Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Rabindranath Tagore

এ পঁচিশে বৈশাখ উৎসব থেকে অনুভবে ফেরার

এ বছর বহির্জগতের কোনও তাড়া, পারফর্ম্যান্সের কোনও চাপ থাকবে না বলে, প্রকৃত রবীন্দ্র অনুরাগী কবির সাধনায় মগ্ন হতে পারবেন। যাঁর হৃদয়েতে পথ কেটে রাখা আছে, হৃষ্ট কবির চরণ সেখানে পড়বেই। বাইরের আড়ম্বরে কি প্রয়োজন!কবির জন্মদিন প্রথম বার পালিত হয়েছিল তাঁর ২৬ বছর বয়সে, ১৮৮৭ সালে।

শর্মিষ্ঠা দাস
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২০ ২৩:২৯
Share: Save:

আদিম যূথবদ্ধ জীবনযাপনের সময় থেকেই মানুষ উৎসব প্রিয়। ভুবন জুড়ে সব দেশেই কৃষক যেই দেখে ফসলে রং লেগেছে, ঘরে ঘরে নবান্নের তোড়জোড় শুরু হয়। সে রকম বাংলায় যেই ফাগুন চলে যায়, যেই একটু আগুন আগুন হাওয়া বইতে শুরু করে, ছাদের টবে যেই বেলকুঁড়ি দেখা দেয়— সারা বছর জিনস পরা বাঙালি মেয়েও আলমারি হাতড়ে সাদাখোলের তাঁতের শাড়িটা বার করে গুছিয়ে রাখে, পথ হাঁটার সময় কানে আসে রিহার্সালের সমবেত কণ্ঠ, ‘হে নূতন দেখা দিক আর-বার...’ রবীন্দ্রজয়ন্তী আসছে যে! অনেকগুলি দশক ধরে অন্য ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে বাঙালির জীবনে অবিচ্ছেদ্য ভাবে সংযোজিত হয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনের উৎসব। সে দিন ফুলের দোকানে জুঁই, বেলফুলের মালা, রজনীগন্ধা গুচ্ছ সব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়, অনেক আগে থেকে বায়না দিয়ে না রাখলে কোনও লাউডস্পিকার, কোনও হল ভাড়াও পাওয়া যায় না।

ভয়ানক ভাইরাসের আক্রমণে ধুঁকছে পৃথিবী। কেমন হবে, কী ভাবে হবে দু’হাজার কুড়ি সালের রবীন্দ্রজয়ন্তী! কবিও কি সঙ্কটে! মুখে মাস্ক পরানো কবির ছবি নিয়ে হয়তো অনেক মিম ঘুরবে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে, হয়তো সন্ধ্যায় আকাশজুড়ে আসবে মনখারাপের কালবৈশাখী। নিজের জন্মদিন নিয়ে অনেক কবিতা, অনেক কথাই তো লিখে গিয়েছেন তিনি। তিনি থাকলে কী প্রতিক্রিয়া হত, তাঁর এ বছরের ‘জন্মদিন’ নিয়ে?

কবির জন্মদিন প্রথম বার পালিত হয়েছিল তাঁর ২৬ বছর বয়সে, ১৮৮৭ সালে। প্রিয় ভাগ্নী সরলাদেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় লিখেছেন, ‘রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে নিঃশব্দে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাকে জাগিয়ে দিলাম’, এর পর সে দিন বাড়িতে সবাই মিলে জন্মদিন পালন হয়েছিল। পরে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকেরা ১৯১০ সাল থেকে নিয়মিত কবির জন্মদিন পালন করে এসেছেন। ১৯৩১ সালে কবির ৭০ বছর বয়সে তো রীতিমতো আলোড়ন তুলে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। অনুষ্ঠান কমিটির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, মূল উদ্যোক্তা অমল হোম। এই উপলক্ষে প্রকাশিত ‘The Golden book of Tagore’- এ নিবন্ধ লিখেছিলেন দেশ, বিদেশের নামী, গুণী মানুষেরা। জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য গ্রহণে কবির অসন্তোষ কখনও বোঝা যায়নি। কিন্তু মনের নিভৃতে কি কবির ভাবনা অন্য খাতে বইত! প্রতি বছর জন্মদিন উপলক্ষে তিনি কিছু লিখতেন। সব কবিতাতেই সেই অনন্ত জিজ্ঞাসা, ‘কে আমি ?’ চিরন্তন এই প্রশ্ন থেকে ‘এই আমি প্রথমজাত অমৃত’ উত্তরে ফেরার চেষ্টা। সে সব কবিতাই আমাদের দলিল দস্তাবেজ। বাংলা ১৩৪৪ সালে আলমোড়াতে বসে ‘জন্মদিন’ কবিতায় লিখছেন, ‘দৃষ্টিজালে জড়ায় ওকে হাজারখানা চোখ,/ ধ্বনির ঝড়ে বিপন্ন ঐ লোক।/ জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলেই থাকে,/ দোহাই ওগো, তাদের দলে লও এ মানুষটাকে’।

বাংলার ১৩৪৬ সালে ‘জন্মদিন’ নবজাতকে অন্তর্ভুক্ত, ‘তোমরা রচিলে যারে/ নানা অলংকারে/ তারে তো চিনি নে আমি,/ চেনেন না মোর অন্তর্যামী... তোমাদের জনতার খেলা/ রচিল যে পুতুলিরে/ সে কি লুব্ধ বিরাট ধূলিরে/ এড়ায়ে আলোতে নিত্য রবে।/ এ কথা কল্পনা কর যবে...’ ১৯৪১ সালে অসুস্থ অবস্থায় শেষ জন্মদিন। মে মাসের ছ’তারিখ লিখলেন শেষ জন্মদিনের কবিতা, ‘আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা...’

রবীন্দ্ররচনাতে জন্মদিন ছুঁয়ে সব লেখা জুড়ে দুই রবীন্দ্রনাথের এক দ্বন্দ্ব। যদুনাথ সরকারকে চিঠিতে লিখছেন, ‘এই সমস্ত বাহ্য আড়ম্বরের উদ্যোগ আয়োজনে আমি যে কিরূপ সঙ্কোচ অনুভব করিতেছি তাহা অন্তর্যামীই জানেন।’ আবার ‘জন্মোৎসব’ প্রবন্ধে, আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে-উৎসব করছ, তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে, তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাক, আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছা হয়ে থাকে, তা-হলেই এই উৎসব সার্থক। তোমাদের জীবনের সঙ্গে আমার জীবন যদি বিশেষভাবে মিলে থাকে, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যদি কোনো গভীরতর সম্বন্ধ স্থাপিত হয়ে থাকে, তবেই যথার্থভাবে এই উৎসবের প্রয়োজন আছে, তার মূল্য আছে।’ এই কথাকটি সবচেয়ে মনে ধরে। ক্রমশ কি রবীন্দ্রজয়ন্তী আয়োজন সর্বস্ব এক দিনের হুল্লোড়ে পরিণত হচ্ছিল ? ক্রমশ হয়ে উঠেছে শিল্পীর নিজস্ব পারফর্ম্যান্স ভিত্তিক রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন। যেখানে রবীন্দ্রনাথকে অনুভবের মত নিরালা কোণের বড় অভাব। এ বার অতিমারি করোনা এসে কি সেই ‘বাহুল্যের আবর্জনা’ মুছে দিল! এ বছর আপাদমস্তক মানুষের যাপন বদলে গিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব, দূরত্ব, দূরত্ব... বিশ্বজুড়ে কোনও এক মেহের আলি যেন কানের কাছে দিবারাত্র চিৎকার করে চলেছে, ‘তফাৎ যাও, তফাৎ যাও’।

ঘরে বসেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পঁচিশে বৈশাখের আয়োজন চলছে বিকল্প ব্যবস্থাপনায়। জুম, স্কাইপ, ফেসবুক লাইভ, সমবেত ভিডিও কল, নানাবিধ অ্যাপে অন্তরীক্ষ জুড়ে ভাসবেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর নিজের কেমন লাগত দু’হাজার কুড়ির এই ‘ভার্চুয়াল’ কবিপ্রণাম? ‘ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁয়ার’ পিছনে তাঁর পূজার ছলে তাঁকে ভুলে থাকাটা তো তাঁর মোটেও পছন্দ ছিল না কোনও দিন। বিজন ঘরে নিশীথ রাতে একলা বসে কবিকে অন্তরে অনুভব, ‘তার হৃদয়-বাঁশি আপনি কেড়ে/ বাজাও গভীরে।’ এই কি ছিল না তাঁর অন্তরের চাওয়া?

লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে ব্যস্তানুপাতিকে কমেছে মানুষের নিজের সঙ্গে দূরত্ব। হয়তো এ বছর বহির্জগতের কোনও তাড়া, পারফর্ম্যান্সের কোনও চাপ থাকবে না বলে, প্রকৃত রবীন্দ্র অনুরাগী কবির সাধনায় মগ্ন হতে পারবেন। যাঁর হৃদয়েতে পথ কেটে রাখা আছে, হৃষ্ট কবির চরণ সেখানে পড়বেই। বাইরের আড়ম্বরে কি প্রয়োজন!

‘‘একমনে তোর একতারাতে একটি যে তার সেইটি বাজা—

ফুলবনে তোর একটি কুসুম, তাই নিয়ে তোর ডালি সাজা।।’’

এ বছর পঁচিশে বৈশাখ হয়তো ‘উৎসব’ থেকে ‘অনুভব’- এ ফেরার দিন। এক বাঁকবদলের সন্ধিক্ষণ।

লেখক দুর্গাপুরের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy