মেঠো পথে মার্সিডিজ! জার্মানি থেকে জাহাজে এল স্টোয়া অভিজাত পরিবার। আভিজাত্যের সঙ্গে মানানসই গাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন জমিদারবাবু। কিন্তু বদলি গাড়ির আভিজাত্য এখন কম নয়। যে গাড়ির দর ওঠে দু’কোটি টাকা। লিখলেন আরুণি মুখোপাধ্যায়
বয়সের নিরিখে সেঞ্চুরি করেছে গাড়িটি। কিন্তু স্বাস্থ্যবান, সতেজ। ইঞ্জিন চালুর হাতলে সামান্য চাপ দিলেই কানে আসে জার্মান কলকব্জা শিল্পীদের শতাব্দী প্রাচীন যন্ত্র-লহরী। এই মুহূর্তে বিশ্বে স্টোয়ার সি-ওয়ান মডেলের গাড়ি সাকুল্যে তিনটি। সেগুলির মধ্যেই একটি ভারতে। অবস্থান আরও স্পষ্ট করলে কলকাতার মানিকতলার এক পারিবারিক গ্যারাজে। যদিও ঐতিহাসিক গাড়ি এবং গাড়ির মালিকের শিকড় মেদিনীপুরের মাটিতে।
গাড়িটির বর্তমান মালিক আনন্দ চৌধুরী। এখন তাঁরা মানিকতলার বাসিন্দা। একসময়ে তাঁরা মেদিনীপুরবাসী ছিলেন। প্রপিতামহ ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত মেদিনীপুরের মলিঘাটি গ্রামের জমিদার। তাঁদের চালু করা মলিঘাটির হাট আজও সচল। ঈশ্বরচন্দ্র শৌখিন মানুষ ছিলেন। তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল মার্সিডিজ বেন্জ। ১৯০৮-০৯ সাল নাগাদ ঈশ্বরচন্দ্র জার্মানি গিয়েছিলেন। সেখানে মার্সিডিজের শো’রুমে যান। কিন্তু মেদিনীপুরের রাস্তাঘাট খারাপ। অতি-শৌখিন মার্সিডিজের মেদিনীপুরের মেঠো রাস্তার চলা অসম্ভব। ঈশ্বরচন্দ্র চলে যান স্টোয়ার কোম্পানির শো-রুমে। মেদিনীপুরের রাস্তায় অবস্থার কথা বিশদে জানিয়েছিলেন সংস্থার কর্তাদের। তাঁরাই তাঁকে ‘কাস্টম-বিল্ড’ গাড়ির কেনার পরামর্শ দেন। রোড-রোলার বা ভারী পণ্যবাহী গাড়ি তৈরির ব্যাপারে সুনাম ছিল সংস্থাটির।
গাড়িটি কেনার প্রায় চার বছর পর সেটি হাতে পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। প্রতিটি যন্ত্রাংশ আলাদা করে কাঠের বাক্সে সাজিয়ে জাহাজে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। সঙ্গে এসেছিলেন দু’জন জার্মান ইঞ্জিনিয়ারও। তাঁরা টুকরো যন্ত্রাংশ জুড়ে পুরো গাড়ির রূপ দেন। আনন্দ গত বছর গাড়ি কেনার রসিদ খুঁজে পেয়েছেন। গাড়িটির দাম ছিল ৩২৫০ টাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্টোয়ারের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৩ সাল নাগাদ কলকাতায় আগমন। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত নিয়মিত চলত গাড়িটি। কিন্তু সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাড়ির যন্ত্রাংশও অমিল হয়ে যায়। ফলে বসে যায় গাড়িটি। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মলিঘাটিতে চৌধুরী বাড়ির গ্যারাজেই পড়েছিল গাড়িটি। ফের গাড়িটিকে মেরামত করা হয়।
গাড়িটির বয়স ১১০-এরও বেশি। এখনও এত চালু রয়েছে কীভাবে? আনন্দের জবাব, ‘‘গাড়িটি আমার কাছে সন্তানের মতো। দীর্ঘদিন না চললে বা শীতকালে চাকাগুলো জ্যাক দিয়ে তুলে রাখতে হয়। গাড়ি নিয়মিত না চললে চাকার হাওয়া ধীরে ধীরে কমে, এক সময় ফেটে যায়। এডিভি (অ্যানিম্যাল ড্রন ভেহিক্যাল) বা একসময় পশু টানা গাড়িতে যে চাকা ব্যবহার করা হত, তা-ই লাগানো রয়েছে এই গাড়িতে। কিন্তু এখন এডিভি’র চাকা সহজে পাওয়া যায় না। তবে অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি যে, সপ্তাহের দু’টো দিনও যদি দেওয়া যায় তাহলে গাড়ির স্বাস্থ্য নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।’’ সংস্থা উঠে গিয়েছে। কোনও যন্ত্রাংশ খারাপ হয়ে গেলে লেদ কারখানায় বানিয়ে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। সমস্যার কথা বলছিলেন আনন্দ, ‘‘গাড়ির যে যন্ত্রাংশের দর এক টাকা হওয়া উচিত, সেটা লেদ কারখানায় বানিয়ে নিতে খরচ হয় প্রায় ৫০ টাকা। পার্থক্য শুধু ওইটুকুই।’’ কলকাতায় আগে ভিন্টেজ গাড়ির সংখ্যা কম ছিল না। কিন্তু সংখ্যাটা এখন কমে গিয়েছে।
আনন্দের কথায়, ‘‘আমি নিয়মিত বিভিন্ন পুরনো গাড়ির রালিতে অংশ নিই। আগে কত রকমের গাড়ি দেখতে পেতাম। আবার রাজস্থানের জয়পুর কিংবা ভারতের আরও বেশ কিছু জায়গায় চিত্রটা অন্য।’’ এর কারণও রয়েছে। তিনি জানালেন, কলকাতা থেকে অনেক পুরনো গাড়িই খুব কম দামে কিনে নিয়ে যান এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। সেগুলি মেরামত করে চড়া দরে বিক্রি করা হয়।
কেউ কলকাতা থেকে ৫০-৬০ হাজার টাকায় পুরনো গাড়ি কিনে আরও দেড় বা দু’লক্ষ টাকা খরচ করে সেটি চালু অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। তার পর সেটি আট বা দশ লক্ষ টাকায় বিক্রি করা হয়। আনন্দের আক্ষেপ ‘‘কলকাতার নতুন প্রজন্ম ভিনটেজ গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে নিজস্বী তুলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু সেই গাড়িটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ তাঁদের খুব একটা দেখতে পাই না।’’ তাঁর অভিজ্ঞতা বলছে, নতুন প্রজন্মের তুলনায় পঞ্চাশোর্ধ্বরাই গাড়ির ব্যাপারে বেশি কৌতূহলী।
স্টোয়ার এখনও রাস্তায় বেরোয়। মাসে দু’বার কলকাতার বাইপাস ধরে গাড়িটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন আনন্দ। কলকাতার বাইরেও বিভিন্ন কার র্যালিতেও অংশ নেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কন্টেনারে ভরে ট্রাকে করে গাড়িটি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একবার দিল্লির একটি ভিন্টেজ কার র্যালিতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর পরিবার বিমানে দিল্লি পৌঁছন। আর গাড়িটিকে পাঠানো হয়েছিল ট্রাকে, সড়কপথে। সমস্যা হয়েছিল ফেরার সময়। গাড়িবাহী ট্রাকটিকে ধানবাদের কাছে আটকে দিয়েছিল পুলিশ। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে গাড়ি করে ধানবাদ পৌঁছেছিলেন আনন্দ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখালে, তবেই ছাড়া পেয়েছিল তাঁর সাধের স্টোয়ার।
স্টোয়ার সি-ওয়ান ছাড়াও আনন্দ আরেকটি গাড়ির মালিক। একটি শেভ্রলে বেলেয়ার। একসময়ে এই গাড়ির মালিক ছিলেন কিশোর কুমার। গাড়িটি আকারে বড় হওয়ায়, সেটি কলকাতায় রাখতে পারেননি। সেটি থাকে মেদিনীপুরের বাড়িতেই। মেদিনীপুরে গেলে প্রায়ই সেটি নিয়ে জাতীয় সড়ক ধরে বেড়িয়ে পড়েন। ঘুরে আসেন বালেশ্বর বা ভুবনেশ্বর। সকাল আটটায় বেরিয়ে ভুবনেশ্বর পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া করে, সন্ধ্যের মধ্যে বাড়ি। এই ধরনের গাড়ি নিয়ে বেরলে সঙ্গে কিছু যন্ত্রপাতি রাখতে হয়। যাতে কিছু হঠাৎ বিগড়ে গেলে সারিয়ে নেওয়া যায়।
তবে ‘ভিনটেজ কার’এর মালিক হওয়ার ঝক্কিও রয়েছে। ১৯৯৯ সালের কথা। স্টোয়ার সি-ওয়ান ১৯১৩ মডেলের কাস্টম-মেড গাড়িটি কিনতে চেয়েছিলেন জনৈক ব্যক্তি। সে জন্য নগদে দু’কোটি টাকা দিতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু কড়জোড়ে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আনন্দ চৌধুরী। কেন?
আনন্দের কথায়, ‘‘গাড়িটি আমার পরিবারের ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে। তাই ওটা বিক্রি করা কিংবা হাতছাড়া করার প্রশ্নই আসে না। কেউ যদি আমার কাছে গাড়িটি বিক্রির বিষয়ে কথা বলতে আসেন, সাফ বলে দিই গাড়িটি বিক্রির প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে কথা বলার থাকলে কথা বাড়াতে রাজি রয়েছি।’’
স্টোয়ার ঐতিহাসিক, তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য। স্টোয়ার বুড়ো কলকব্জাতেও ভেলকি দেখায়। এখনও মাইলেজ দেয় ১৩ থেকে ১৫ কিলোমিটার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy