বেশ কয়েক বছর আগে। সকালের কফি হাতে কথা হচ্ছিল। কৃষ্ণাদি গল্পচ্ছলে বলছিলেন, তাঁর কম বয়সের ডায়রিগুলি আবার হাতের নাগালে এসেছে, ভাবছেন কিছু লিখবেন। “কী রকম হবে বলো তো? কিছু মানে হবে কি?” যদিও বুঝতে পারছিলাম প্রশ্নটা আলঙ্কারিক, লেখার কাছাকাছি পৌঁছেই গিয়েছেন মনে মনে, তবু রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বললাম, “মানে হবে কি না বলছেন? কী কাণ্ড! অসম্ভব জরুরি ব্যাপার হবে, তাড়াতাড়ি শুরু করুন!” তার পর বার কয়েক ফোনে জানতেও চেয়েছিলাম, “এগোচ্ছে তো আপনার লেখা?”
ওঁকে তাড়া দেওয়ার দরকার হত না কোনও দিন। দ্রুত ভাবতেন, দ্রুত লিখতেন। অসামান্য সুন্দর মাধুর্যময় ভাষায় সেই লেখার মধ্যে অবধারিত ভাবে জায়গা করে নিত অনেক কাহিনি, অনেক ইতিহাস। এ সব জেনেও তাড়া না দিয়ে পারতাম না। কেননা, ‘হারানো ঠিকানা’ লেখা হওয়ার আগেই বুঝেছিলাম, এ এক এমন স্মৃতিকথা হতে চলেছে, যার তুলনা বাংলার ভান্ডারে মোটেও প্রচুর পরিমাণে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই লেখার মধ্যে থাকবে নিজের জীবন, সকলের জীবন, বাংলার জীবন, ভারতের জীবনের এক আশ্চর্য মিলমিশ। বরাবরের মতোই তাঁর লেখায় থাকবে, আপাত-সামান্য সব ঘটনার বিবরণের মধ্যে না-বলা নানা অসামান্য ইঙ্গিত। সেই ইঙ্গিত ইতিহাসের দিকে— আরও স্পষ্ট করে বললে, সেই ইঙ্গিত ইতিহাসের মধ্যে প্রোথিত যে মূল্যবোধ, তার দিকে। অমন লেখা সহজপ্রাপ্য নয়। তাই তার প্রত্যাশাতেও পাঠকের উত্তেজনা।
আজ কৃষ্ণাদির কথা ভাবতে গিয়ে মনে হচ্ছে, উনি যে আমাদের অনেকের মনে এত বড় একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন, তার প্রধান কারণ এটাই। ওঁর কথায়, লেখায়, আলোচনায়, ব্যবহারে, উপদেশে, কুশলপ্রশ্নে মিশে থাকত উঁচু তারে বাঁধা একটা মূল্যবোধ, আর নরম তারে বাঁধা একটা সমমর্মিতা, যাকে আমরা আজকাল চিনি এমপ্যাথি নামে। আরও একটা কারণ— সেই মূল্যবোধ আর এমপ্যাথি অনায়াস দক্ষতায় ভাষায় ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা ছিল ওঁর, সে লেখাতেই হোক, আর মুখের কথাতে। এ একটা অন্য শিক্ষা, অন্য রকম মানসিক গঠন— আগের সমাজের কাছে যা ছিল তুলনায় সহজলভ্য, আর আজকে আমাদের কাছে যা বিলীয়মান ভুবন, বিস্মৃতপ্রায় নস্টালজিয়া, আমাদের মানস-মননের হারিয়ে যাওয়া ঠিকানা।
তাঁর প্রায় সব লেখাতেই মিশে থাকত একটা ব্যক্তিগত স্বর। পার্সোনাল ইজ় পলিটিক্যাল বলে একটা কথা তত্ত্বে পড়েছি। তাঁর লেখায় কথাটার একটা ভিন্ন মানে তৈরি হয়ে উঠত, তাঁর নিজের দেখা-শোনা-বোঝা জগতের ছবির মধ্যে দিয়ে রাজনীতি আর সমাজের একটা আদর্শ আদল ফুটে উঠত। এমন পালকের মতো নরম ছোঁওয়ায় যে পাঠক নিজেও হয়তো বুঝতেন না কোথায় কী ভাবে তিনি উপনীত হচ্ছেন একটা বৃহত্তর পরিসরে। যে কোনও লেখকের কাছে এ এক সাধনার বিষয়, কী ভাবে পারা যায় নির্ভার ভাষায় বিষয়ের গভীরে যেতে। কৃষ্ণাদি তা পারতেন অনায়াসে, কলম হাতে বসলেই। দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, আজ অবধি ওঁর অজস্র লেখা খুঁটিয়ে পড়েও দুর্বল কোনও একটি বাক্য পাইনি, যা না থাকলেও চলত। উনি অব্যর্থ ভাবে জানতেন কী লিখছেন আর কী লিখতে চাইছেন।
লেখালিখির বাইরে কৃষ্ণাদির শিক্ষকতা ও রাজনীতি দুয়ের কথাই অনেকে জানেন। কিন্তু সব ছাপিয়ে যা ওঁকে শেষ অবধি আলোড়িত করত, সেটা এই বৃহৎ মানবিক সংস্কৃতি। স্বাভাবিক কারণেই ক্রমশ উদ্বিগ্ন ও দুঃখিত হয়ে পড়ছিলেন ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে। তিনি সেই প্রজন্মের মানুষ, যাঁরা দেশভাগ ও স্বাধীনতাকে কেবল প্রাপ্তি হিসেবে দেখেননি, তার দামটাও এই দেশকে দিতে দেখেছেন, এবং জাতিগত ভাবে একটা দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করে এসেছেন। তিনি সেই সময়ের মানুষ, যাঁরা ১৯৪৩ সালে চোখের সামনে পুরুষ-মহিলা-শিশুকে ক্ষয়ে যেতে যেতে মরে যেতে দেখেছেন, এবং লিখেছেন, আজও গোটা পৃথিবী জানে না কী ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শেষবেলায় এ দেশে এমন বিপুল নরমেধ যজ্ঞ ঘটিয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় কলকাতা শহরকে চোখের সামনে অপরিচিত হয়ে যেতে দেখেছেন, এবং লিখেছেন যে বিদ্বেষ-উন্মত্ত সেই শহরে লাশকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়ার সম্মানটুকুও সে দিন দু-এক জন ইংরেজই দেখিয়েছিলেন। তিনি সেই সময়কে মনে করতে চাইতেন, যখন নেতাজির নেতৃত্বে হাতে হাত মিলিয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিতে এগিয়ে এসেছিল শয়ে শয়ে যুবক, আইএনএ ট্রায়ালের সময়ে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল এত বড় দেশের নানা কোণে নানা সমাজ। তিনি দেখেছিলেন, কী ভাবে নেহরু নেতাজির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতি গভীর সম্মান পোষণ করতেন। এই সবই আমাদের জানা ইতিহাস, শোনা গল্প। কিন্তু আজ আমরা জানি, ‘জানা’ এবং ‘শোনা’ সবই বাইরের কথা। আমাদের সময় সম্ভবত কিছুই শেখেনি এই চলে-যাওয়া সময়ের কাছ থেকে, তার মারাত্মক ভ্রম কিংবা অপূর্ব সত্য-আগ্রহ, কিছুই আমাদের বোঝাতে পারেনি যে জাতি বা দেশ মানে দ্বেষ-সঙ্কীর্ণতা-হিংসা নয়, কথাগুলির অর্থ আসলে সব রকমের বিভেদ ও বৈষম্যের ঊর্ধ্বে থাকা মানুষ।
গত কিছু কাল ধরে যত বার কৃষ্ণাদির সঙ্গে কথা হয়েছে, এই বেদনাই দেখেছি তাঁর মধ্যে। যে ভাবে এগোচ্ছে সব, তাতে তো তাঁকেও কেউ দেশের বাইরে বার করে দিতে পারে, তা হলে গরিব মানুষদের কেমন লাগছে, বলছিলেন এক দিন। যে ভাবে সংসদের কিংবা সংবিধানের অসম্মান করা হচ্ছে, তাতে তো দেশের জন্য এত দিনের আত্মত্যাগ অনর্থক হওয়ার জোগাড়, বলছিলেন। কিন্তু শুধু আক্ষেপে তো ক্ষান্ত থাকার মানুষ নন তিনি। হাজারো অসুস্থতা অগ্রাহ্য করে, চোখের ক্ষীয়মাণ দৃষ্টিশক্তি উপেক্ষা করে সমানে লিখে যাচ্ছিলেন তাঁর বক্তব্য, ইতিহাসের দেওযা শিক্ষা। এই তো সে দিন, ছাব্বিশে জানুয়ারির প্রাককালে ফোনে বলছিলেন, “ভাবছি আর এক বার লিখব আইএনএ-তে নেতাজির সঙ্গে কেমন ভাবে এক সঙ্গে লড়াই করতেন হিন্দু, মুসলিম, শিখ সব ধর্মের মানুষ। কথাগুলি তো বলে যাওয়া চাই, কী বলো।” হ্যাঁ, আবারও লিখেছিলেন, সেই চমৎকার গদ্যে। সেই তাঁর আনন্দবাজার পত্রিকার শেষ উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, শিরোনাম ‘নেতাজির সহযোদ্ধারা’ (১/২)।
কেবল দূরের ইতিহাস নয়, কাছের ইতিহাস মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনটাও বোধ করতেন খুব। বাজপেয়ী সরকারের আমলে সাংসদ হিসেবে দিল্লিতে কাজ করার অভিজ্ঞতার সঙ্গে এখনকার দিল্লির রাজনৈতিক সংস্কৃতির কতটা প্রভেদ, সে কথাও উঠে এসেছে সম্প্রতি কালের বিভিন্ন লেখায়। আমরা কথায় কথায় গণতন্ত্র বিপন্ন বলে আক্ষেপ করি, কিন্তু আসলে যে প্রতিষ্ঠান আর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি রক্ষার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে বাঁচানো যায়, সেই কাজের কথাটা যথেষ্ট পরিমাণে বলি না। শিক্ষক কৃষ্ণাদি বলতেন পুরনো ইতিহাসের কথা। আর রাজনীতিক কৃষ্ণাদি প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের গুরুত্বটা মনে করাতে ভুলতেন না।
এই সময়ের অসামান্য এক ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার এখন ‘পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল’ বিষয়ে লেখালিখি করেন। তাঁর এমন একটি লেখায় পড়েছিলাম যে, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের দায়িত্ব— এক দিকে তত্ত্বকথা, সমাজ-আলোচনা করা, আর অন্য দিকে সহজ স্পষ্ট ভাবে যুক্তি-যুক্ত কথা, সত্যি তথ্য ও পরিষ্কার ভাবনাচিন্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। রোমিলা বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলি এই দুটি কাজ মোটেই মন দিয়ে করে না। দুর্ভাগ্য যেমন, সৌভাগ্যও আমাদের যে— এ দেশে প্রতিষ্ঠানের অসীম দুর্বলতার পাশাপাশি কিছু মুষ্টিমেয় সবল মানুষ আজীবন অক্লান্ত ভাবে এই জরুরি কাজটি করে গিয়েছেন, অন্তত করার চেষ্টা করে গিয়েছেন— কৃষ্ণা বসু তাঁদের অন্যতম। আজ ওঁরা না থাকার অর্থ, ঘোর তিমিরঘন অন্ধকারে আমাদের পথ দেখানোর বাতিটি আরও, আরও নিবে যাওয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy