একযোগে: পুজোর দিন আনন্দ চলে এভাবেই। নিজস্ব চিত্র
পঞ্জিকা-পণ্ডিতদের মতভেদ। সরস্বতী পুজো পড়েছে দু’দিন। বুধবার আর বৃহস্পতিবার। তাতে বেশ খুশি ঝাড়গ্রাম শহরের পড়ুয়ারা। তারা অবশ্যই পুং পড়ুয়া। সেই খুশিতেই একজন ফেসবুকে লিখে ফেলেছেন মনের কথা। পড়ুয়াটি যা লিখেছে তার সারমর্ম, কুমুদকুমারীতে সরস্বতী পুজো বুধবার হচ্ছে বটে। কিন্তু আসল পুজো তো আজ, বৃহস্পতিবার। কারণ কালই যে বিনোদমঞ্জরী স্কুলে সরস্বতী পুজো হবে। ঝাড়গ্রাম শহরের কুদুমকুমারী ইনস্টিউশন ছেলেদের স্কুল। আর রানি বিনোদমঞ্জরী রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয় মেয়েদের।
সকাল আটটা থেকেই মেদিনীপুর শহরের রাস্তা যেন ‘হলুদ বনের কলুদ ফুল’। দলে দলে ছেলে মেয়েরা বেরিয়ে পড়েছে। যাত্রা স্কুলের দিকে। সকাল সকাল পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তার পর একটু ঘোরাফেরা। বেরনোর আগে হলুদ মেখে স্নান। অনভ্যস্ত শাড়িতে দল বেঁধে হেঁটে যাওয়া। পথে দেখা গিয়েছে আরেক দলকেও। যাদের অনেকেই পাঞ্জাবি শোভিত। কেউ কেউ নতুন কেতার টি-শার্ট বা শার্টে।
একই দৃশ্য পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি শহরেরও। একটা বাইকে তিনজন বন্ধু নিয়ে হু হু করে উড়ে চলা। রাস্তায় তিন চার মেয়ের ছোট ছোট দল। কেউ কেউ স্কুটিতে।
সরস্বতী পুজো কমবয়সিদের পুজো। অনেক ক্লাবে, বাড়িতে পুজো হয় বটে। কিন্তু ছাত্রাবস্থায় মূল আকর্ষণ থাকে স্কুলের পুজোতেই। তাই সকাল সকাল স্কুলের পানে হেঁটে যাওয়া। কিন্তু বর্তমানে স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা বদল এসেছে। বেড়েছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা। এর ফলে কি চিরাচরিত সরস্বতী পুজোর ছবির কিছুটা বদল হচ্ছে? সেই বিষয়েই খোঁজ নেওয়া হচ্ছিল বিভিন্ন জেলায়। তিন জেলা থেকে হতাশার কোনও ছবি মেলেনি। একটা কারণ সম্ভবত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতেও সরস্বতী পুজোর আয়োজন। মেদিনীপুর শহর, ঝাড়গ্রাম বা পূর্ব মেদিনীপুরের পুরসভা এলাকা, সব জায়গাতেই একই ছবি। সরস্বতী পুজো মানেই ঝলমলে মুখগুলোর আরও বেশি উদ্ভাসিত হওয়া।
বর্তমানে গ্রাম ও শহরের পার্থক্য অনেকটাই ঘুচেছে। তবে অবিভক্ত মেদিনীপুরে শহর ও গ্রামের ছবির পার্থক্য এখনও কিছুটা হলেও রয়েছে। সেখানে কি কমললোচনের কমল কিছুটা মুদিত? খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে।
এতদিনে সরস্বতী পুজো সম্পর্কে দু’টো বিষয় প্রতিষ্ঠিত। এক, এই পুজো উপলক্ষেই প্রথম বড় হওয়ার ছাড়পত্র পায় ছাত্র-ছাত্রীরা। নবম শ্রেণির ছেলে-মেয়েরা স্কুলের পুজোর দায়িত্ব পায়। আর দুই, বাঙালির প্রেম-পুজো হল সরস্বতী পুজো। দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা নিরর্থক। লেখার শুরুতেই তার হাতেগরম প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু প্রথম বিষয়টির ক্ষেত্রে কিছুটা সংশয় তৈরি হচ্ছে। সে কথাই বলছিলেন নছিপুর আদিবাসী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বপন পড়িয়া। এই স্কুলটি কেশিয়াড়ি ব্লকের। বেশ নামী স্কুল। পরিকাঠামোও যথেষ্ট ভাল। প্রধান শিক্ষকের মত, আগে সরস্বতী পুজোয় পড়ুয়াদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকত। পুজোর জন্য তারাই মিটিং ডাকত। তারাই ক্লাসে ক্লাসে চাঁদা তুলত। কিন্তু এখন ততটা অংশগ্রহণ থাকে না। পড়ুয়ারা স্কুলের পুজোর আয়োজন করে। তবে একা নয়। শিক্ষকদেরও আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে যোগ করা হয়। সবটা তাদের হাতে ছাড়া হয় না। প্রধান শিক্ষকের মত, সময়ের সঙ্গেই এই পরিবর্তন করা হয়েছে।
ঝাড়গ্রামের দহিজুড়ি মহাত্মা বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক মৃন্ময় হোতার অবশ্য মত, সরস্বতী পুজো এখনও পড়ুয়াদেরই রয়েছে। তারা অপেক্ষা করে এইদিনটির জন্য। এই দিনটা সত্যিই তাদের কাছে বড় হওয়ার দিন। প্রধান শিক্ষক জানালেন, তাঁদের স্কুলে এখনও ছাত্র ছাত্রীরাই সব কিছুর আয়োজনে থাকে। দু’একজন শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকেন। শিক্ষিকা হয়তো মেয়েদের নিয়ে ফল কাটার ব্যবস্থা করলেন। আর শিক্ষক ছাত্রদের নিয়ে বাজার করতে গেলেন। মৃন্ময়বাবু জানিয়েছেন, সরস্বতী পুজোর সময়ে পড়ুয়াদের পড়ার বাইরে মূল্যায়নের সুযোগ মেলে। কেউ জঙ্গল থেকে গাছের ডাল কেটে এনে মণ্ডপ সাজায়। কেউ কারুকাজ করে। এতে একদিকে যেমন কোনও ছাত্রের নান্দনিক মনের পরিচয় মেলে অন্যদিকে একসঙ্গে কাজ করার দক্ষতার দিকটিও যাচাই করে নেওয়া যায় বলে মত দহিজুড়ির স্কুলের প্রধান শিক্ষকের। সরস্বতী পুজোর আয়োজন পুরোটাই পড়ুয়াদের কমিটি সমাধা করে বলে জানালেন তিনি। আর চাঁদা তোলার বিষয়টি নিয়ে তাঁর মত, এখন জানুয়ারি মাস থেকেই তো শিক্ষাবর্ষের শুরু। তাই নতুন ক্লাসে ভর্তির সময়ে স্কুল থেকেই সরস্বতী পুজোর জন্য চাঁদা নেওয়া হয়। পুজো তো জানুয়ারিতে হয়।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি সরস্বতী পুজোর জৌলুস কিছুমাত্র কমাতে পারেনি বলে জানিয়েছেন মৃন্ময় হোতা। তাঁর মতে, প্রান্তিক জেলায় এখনও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা ব্যাপক ভাবে বাড়েনি। জেলা শহরে হাতেগোনা দু’তিনটি স্কুল হয়েছে। অন্য জেলার বড় শহর বা রাজধানী কলকাতার সঙ্গে তার কোনও তুলনা চলে না বলে জানালেন মৃন্ময়। তিনি মনে করিয়ে দিলেন সাম্প্রতিক একটি খবর। কলকাতায় পড়ুয়ার অভাবে দেড়শোর বেশি স্কুল বন্ধ হতে চলেছে। এইরকম পরিস্থিতি কিন্তু এখনও পর্যন্ত জেলা শহরে বা গ্রামে তৈরি হয়নি। জানালেন মৃন্ময় হোতা।
সম্প্রীতি মিশ্র খড়্গপুর কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তিনি বাংলা মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়া। কিন্তু তাঁর তুতো ভাইবোনেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। সম্প্রীতি জানিয়েছেন, ভাইবোনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, ওদের স্কুলে সরস্বতী পুজোর তেমন কোনও উচ্ছ্বাস নেই। তিনি স্কুলে পড়ার সময়ে দেখেছেন, কোনও একটা শ্রেণিকক্ষে আলপনা দিয়ে এঁকে, রঙিন শিকলি বা থার্মোকল কেটে সাজিয়ে পুজো করা হত। সেই সাজানো ব্যাপারটা ভাইবোনদের স্কুলে নেই। নেই অন্য কোনও দিনে ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থা। সম্প্রীতির কলেজে যদিও বেশ ভিড় হয় পুজোর দিনে। চিরাচরিত পুজোই দৃশ্যই দেখা যায় সেখানে।
সরস্বতী পুজোয় অন্য ছবির সন্ধান দিলেন সম্প্রীতি। তাতেও কিন্তু চেনা ছবিটা এতটুকু মলিন হয় না। মলিন হয় বরুণদেবের বাঁকা দৃষ্টিতে। এবার সরস্বতী পুজোয় সকালে এবং দুপুরে বৃষ্টি হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। তাতে রাস্তায় ভিড়টা পাতলা
হয়েছে। কিন্তু অন্য অবুঝ আনন্দ বা বিপাক বাড়িয়েছে। এখন পুজোর সময়ে বাইকের বাড়বাড়ন্ত। অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে ভাসা কিছু পাঞ্জাবি পরিহিত রাস্তার জমা জলের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে দিচ্ছে। নোংরা জল ছিটকে নতুন শাড়িতে। অস্বস্তিকর পরিবেশ। বড়রা বলছেন, বাড়াবাড়িতে সৌন্দর্যহানি হয়। ‘হলুদ বনের কলুদ ফুল’ অসুন্দর কাজে মলিন হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy