Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

পেরিয়ে গিয়েছে ৭৪ বছর, বেঁচে আছে ৬ অগস্টের অমানবিকতা

‘লিটল বয়’ নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে। ভারতের স্বাধীনতার প্রয়াসেও ছাপ পড়েছিল তার। হিরোশিমা দিবসে লিখছেন জয়দেব সাহা‘লিটল বয়’। ইতিহাসবিদরা বইয়ের পাতায় তাই লিখেছেন। কিন্তু জাপানের হিরোশিমা শহরের মানুষেরাই একমাত্র জানেন এবং উপলব্ধি করেন যে, সেটা আর যাই হোক ‘লিটল’ ছিল না। চুয়াত্তরটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে।

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৯ ০৪:১০
Share: Save:

মেয়েটা প্রতিদিন সন্ধ্যায় পার্কে অপেক্ষা করত তার প্রেমিকের জন্য। অফিস থেকে ফেরার পথে ছেলেটি আসত দেখা করতে। কিন্তু দিনটা ছিল ৬ অগস্ট, ১৯৪৫। প্রথমবার ছেলেটি আসেনি। পরে আর কোনও দিনও আসেনি। সেদিন যে মেয়েটির বয়স ছিল ১৭, সে আজ ৯১ বছরের বৃদ্ধা। এই ৭৪ বছরে অনেকবার তাঁর মনে হয়েছে, ছেলেটি হয়তো আসবে। কিন্তু তা ঘটেনি। ছেলেটির মা-বাবাও স্বপ্ন দেখেছিলেন ছেলেকে বড় ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। ছেলেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

‘লিটল বয়’। ইতিহাসবিদরা বইয়ের পাতায় তাই লিখেছেন। কিন্তু জাপানের হিরোশিমা শহরের মানুষেরাই একমাত্র জানেন এবং উপলব্ধি করেন যে, সেটা আর যাই হোক ‘লিটল’ ছিল না। চুয়াত্তরটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কত স্মৃতি মুছে গিয়ে নতুন করে কত স্মৃতির জন্মও নিয়েছে। কিন্তু কান পাতলে আজও ঐতিহাসিক কান্না শুনতে পান জাপানের মানুষ। একটা জ্বলজ্যান্ত শহর সেদিন কবরে পরিণত হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে ৮০ হাজার মানুষ মৃতদেহ হয়ে গিয়েছিল! সংখ্যাটা কয়েক দিনের মধ্যে দেড় লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল! সেই শহরও আজ নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। সময় হয়তো অনেকটাই ব্যথা হালকা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই কলঙ্কিত দিনের আতঙ্ক ঘোচেনি।

সেদিনের সেই ঘটনা কি শুধু জাপানকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল? কিছু মানুষ বলেন, সেই পারমাণবিক বিস্ফোরণ নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি টেনে এলেছিল। বাইরে থেকে দেখলে হয়তো তাই মনে হয়। কিন্তু সেই ঘটনা বিশ্বকে অন্য এক যুদ্ধের দৌড়ে ঠেলে দিয়েছিল। পরমাণু অস্ত্রের প্রতিষোগিতা!

চুয়াত্তর বছর আগে অগস্টের দু’টো দিন, ৬ আর ৯ তারিখ ভারতকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র বসু তখন সেনাবাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়েছেন ভারতে। অসমের পথ দিয়ে আইএনএ তখন এগোচ্ছে। এরপরই উত্তরবঙ্গের রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়তে পারতেন পশ্চিমবঙ্গে। তারপর ইতিহাস তৈরি হত। কিন্তু ‘লিটল বয়’ সব শেষ করে দিল। জাপানকে বিধ্বস্ত করে দিল। নিজেদের দেশকে সামাল দিতে জাপানি সেনা ফিরে গেল। আইএনএ দুর্বল হয়ে পড়ল। ‘লিটল বয়’ সেদিন ভারতের ভবিষ্যৎকেও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল।

এ সব অবশ্য বিতর্কের বিষয়। কিন্তু যেটা ভাবায়, তা হল আচমকা একটি শহরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া! জ্বলজ্যান্ত গোটা শহর! চারদিকে কান্নার আওয়াজও ছিল না। কারণ, কান্নার জন্য জীবন্ত মানুষের থাকাটা দরকার। কেউই নেই তখন। মৃতদেহগুলো কতদিন পড়ে ছিল, কে জানে! সেই ছেলেটির দেহও হয়তো শুয়ে শুয়ে ভাবছিল মেয়েটির কথা। মাধরাস্তায় নির্ভয়েই শুয়ে ছিল সে! কারণ, আর কোন গাড়ি চাপা পড়ার ভয় নেই! তার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অপেক্ষা করছিল তার প্রেমিকাও। চেয়ারে বসে। চেয়ারটার একদিক এখন ভেঙে পড়েছে। তবু মেয়েটি বসেই আছে। রাত্রিদিন, দুপুর-সন্ধ্যা, রৌদ্র-বৃষ্টি— কোনও কিছুই এই অপেক্ষার সামনে বড় হয়ে উঠতে পারল না! ঝলসে যাওয়া শরীরটা কেবল অপেক্ষা চেনে! কোনও একজনের বোন অন্য কোনও শহরে অপেক্ষায় ছিল। এই সপ্তাহে দাদা অফিসে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরবে আর তার জন্য উপহার নিয়ে আসবে। সেই অপেক্ষাটাও আর শেষ হয়নি। উপহার ছাড়াও যদি দাদা সেদিন ফিরে আসত, তা হলেও বাচ্চা বোনটা খুশি হত। কিন্তু দাদা আর কোনও দিন ফেরেনি। কত দাদার, কত বোনের মৃতদেহই বাড়ি ফেরেনি সেদিন!

হিরোশিমা আবার বেঁচে উঠেছে। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। সময় ওই দুই শহরকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। আজ এতগুলো বছর পর খুব কম প্রত্যক্ষদর্শীই বেঁচে আছেন। যাঁরা আছেন, তাঁরাও আর কয়েক বছর পর থাকবেন না। শুধু স্মৃতিগুলো থেকে যাবে ভয়ঙ্কর স্মৃতির মতো! আতঙ্ক হয়ে! হিরোশিমা আর নাগাসাকির মৃত মানুষজনের স্মৃতিতে তৈরি স্মারকগুলো থেকে যাবে! না, তারাও সেই ধ্বংস দেখেনি। তারা তৈরি হয়েছে অনেক পরে। কিন্তু ধ্বংসের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে তারা বেঁচে আছে আর বাঁচতে বলছে প্রতিনিয়ত। গোটা বিশ্বকে শান্তির বার্তা দিচ্ছে তারা। যুদ্ধের নয়, ধ্বংসের নয়, অবিমিশ্র শান্তির বার্তা। আর কোনও হিরোশিমা-নাগাসাকি না ডেকে আনার বার্তা।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Atomic bombings Hiroshima Nagasaki
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy