Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Editorial news

আজি যত ঘুড়ি তব আকাশে

সাদাবাপির ঘুড়ির সে সব গল্প ক্ষুধিত পাষাণের মতো থমকে আছে স্মৃতির রাজপ্রাসাদ হয়ে।সাদাবাপির ঘুড়ির সে সব গল্প ক্ষুধিত পাষাণের মতো থমকে আছে স্মৃতির রাজপ্রাসাদ হয়ে।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৬:৩৫
Share: Save:

এটা একটা ঘুড়ির গল্প!

কিন্তু ঘুড়ি তো আসলে মানুষের জীবনের মতোই। আমাদের কত শত স্বপ্নের ইচ্ছে, রূপকথার আকাঙ্ক্ষা, রঙিন ফানুসের মতো উড়তে থাকে আকাশে। সুমন চ্যাটুজ্জের পেটকাটি চাঁদিয়াল, মোমবাতি বগগা! কখনও তারা ওড়ে, কখনও হারিয়ে যায় অন্য পাড়ায়, কখনও লটকে যায় গাছের ডালে কিংবা বিদ্যুতের তারে! সময়ের দুই হাতে ধরা থাকে নির্লিপ্ত লাটাই। নিয়তি চুপিসাড়ে কখনও সুতো ছাড়ে, কখনও সুতো গুটোয়। এমনি করে কখন কে জানে, কাউকে কিচ্ছুটি না বলে, গোত্তা খেতে খেতে, লাট খেতে খেতে, ঘুড়ি কেটে যায়, হারিয়ে যায়! ‘তার ছিঁড়ে গেছে কবে’! ভোকাট্টা!

এই তো জীবন ঘুড়ির, মানুষেরও। সেই সব ঘুড়ির ইয়া লম্বা ল্যাজ ধরে আমাদের পাড়ার সাদাবাপি চলে আসে, চলে আসে এপার-ওপারের ছাদ, লাল ফিতেয় বাঁধা দুই বিনুনি করা চুল দুলিয়ে মঞ্জুদি আসে, প্রেম আসে, আসে বিচ্ছেদও। আর আসে ঝাঁকে ঝাঁকে স্মৃতি! আসে ঠিক তেমনই করে, যেমন করে সাদাবাপি আসতো আমাদের বাড়িতে, ফি বছর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। এসেই সে হনহনিয়ে ছাদে উঠে যেত রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্যারডি গাইতে গাইতে, ‘আজি যত ঘুড়ি তব আকাশে’। আমাদের আকাশে তখন যত রাজ্যের ঘুড়িদের ঘোরাঘুরি! এ বাড়ি ও বাড়ির ছাদ থেকে সাদাবাপিকে দেখে আচ্ছা আচ্ছা ঘুড়িয়ালদের পিলে চমকে যেত।

অথচ দেখতে সে গোবেচারাটি, রোগাটি, ঢ্যাঙাটি! তবে হ্যাঁ, তপ্তকাঞ্চন গৌরাঙ্গ সে, ‘সাদাবাপি’ নামের কারণ সেটাই। খোকাখুকু থেকে বাহাত্তুরে বুড়ো, সবাই তারে ওই নামেই ডাকতো! কি যে তার পোশাকি নাম, সে যে কবে কোন স্কুলে কোন ক্লাস ইস্তক পড়েছে, কত যে তার ভবলীলার বয়স, কেউ তা জানতো না। পাড়ার মোড়ে মধুদার চায়ের দোকানে ছিল সাদাবাপির ঠেক। বাঁ হাতে চায়ের গ্লাস, ডান হাতে জ্বলন্ত বিড়ি। এ সব অবশ্য ফ্রি, পাড়ার সবাই জানতো, সাদাবাপির কাছে পয়সা চাওয়াটা সামাজিক অপরাধ। আর এ সবের বিনিময়ে কল সেন্টারের মতো সার্ভিস দিত সাদাবাপি। হাসপাতাল, থানা, শ্মশান, অনুষ্ঠানবাড়ি, বাড়িওলা-ভাড়াটে বিবাদ! ডাক পড়ত সাদাবাপির।

সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে অবশ্য এ সব বাদ, সাদাবাপি ভ্যাকেশনে। ঘুড়ির সিজন তো! সাদাবাপির আসলে রক্তে ঘুড়ি। একদা ঘুড়ি ওড়ানোতে ওর বাবার ছিল শহরজোড়া যশ, ওনার নামই ছিল ঘুড়িবাবু! ওদের বাপ-বেটার জীবনালম্বনেই বোধ হয় ‘দি কাইট রানার’ লিখেছেন খালেদ হোসেইনি! ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়ায় পেটেন্ট ছিল সাদাবাপির। হামানদিস্তায় কাচ গুঁড়ো করে, তাতে জল আর গদের আঠা মিশিয়ে সে এক হায়ার কেমিস্ট্রি! রাস্তার পাশের দুই সমান্তরাল বিদ্যুতের খুঁটিতে সুতো পেঁচিয়ে সাদাবাপি যখন মাঞ্জা দিত, পাড়া-বেপাড়ার লোক সেটা দেখতে আসত। এমনকি, নিখুঁত অ্যারোডিনামিক্সে নিজের বানানো ঘুড়ি নিজে ওড়াত সাদাবাপি। আর নিজের তৈরি নকশা ধরিয়ে দিয়ে ছুতোরকে সামনে বসিয়ে সাদাবাপি স্পেশ্যাল কিছু লাটাই বানিয়েছিল।

আরও পড়ুন: ‘কাজের ভাষা’ নয়, ‘ঐক্যের ভাষা’ হতে চেয়েই বিপদ বাধিয়েছে হিন্দি

এখন প্রশ্ন, এমন ঘুড়িবাজ সাদাবাপি কেন হঠাৎ কাগুজে উড়োজাহাজের উৎক্ষেপণ কেন্দ্র হিসেবে আমাদের ছাদটাই বেছে নিত? কারণটা অবশ্যই মঞ্জুদি। আমার দিদির বান্ধবী, আমাদের পাশের বাড়ি। মঞ্জুদির বড়দার সঙ্গে আবার সাদাবাপির ঘোরতর ঘুড়ির লড়াই ছিল। তা নিজেদের বাড়ির ছাদে বড়দার ঘুড়ি ওড়ানো ছেড়ে মঞ্জুদিই বা কেন আমাদের বাড়িতে আসত? আসত, কারণ ঘুড়িটা উদ্দেশ্য নয়, তার লক্ষ্য সাদাবাপি। বস্তুত, সাদাবাপির ‘খতম অভিযান’ শুরু হত মঞ্জুদির বড়দার ঘুড়ি কেটেই। আর নিজের বড়দার সেই ঘুড়িচ্ছেদের লগ্নে, এক রোমান্টিক উল্লাসে মঞ্জুদি চেঁচিয়ে উঠত, ভোকাট্টা। আমি তখন দশম শ্রেণি, সবে পাকতে শুরু করেছি। বেশ বুঝতাম, সাদাবাপি আর মঞ্জুদির মধ্যে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’! মঞ্জুদির গলায় ওই ভোকাট্টা শুনে সাদাবাপির মন ঘুড়ি হয়ে উড়ে যেত এক রাজকন্যের দেশে! ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে সাদাবাপি গপ্পো জুড়তো, ‘‘বুঝলি, আমার গুরু হল বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন! পাগলাটা ঘুড়িতে চাবি বেঁধে কেমন বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছিল বল!’’ আমি জানতাম, আসল ঘটনাটা তা নয়! ওই মার্কিন সাহেব শুধু এটাই প্রমাণ করেছিলেন যে, বিজ্ঞানের ‘বিদ্যুৎ’ আর আকাশের ‘বজ্রবিদ্যুৎ’ এক ও অভিন্ন। কিন্তু বলব কি, তার আগেই ফের মঞ্জুদির চিৎকার, ভোকাট্টা!

এ ভাবেই সাদাবাপির ঘুড়ি সব সময় তুড়ি মেরে জিততো। তবে সে বার হয়েছিল কি, ‘আমাদের ছাদ’-এর কাছে পরাজিত কোনও ঘুড়িসৈনিক এক মাঝরাতের অন্ধকারে মধুদার চায়ের দোকানের বাইরের দেওয়ালে রঙিন চক দিয়ে লিখে দিয়েছিল, ‘সাদাবাপি+মঞ্জু’! সে বেচারা বুঝতে পারেনি যে, কিছু কিছু সুতো ছিঁড়ে যাওয়া ঘুড়ি আজীবন আটকে থাকে কোনও অধরা উচ্চতায়, না ওড়ে, না ধরা দেয়! বুঝতে পারেনি হয়তো সাদাবাপিও। ঘুড়ির বাইরে ওই একটি স্বপ্নই সে দেখেছিল, সেটা ওই মঞ্জু-রিত প্রেম! কিন্তু ঘুড়ি আর নারী তো এক নয়, প্রথমটা রোমান্স, পরেরটা রিয়েলিটি। পরের দিন সাতসকালে ওই ‘সাদাবাপি+মঞ্জু’ আমাদের পাড়ার সমাজচিত্রটা আমূল বদলে দিয়েছিল। শুরু হয়ে গিয়েছিল কেচ্ছা কানাকানি। মধুদা তড়িঘড়ি জল দিয়ে মুছে দিয়েছিল বটে সেই দেওয়াল লিখন, কিন্তু তত ক্ষণে সেটা পাড়ায় পাড়ায় ‘দিল্লি থেকে প্রচারিত বাংলা সংবাদ’ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে! আর ঠিক তখন, আমি নিশ্চিত, নিজ নিজ বাড়ির রুদ্ধদ্বারে মঞ্জুদি আর সাদাবাপি একলাটি বসে মন মনে বলেছিল, ওটা তো সত্যি। ওটা তুমি মুছলে কেন মধুদা! ‘হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে’!

আরও পড়ুন: আসানসোলের সাহিত্যচর্চার অন্যতম কেন্দ্রে ছিলেন তিনি

কিন্তু সমাজে তো সেটা ‘বদনাম’! পারিবারিক আদালতে একটি বখাটে ছেলেকে ভালবাসার অপরাধে মঞ্জুদির বিচার হয়ে গেল। শাস্তি, মঞ্জুদির আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ, ‘অনার কিলিং’। সাদাবাপিকে আর মধুদার দোকানে দেখা গেল না, এমনকি পাড়ার কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো হারিয়ে গেল ছেলেটা। পাড়ার বড়দের কাছে পরে শুনেছি, সে দিন সকালে বেপাত্তা হওয়ার আগে সাদাবাপি আমাদের মধুদাকে বলে গিয়েছিল, ‘ঘুড়ি ওড়ানো ছেড়ে দিলাম গো দাদা’!

এর পর, মাঘের শুরুতেই বিয়ে হয়ে গেলো মঞ্জুদির। আমরা ছোটরা, যারা পাড়ায় সাদাবাপির চ্যালা ছিলাম, তারা কেউ যাইনি বিয়েবাড়িতে। বিয়ের পর দিন, আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম, শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার গাড়িতে ওঠার সময়, মঞ্জুদি অপলক চেয়েছিল মধুদার চায়ের দোকানের দিকে। কাউকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল ওর দুই চোখ, ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’! কয়েক মাস বাদে, বিশ্বকর্মা পুজো যখন দোরগোড়ায়, তখন মঞ্জুদি একটা চিঠি লিখেছিল আমার দিদিকে: ‘সে যদি আসে এ বার তোদের বাড়ির ছাদে, তাকে বলিস, ‘ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া!’ সে আসেনি। মঞ্জুদি না থাকলে সে আসবেই বা কেন!

গল্প শেষ। এটা একটা ঘুড়ির গল্প! কিন্তু ওই যে, শরতের হাওয়ায় ভেসে যে ঘুড়িগুলো প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায়, শুকনো ফুলের মতো গোত্তা খেতে খেতে লাট খেতে খেতে লুটিয়ে পড়ে, যে ভোকাট্টা ঘুড়িগুলো মড়া চাঁদের মতো লটকে থাকে গাছের ডালে বা বিদ্যুতের তারে, সেই ঘুড়িগুলোর প্রতিটির পিছনে এক অথবা একাধিক গল্প থাকে। অনেক দিনের পর, সে বার বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আমাদের ছাদের সিঁড়িঘরটা খুলে দেখেছিলাম, সেই সব গল্প সেথায় ক্ষুধিত পাষাণের মতো থমকে আছে স্মৃতির রাজপ্রাসাদ হয়ে। সাদাবাপির হাতে তৈরি ঘুড়িগুলোতে ধুলো জমেছে, লাটাই জুড়ে জাল বুনছে মাকড়সা। ‘মুকুটটা তো পড়ে আছে, রাজাই শুধু নেই...’!

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

অন্য বিষয়গুলি:

Vishwakarma Puja Kite
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy