রাজিয়া বেগম নিজেই বেরিয়ে পড়েছিলেন স্কুটার নিয়ে। দুই ছেলের ছোটটা নেলোরে লকডাউনে আটকে পড়েছিল। বড় ছেলেটাকে পাঠানো যেত, কিন্তু এতটা পথ, পুলিশ যদি আটকায়! তাই বছর আটচল্লিশের মহিলা, এবং মা— সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। একটু রুটি-তরকারি নিয়েছিলেন সঙ্গে। পেট্রল পাম্পে দাঁড়াতেই হবে, জল আর বাথরুম জুটে যাবে নিশ্চয়ই! তবু, ছেলেকে বাড়ির নিশ্চিন্তিতে ফিরিয়ে আনতে চোদ্দোশো কিলোমিটার স্কুটারে কী এমন! হ্যাঁ, রাতের হাইওয়েতে স্কুটার চালাতে একটু গা ছমছম করেছিল, তাতে কী। সোমবার সকালে তেলঙ্গানার নিজ়ামাবাদ থেকে রওনা, মঙ্গলবার দুপুরে অন্ধ্রপ্রদেশের নেলোর পৌঁছনো, সে দিনই ছেলেকে নিয়ে ফেরা, বুধ-সন্ধেয় বাড়ি। হল তো!
কর্নাটকের বেলগামে একটা হাসপাতালের নার্স সুগন্ধা, টানা পাঁচ দিন ডিউটিতে। ঘরে ফিরতে পারেননি। বাড়িতে চার বছরের ছোট্ট মেয়ে কেঁদেকেটে অস্থির, সে মায়ের কাছে যাবেই। সুগন্ধার স্বামী শিশুটিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাসপাতালের উল্টো দিকে। এ এমন এক রোগ, রোগীদের দেখাশোনা থেকে একটু ফোকর বার করে, হাসপাতালের সামনেটায় এসে, দূর থেকে মেয়ের উদ্দেশে হাত নাড়া আর চুমো-আদরের ভঙ্গিটুকু ছাড়া কিছু করতে পারেননি সুগন্ধা। মেয়েকে কোলে নেওয়ার প্রশ্নই নেই। কে ছবি তুলে রেখেছিল মা-মেয়ের এই দূরত্বময় নৈকট্যের, সমাজমাধ্যমে উল্কাবেগে ভাইরাল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও আপ্লুত, এই নিবেদিতারা থাকলে লড়াইটা জেতা যাবে বইকি!
লকডাউনের দিন সাতেকের মাথায় এক বন্ধু জানিয়েছিল আর এক মায়ের কথা। ভর দুপুরে রাস্তা-ঘেঁষা বাড়ির জানলার সামনে এসে কৃশাঙ্গী বৃদ্ধা বলছিলেন, ‘ধূপ নেবেন?’ লকডাউনে ধূপ! ‘নিন না, বাড়িতে নিত্য পুজো-আচ্চা তো চলছে, ধূপ লাগবে না একটা?’ ধূপটা ব্যাপার নয়, আপনি বেরিয়েছেন কেন? চাপাচাপিতে বেরিয়ে পড়ে ঢাকনাচাপা ট্র্যাজেডি— মেয়ে-জামাই থাকে কাছেই, কিন্তু দেখে না। যৎসামান্য চাহিদা, তবু পেটটা তো ভরাতে হয়, পয়সা তো লাগে কিছু। ‘আমি তো ভিক্ষে চাইছি না, একটা জিনিস বেচে রোজগার করতে চাইছি। দূর থেকে রেখে যাচ্ছি, একটু মুছে-টুছে...’ সস্তা কাপড়ের মাস্কে ঢাকা মুখের আকাশে আত্মসম্মানবোধ আর আকুতি যুগপৎ ছায়া ফেলে যায়।
আরও পড়ুন: এ পঁচিশে বৈশাখ উৎসব থেকে অনুভবে ফেরার
মুম্বইয়ে বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত এক বন্ধু ও তাঁর স্ত্রী, দু’জনেরই ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চলছে। কাজের চাপ কম নয়। তরুণ দম্পতির শিশুপুত্রটিকে দিনভর দেখাশোনা করেন বন্ধুপত্নীর মা। নাতি, টেলিভিশন, খবরের কাগজ, রান্না, সেলাইফোঁড়াইয়ে দিন কাটছে। ক’দিন আগে তিনি জামাইয়ের কাছে খোঁজ নিচ্ছিলেন, ফোনে ইউটিউব কী করে দেখতে হয়। কী দেখবে, জানতে চাইলে বলেছিলেন, মাস্ক কী করে বানানো যায়, দেখব। সেলাই তো জানিই, যা-যা লাগবে তোমরা একটু এনে দিলে বানাতে পারব না? সতেরো তলার ওপর থেকে দেখা ফুটপাতের লোকগুলোকে দেওয়া যাবে!
রায়পুরের অতিরিক্ত সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ অমৃতা সোরি লকডাউনে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পুলিশকর্মীদের কাজের তদারকি করছেন। হলুদ-সবুজ সালোয়ার-কামিজ, মুখে মাস্ক। ডিউটিতে, কিন্তু উর্দিতে নয় কেন? অমৃতা সন্তানসম্ভবা, সাত মাস চলছে। শুনেই ছিটকে বেরোতে চায় অস্ফুট আশঙ্কা— ‘এই সময়ে উনি রাস্তায়!’ অমৃতা আশ্বস্ত করছেন: ‘আমি ঠিকই আছি, কিন্তু লকডাউনে শহরটাকেও তো ঠিক রাখতে হবে!’ এত পুলিশকর্মী, মহিলা পুলিশকর্মীও দিনরাত এক করে খাটছেন, কোনও আধিকারিক থাকলে ওঁরাও উৎসাহ পান। কয়েকটা চেকপয়েন্ট ঘুরেই বাড়ি চলে যাবেন হবু মা।
আরও পড়ুন: মানব-প্রজাতির এই সঙ্কটে পাশে আছেন রবীন্দ্রনাথ
মায়েদের যে কত কিছুই করতে হয়! মেরিঅ্যান, টেক্সাসের এক মা, তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ের জামায় একটা কাগজ সাঁটিয়েছেন— ‘আমার বয়স পাঁচ। বাড়িতে একা থাকতে পারি না, তাই আমি মা’র সঙ্গে দোকানে খাবার কিনতে এসেছি...’ কী ব্যাপার? লকডাউনে নিয়ম, বাড়ির এক জনই বাইরে বেরোতে পারবেন জিনিসপত্র কিনতে। মেরিঅ্যানের মতো একলা মা, বাড়িতে যাঁর ছোট্ট শিশুটি ছাড়া দ্বিতীয় সদস্যটি নেই, কী করবেন? না জেনেবুঝে ‘এ কেমন মা, বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়েছে!’ শিরোনামে খচাখচ ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় খাপ বসানোর লোকের অভাব আমেরিকাতেও নেই। কিন্তু কী করবেন মেরিঅ্যানের মতো ‘সিঙ্গল মাদার’রা? টেক্সাসের যে কাউন্টি ওঁর ঠিকানা সেখানকার এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে, সান ফ্রান্সিসকোর এক-চতুর্থাংশ পরিবারেই ‘সিঙ্গল পেরেন্ট’, এবং একা মায়েরাই বেশি! এই মায়েরা এত দিন ঘর সামলেছেন, বাচ্চাকে ডে-কেয়ারে রেখে দিনভর কাজ করে চালিয়ে নিতে পেরেছেন অল্প পয়সাতেও। কিন্তু এখন? অনেকের চাকরি নেই। কামাই কম হলেও চাহিদা ছিল যে চাকরিগুলোতে, সেই চাইল্ডকেয়ার, হাউসকিপিং, পর্যটনের মতো ক্ষেত্রগুলো করোনার জেরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই মায়েরা কী করবেন? তার ওপরে ভয়, তিনি আক্রান্ত হলে শিশুটিকে কে দেখবে? চার-পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুটিকে ঘরের কাজ— নিজে খাওয়া, বাথরুম করা, বিছানা করা— ওঁরা শেখাচ্ছেন প্রাণপণে। কে খোঁজ রাখছে সেই মায়ের মনের তোলপাড়ের, যাঁর সন্তানটি শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধে কাবু? কেউ বা প্রিয় পোষ্যটির ছবি দিয়ে লিখছেন, আমার কিছু হলে আপনারা কেউ এসে ওকে নিয়ে যাবেন?
বিপ্লব, যুদ্ধ কি মহামারি, মায়েদের লড়াইটা জারি থাকে। ঘণ্টা, প্রদীপ, পুষ্পবৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই। ও, মনে পড়ল, কাল তো আবার ‘মাদার্স ডে’!
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy