জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা। মতামত নিজস্ব)
গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy